মান বাঁচানোর লড়াই! বহিষ্কৃত হয়ে ফের সংসদে ফিরতে পারবেন মহুয়া মৈত্র?

Mahua Moitra Krishnanagar: বিজেপি এলাকায় মহুয়ার বহিষ্কারের ঘটনাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। সাংসদ হিসেবে মহুয়া যে এলাকার কাজ করার জন্য অযোগ্য, তা ভোটারদের বুঝিয়ে দিতে কসুর করেনি বিজেপি।

কৃষ্ণনগরে একবারই ক্ষমতায় এসেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। ১৯৯৯ সাল। সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। তার আগে অবধি কমিউনিস্ট পার্টির দখলে ছিল কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র। ২০০৯ সালে তৃণমূলের হয়ে এই আসনে জেতেন অভিনেতা তাপস পাল। ২০১৯ সালে তৃণমূলের ব্যাটন এগিয়ে নিয়ে যান সাংসদ মহুয়া মৈত্র। মহুয়া সাংসদ হওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্ক তাঁকে ঘিরে থেকেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সংসদের নীতি না মানার অভিযোগে তাঁর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া হয়। এবার ফের কৃষ্ণনগর আসন থেকে লড়ছেন মহুয়া। কঠিন লড়াই। পারবেন এবারেও?

প্রাক্তন সাংসদ মহুয়া মৈত্র বিজেপির নবাগত প্রার্থী অমৃতা রায়ের বিরুদ্ধে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অমৃতা রায় সম্পর্কে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের বংশধর। ১৯৭১ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৮ বছর সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি ছিল কৃষ্ণনগর। ১৯৯৯ সালে আসনটি জিতে বিজেপি সিপিএমের আধিপত্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ক্ষত তৈরি করেছিল। ২০০৪ সালে এই আসন ফের বামেদের দখলে আসে, জয়ী হন জ্যোতির্ময়ী শিকদার। তারপর ২০০৯ সালে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী অভিনেতা তাপস পাল সিপিএমকে ক্ষমতাচ্যুত করে কৃষ্ণনগর দখল করেন। ২০১৯ সালে মহুয়া মৈত্র তাঁর বিজেপি প্রতিপক্ষ কল্যাণ চৌবেকে পরাজিত করে ৬৩,১২৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। কম ভোটে জিতলেও মহুয়ার এই জয় তৃণমূলের কাছে ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে তাপস পাল গ্রেফতার হওয়ার পর এই আসন দখলে রাখাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে গত বছর থেকে আবার বিপাকে তৃণমূল। ৮ ডিসেম্বর মহুয়া মৈত্রকে লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। নগদ টাকা নিয়ে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। রয়েছে সাংসদ হয়ে গোপন পাসওয়ার্ড-আইডি অন্য ব্যক্তিকে দেওয়ার মতো অভিযোগ। গোটা ঘটনায় তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাগোড়া পাশে থেকেছেন মহুয়ার। মহুয়ার উপর যে আস্থা রয়েছে তার প্রমাণ ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ফের তাঁকে কৃষ্ণনগরে প্রার্থী করা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মহুয়ার শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব তাঁকে এবারও ভালো ভোট এনে দিতে পারে।

আরও পড়ুন- ভোটে মহুয়া-কাঁটা তুলতে অমৃতার পাশে খোদ মোদি, কোন পথে কৃষ্ণনগরের লড়াই?

বিজেপি এলাকায় মহুয়ার বহিষ্কারের ঘটনাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। সাংসদ হিসেবে মহুয়া যে এলাকার কাজ করার জন্য অযোগ্য, তা ভোটারদের বুঝিয়ে দিতে কসুর করেনি বিজেপি। তবে মহুয়া নিজের দম প্রচার করে গেছেন। গ্রামে, শহরে, অলিতে গলিতে গিয়েছেন। তাঁকে দেখতে পুরুষ এবং মহিলাদের ভিড় জমেছে। মহুয়া মৈত্র বাচ্চাদের সঙ্গে মিশেছেন, মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া 'অন্যায়ে'র জবাব দিতে মহিলাদের ভোট চেয়েছেন।

কৃষ্ণনগরের রাজমাতা অমৃতা রায় বিজেপির হয়ে লড়ছেন। এই রাজ্যের সবচেয়ে ধনী প্রার্থী তিনি। উত্তরাধিকারসূত্রে ৫৫৪ কোটি টাকার সম্পত্তি আছে তাঁর। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা আছে কি? বিজেপির অমৃতা রায় মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের উত্তরাধিকারী ছাড়া আর কোনওভাবেই বিশেষ পরিচিত নন। হতে পারেন তিনি রাজমাতা কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা খুব কম বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অমৃতা রায় প্রচারের সময় গ্রামে বিশেষ যাননি। মানুষের ভরসার প্রার্থী তিনি কতটা হয়ে উঠেছেন তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

তবে মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে দলীয় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষও রয়েছে। মহুয়ার প্রচারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে উপর মহলের, পছন্দের পেশাদার দল নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন মহুয়া। ফলে মহুয়া মৈত্রর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না হওয়ায় দলের অনেক সদস্য হতাশও।

বিজেপির কাছে এই আসন যে গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝিয়ে দিয়েছেন খোদ মোদি। সন্দেশখালির বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র ছাড়া অমৃতা রায়ের সঙ্গেই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছিলেন।

এই এলাকাতে মূলত তিনটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধানসভা কেন্দ্র আছে। কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া এবং চাপড়া। একটি অঞ্চলও তৃণমূল হাতছাড়া করতে চায় না। বিজেপি বাকি চারটি আসন, তেহট্ট, পলাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর এবং কৃষ্ণনগর দক্ষিণে জোর লড়াইয়ে প্রস্তুত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, কৃষ্ণনগর উত্তর বাদে এই সাতটি আসনের মধ্যে ছয়টিতে তৃণমূল বিজয়ী হয়েছিল। কৃষ্ণনগর উত্তরে বিজেপির মুকুল রায় জিতেছিলেন। তবে বিজেপি ছাড়াও এবার মহুয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন বাম প্রার্থী এস এম সাদি। তিনি ছিলেন পলাশিপাড়ার প্রাক্তন বিধায়ক৷

তবে টাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তাঁর সঙ্গে হিরানন্দানির নাম জড়ানো, আদানির বিরোধিতা করতে গিয়ে টাকা নেওয়ার মতো অভিযোগকে ভালো চোখে দেখছে না কৃষ্ণনগরের অনেকেই। পলাশি চিনিকল বন্ধ বা জলঙ্গী ও অঞ্জনা নদী বাঁচানো বা পাটচাষিদের দুর্দশার ঘোচানোর মতো স্থানীয় সমস্যা নিয়ে যে মহুয়ার মাথাব্যথা নেই, বলছেন বাসিন্দারাই৷ তবে মহুয়া লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে হাতিয়ার করে লড়ে যাচ্ছেন। কন্যাশ্রী এবং রূপশ্রীর মতো মহিলাদের জন্য তৈরি প্রকল্পগুলির ঢালাও প্রচার করছেন।

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকার কারণে এবার কৃষ্ণনগরে প্রায় ব্যাকফুটেই রয়েছে তৃণমূল। পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। তেহট্টর বিধায়ক তাপস কুমার সাহাকে সিবিআই তলব করেছে। দু'টি বিধানসভাই মহুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের অংশ।

২০০৯ সালে তাপস পাল এই আসনে পেয়েছিলেন ৪২% ভোট, ২০১৪ সালে পান ৩৫ শতাংশের মতো। ২০১৯ সালে মহুয়া সেই ব্যবধান একধাক্কায় বাড়িয়ে করেন ৪৫%। এবারও কি মহুয়া নিজের ক্যারিশ্মাতেই কৃষ্ণনগর জয় করবেন?

আরও পড়ুন- স্পষ্টবাদী, স্বাধীনচেতা বলেই মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের ছক সাজাল বিজেপি?

নাকাশিপাড়া এবং কালিগঞ্জে বিজেপির শক্তি গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে আরএসএসের হাত ধরে। নবনির্মিত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যালয় এলাকায় বিজেপির ক্ষমতার প্রদর্শন বাড়িয়ে দিয়েছে। এই এলাকায় আরএসএস সাংগঠনিক শক্তি ভালোই।পাশাপাশি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন নিয়ে এই অঞ্চলের ২০% মতুয়া ভোট এবার বিজেপি পকেটস্থ করার সম্ভাবনাও রয়েছে। পাল্টা এই চালেই বিজেপির তুমুল ভোট হারানোর আশঙ্কাও আছে।

এস এম সাদি লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। কালিগঞ্জ, চাপড়া, নাকাশিপাড়া, পলাশিপাড়া এবং তেহট্টর মতো এলাকায়, যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশ বেশি সাদি তাঁদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে ব্যাপক হিংসার মধ্যেও বামেরা ২৯% ভোট পেয়েছিল। বামপন্থীদের সঙ্গে বহুকাল পরে প্রান্তিক পরিবারের যুবকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, যা সাদির জয়ের পক্ষে আশাব্যাঞ্জক৷

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে, বিজেপি ৪০.৫% ভোট পেয়েছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তা কমে ৩৭.৮% হয়। অন্যদিকে, বাম এবং কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট প্রায় ১০%। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল জিতলেও বামদের ভোট ছিল ২৯%। বিজেপি সেখানে তৃতীয় স্থানে ছিল। কৃষ্ণনগর লাল পথে হাঁটবে কিনা সেই আশাও একেবারে ছেড়ে দেওয়ার নয়।

More Articles