প্রকট এনআরসি-র আশঙ্কা! কেন জেলায় জেলায় বাতিল একাধিক আধার কার্ড?

Aadhaar Card Cancelled: বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তরবঙ্গ থেকেও আধার বাতিলের খবর মিলেছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি চালু করার প্রথম ধাপ নয় তো এই আধার বাতিল?

ভোটার থেকে প্যান, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে মোবাইল নম্বর, যাবতীয় কিছুই আধারের তারে বাধা। প্রায় সমস্ত পরিচয়পত্রকেই আধার কার্ডের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। ঠিক তার আগেই পশ্চিম বাংলার জেলায় জেলায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে আধার কার্ড। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় একাধিক ব্যক্তির আধার কার্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আধার কার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে পারেনি। কেন ভোটের আগে বাংলার ঘরে ঘরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আধার কার্ড। কোন ষড়যন্ত্র কাজ করছে এর নেপথ্যে? উস্কে উঠেছে জল্পনা।

পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের জুতিহাটি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা আধার বাতিলের চিঠি পেয়েছেন বলে অভিযোগ। আধার কার্ড বাতিলের জেরে অনিশ্চয়তার মুখে স্নাতক পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ। বীরভূমের ইলামবাজারে কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ওই পড়ুয়ার বাড়ি পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা বনকাটি পঞ্চায়েতে। দিন কয়েক আগে পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়ে তিনি দেখেন, তাঁর আধার কার্ডটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই তাঁর বাড়িতে এসেছে ডাক বিভাগের একটি চিঠিও। বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অন্তত ১১ জনের আধার কার্ড বাতিলের চিঠি এসেছে বলে খবর। বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তরবঙ্গ থেকেও আধার বাতিলের খবর মিলেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এমন আধার বাতিলের ধুম। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি চালু করার প্রথম ধাপ নয় তো এই আধার বাতিল? অনেকেই তেমন আশঙ্কা করেছেন।

আরও পড়ুন: আধারের পরে এবার ‘অপার’! কেন দেশের পড়ুয়াদের তথ্য পেতে মরিয়া কেন্দ্র?

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি চালু করার ব্যাপারে বরাবরই জোর দিয়ে আসছে বিজেপি। লোকসভা ভোটের আগেই দেশে সংশোধিত নাগরিক আইন চালু করার কথাও একাধিক বার জানিয়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখেও একাধিক বা শোনা গিয়েছে সেই কথা। আর এবার আধার কার্ড বাতিল নিয়ে সেই মারাত্মক আশঙ্কার কথাই তুললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিক জেলায় বহু মানুষের আধার কার্ড বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করলেন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষকে রাজ্য সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি চালু করার দিকেই কেন্দ্র এগোচ্ছে বলে দাবি তাঁর।

রবিবার সিউড়ির সভা থেকে তেমনটাই দাবি করেছেন মমতা। তিনি বলেন, "আমার কাছে খবর আছে। অনেকের আধার কার্ডের লিঙ্ক কেটে দেওয়া হচ্ছে। জামালপুরে ৫০ জনের আধার লিঙ্ক কেটে দেওয়া হয়েছে। বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তরবঙ্গেও চলছে। প্রথমে বলবে আধার না হলে চোখে আঁধার দেখবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে না, কোনও সুযোগ-সুবিধা পাবে না। আর এখন কাউকে জিজ্ঞেস না করে লিঙ্ক কেটে দেওয়া হচ্ছে।"

রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্প ও সুবিধা নেওয়ার জন্য বাসিন্দাদের এতদিন আধার কার্ড প্রয়োজন হত। এ রাজ্যের অসংখ্য মহিলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের সুবিধা পান। অন্যান্য প্রকল্পের ভাতা বা ভর্তুকি পেতেও আধার কার্ড দরকারি। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ভোটের আগে রাজ্যবাসীকে সরকারি প্রকল্প ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতেই বিজেপি সরকার এই সব ষড়যন্ত্র করছে। যদি বাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, "আমি পরিষ্কার বলে যাচ্ছি, আধার না থাকলেও আমাদের কোনও প্রকল্প বন্ধ হবে না। নিজেদের কার্ড দিয়ে চালিয়ে যাব। দিল্লি যা করছে, থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, স্মার্ট কার্ড, কোভিড কার্ড, জন্মের কার্ড, এথ কার্ড কি গলায় মালা করে রাখবেন? তার পর আবার কাউকে জিজ্ঞেস না করে বাতিল করে দিচ্ছে। বাংলার মানুষকে বলব, ভয় পাবেন না। আমি আছি। যদি দেখি এর মধ্যে ছলনা আছে, বাংলার একটি প্রকল্পকেও আমি আধার সংযুক্ত হতে দেব না।"

মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, সব চেয়ে বেশি নাকি আধার বাতিল হচ্ছে মতুয়াদের। মুখ্যমন্ত্রী কার্যত হুঙ্কার দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলায় এনআরসি করতে দেব না, এখানে ডিটেনশন ক্যাম্প করতে দেব না। বাংলায় রোজ কেন্দ্র থেকে কমিটি আসে, চোপড়ায় কোনও কমিটি গেছে? রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে আধার কার্ড বাতিল করা হচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যাঁদের নাম কেটে দিয়েছে, তাঁদের আমরা আলাদা কার্ড দেব। আধার কার্ড বাতিল করে দিলে, রাজ্যের পোর্টালে অভিযোগ জানান। কেন এত আধার কার্ড বাতিল? জবাব দিক কেন্দ্র।' পাশাপাশি তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেবেন বলেও আশ্বস্ত করেছেন।

গোড়া থেকেই নাগরিকপঞ্জির বিরোধিতা করে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এনআরসি কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়েই কেন্দ্র সরকার আধার কার্ড বাতিলের কাজ শুরু করেছে বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজনে আধার কার্ড বাতিল নিয়ে আইনি সহায়তার পখে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই জেলায় জেলায় আধার কার্ড বাতিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। আধার কার্ড ছাড়া বর্তমানে ব্যাঙ্কের কাজ থেকে শুরু করে অনেক জরুরি কাজই আটকে যাওয়ার কথা। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাঁরা ব্যাঙ্কের টাকা তুলতে পারছেন না। তোলা যাচ্ছে না রেশনও। হঠাৎ করে এ ভাবে আধার কার্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত বহু বাসিন্দাই।

তবে বিশেষজ্ঞেরা কিন্তু বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র ছাড়াও কিন্তু নানা কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আপনার আধার কার্ডটি। UIDAI তরফে জানা গিয়েছে, তিন বছর ধরে আপনার আধার কার্ড কোনও ক্ষেত্রে লিঙ্ক না হয়ে থাকে, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কিংবা PAN নম্বরের সঙ্গে আধার লিঙ্ক না করা হয়, সেক্ষেত্রেও  বাতিল হতে পারে কার্ডটি। EPFO-তে আধারের বিস্তারিত তথ্য না দেওয়া থাকলেও ডিঅ্যাক্টিভেট হয়ে যেতে পারে আধার কার্ড।

আরও পড়ুন: শহর জুড়ে আধার জালিয়াতি, কী ভাবে বাঁচাবেন আপনার সঞ্চয়?

ইতিমধ্যেই আধার বাতিলের ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের কলকাতার আধিকারিককে নবান্নে তলব করেছিলেন মুখ্যসচিব বিপি গোপালিকা। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, আধার কার্ড নিয়ামক সংস্থার ওই কর্তা জানিয়েছেন, বেঙ্গালুরু থেকে কার্ডগুলি বন্ধ করা হয়েছে। কিছু ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের পরেও ভারতে থেকে যাওয়ায় তাদের আধার কার্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মমতা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, বিশেষত সংখ্যালঘু ও তফসিলিদেরই নিশানা করা হচ্ছে। বেছে বেছে তাঁদেরই আধার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে নথি যাচাই না করেই বন্ধ করে দেওয়া হল আধারের মতো এমন একটি জরুরি পরিচয়পত্র, উঠেছে প্রশ্ন। সবটা মিলিয়ে তীব্র হয়েছে এনআরসি-র আশঙ্কা। তবে কি লোকসভা ভোটের আগেই তেমন কিছু ঘটাতে চলেছে মোদি সরকার? অসমের মতোই বাংলাতেও ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে! একগুচ্ছ আশঙ্কা প্রকট হয়েছে এই আধার-বিপর্যয় ঘিরে।

More Articles