বিবস্ত্র করে গোটা গ্রামে ঘুরিয়েছে মহিলারই ভাইয়ের বন্ধু!

Manipur Woman and Violence: পুরুষরাও কেউ ওই মহিলাদের লাঞ্ছনা দেখে আনন্দই পাচ্ছে। হয়তো লুকিয়ে হাসছেও।

না, মণিপুর বললেই আমার চিত্রাঙ্গদা মনে পড়ছে না। মা রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন, বাড়িতে বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয়রত রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত আলোকচিত্র বড় করে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আমার বর্তমান বাসস্থানে রবীন্দ্রনাথের কোনও ছবি ছিল না। মাসখানেক আগে এক আত্মীয়া ভালবেসে তাঁর আঁকা রবীন্দ্রনাথের একখানা ছবি একেবারে বাঁধিয়ে উপহার দিয়ে গেছেন। আমার স্ত্রী দেওয়ালে পেরেক লাগানোর ব্যবস্থা করে সেই ছবি ঝুলিয়েও দিয়েছেন। কয়েকদিন ধরে আমার সেই ছবি মাটিতে আছড়ে ফেলে ভাঙতে ইচ্ছা করছে। কারণ মণিপুর বলতেই চিত্রাঙ্গদা নয়, ‘আফ্রিকা’ মনে পড়ছে। আর ক্রমশ হীন হয়ে যাচ্ছি রবীন্দ্রনাথ চেনানো মায়ের কাছে, রবীন্দ্রনাথের ছবি এঁকে দেওয়া আত্মীয়ার কাছে, যত্ন করে সে ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া স্ত্রীর কাছে এবং ক্রমশ কিশোরী হতে চলা মেয়ের কাছে; যাকে ক'দিন আগেই কাগজ পড়া অভ্যাস করতে বলে এখন মণিপুরের খবরের পাতা লুকিয়ে রাখছি প্রাণপণ। টিভিতে মণিপুর সংক্রান্ত আলোচনা দেখে সে যখন জানতে চাইছে ঠিক কোন ঘটনা নিয়ে সবাই এত উত্তেজিত, তখন বলছি, “থাক, শুনতে হবে না।”

রবীন্দ্রনাথের কাছেও হীন হয়ে যাচ্ছি। কারণ আমার মতো বাঙালি ভদ্দরলোকের কাছে মণিপুর আফ্রিকার মতোই দূরের জিনিস। চিত্রাঙ্গদা, কয়েকজন ফুটবলার আর ইরম শর্মিলা চানু বাদ দিলে কালো ঘোমটার নীচে মণিপুরের মানবরূপ তো আমার কাছে উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে অপরিচিতই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি হীন করে দিচ্ছে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ,

“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে/প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে

রুদ্ধশ্বাস,/যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল –/অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের

অন্তিমকাল,/এসো যুগান্তের কবি,/আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে/দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর

দ্বারে;/বলো ‘ক্ষমা করো’ –/হিংস্র প্রলাপের মধ্যে/সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”

একে আমাদের সেরকম হৃদয়বান কবি-টবি নেই। তার উপর মানহারা মানবীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়িয়ে চলেছি আমরা আর ক্ষমা চাওয়ার অধিকার ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে। ২০০২ সালের বিলকিস বানো থেকে ২০২৩ সালের কুকি রমণীরা – শুধু যাঁদের অবমাননার ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে তাঁরা নন, যাঁদের ছিন্নভিন্ন দেহে মাঠে ঘাটে মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে বলে খবর – কতজনের কাছে ক্ষমা চাইব আমরা ভারতীয় পুরুষরা? কেনই বা তাঁরা ক্ষমা করবেন? নেকড়ের চেয়ে তীক্ষ্ণ যেসব নখ তাঁদের ছিন্নভিন্ন করেছে, যেসব চোখ তাঁদের গোগ্রাসে গিলেছে – সেগুলো তো আর সমুদ্রপার থেকে আসেনি। সেসব তাঁদের স্বজাতির নখ, স্বজাতির চোখ। এমনকী একজন মহিলা তো বলেছেন যারা তাঁকে বিবস্ত্র করে গোটা গ্রামে ঘুরিয়েছে তাদের একজন তাঁরই ভাইয়ের বন্ধু। সুতরাং রবীন্দ্রনাথে আর আমাদের কান দেওয়ার উপায় নেই। লালন ফকিরও বাতিল। তিনি তো ভেবেছিলেন, “পড়শী যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে।” কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাপার স্যাপার আমূল বদলে গেছে। এখন চেনাশোনা পাশের বাড়ির লোকটিই মূর্তিমান বিপদ।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’

তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, মানুষের কোনও কুকর্মই ইতিহাসবিহীন নয়। মণিপুরে যে দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, তেমন দৃশ্য যে নাজি জার্মানিতে হলোকাস্টের সময়েও দেখা গিয়েছিল তা জানতে কি এতদিনে কারও বাকি আছে? অতদূরই বা যেতে হবে কেন? ২০০২ সালের গুজরাতে এর চেয়েও বীভৎস দৃশ্যের সাক্ষী থাকা মানুষজন এখনও জীবিত। তখন স্মার্টফোন ছিল না, সুলভ ইন্টারনেট ছিল না। তাই আমাদের এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে, আমাদের মধ্যে যাদের ভিতর এখনও খানিকটা মনুষ্যত্ব বাকি আছে তাদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নিতে সেসব ভিডিও এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু আমরা বারবার কাগজে, পত্রিকায়
পড়েছি, এমনকী গোপন ক্যামেরায় সগর্বে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বীরদের বলতেও দেখেছি – কীভাবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পেট চিরে বার করে আনা হয়েছিল ভ্রূণ, মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাথরে আছড়ে খুন করা হয়েছিল শিশুকে। ২০০২ গুজরাতের মতোই ১৯৮৪ সালের উত্তর ভারতে শিখ মা আর মেয়েকে পাশাপাশি ধর্ষণ করার কাহিনিও গোপন তথ্য নয়।

এসব খবরে, এসব দৃশ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় একজন নারীর? কোনওদিন অনুভব করতে পারব না। কিন্তু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আরেক সম্প্রদায়ের অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখে নিজের শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাওয়া ঠান্ডা স্রোত স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। একদিকে পুরুষ হিসাবে স্ত্রীর দিকে, মেয়ের দিকে তাকাতে সংকোচ হয়। নিজের দৃষ্টিকে, নিজেরই হাতকে সন্দেহ হয় সময় সময়। সে সন্দেহ “এক হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ/আমি কী এ-হাতে কোনো পাপ করতে পারি” জাতীয় সংশয় নয়। বরং সন্দেহ – আমার মধ্যেও কি কোথাও ঘাপটি মেরে পড়ে আছে কোনও ধর্ষক দৈত্য, বিদ্বেষের আশ্চর্য প্রদীপে হাত ঘষলেই যে নিজ মূর্তি ধরে বেরিয়ে আসবে বিশাল বপু নিয়ে? অন্যদিকে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও না ভেবে পারি না – আজ মণিপুরে যা হচ্ছে কাল বাংলায় তা হলে কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে হবে? সেই সংঘর্ষে আমাদের পরিবারের মেয়েরা সংখ্যাগুরু হিসাবে বেঁচে যাবে, নাকি সংখ্যালঘু হিসাবে ওরকম উলঙ্গ হয়ে হাঁটতে বাধ্য হবে রাস্তা দিয়ে? এ দেশে আমরা সবাই তো কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনওভাবে সংখ্যালঘু। ক্রমশ বালকানায়ন হয়ে চলা এই দেশে বাঙালি-অবাঙালি, উচ্চবর্গীয়-নিম্নবর্গীয়, হিন্দু-মুসলমান, শহুরে-গ্রাম্য বা অন্য কোনও একটা বিভাজন নিয়ে মণিপুরের মতো ভয়ঙ্কর কাণ্ড
বেধে যেতে কতক্ষণ? মণিপুরের ঘটনার শিকার মহিলাদের একজন এক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের স্ত্রী। সেই সৈনিক একজন সাংবাদিককে বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন যে দেশকে বাঁচাতে শ্রীলঙ্কায়, কারগিলে লড়লেও নিজের স্ত্রীকেই তিনি বাঁচাতে পারেননি। আমরা তো সামান্য মানুষ।

আরও পড়ুন- মণিপুর ঢাকতে বিজেপির চাই একটা শরীর? রাজা তোর কাপড় কোথায়!

আজকাল এত চেনাজানা মুখকে মুখোশ বলে চিনতে পারা যাচ্ছে, যে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না, এরা অনেকে মণিপুরের কুকিদের দুর্গতি দেখে ভাবছে – বেশ হয়েছে। ভাবতে কষ্ট হয় বটে, কিন্তু অবিশ্বাস হয় না যে পুরুষরাও কেউ ওই মহিলাদের লাঞ্ছনা দেখে আনন্দই পাচ্ছে। হয়তো লুকিয়ে হাসছেও। এই হাসি, ঘুঁটের দহন দেখে গোবরের হাসিতে না রূপান্তরিত না হয়। গত কলকাতা বইমেলার আগে পড়তে হয়েছিল সাংবাদিক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের লেখা বই মরা আলোর সিম্ফনি। সে বইতে গৃহযুদ্ধে দীর্ণ উগান্ডার এক ধর্ষিত পুরুষের কথা ছিল। তিনি বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি হয়ে তিনবছর ধরে ধর্ষিত হন। এ কথা লজ্জায় স্ত্রীকেও বলে উঠতে পারেননি। পরবর্তীকালে যখন তাঁকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, ডাক্তারের মুখে সব শুনে হতভম্ব স্ত্রী জানতে চান, ধর্ষিত
স্বামী কি আর স্বামী থাকে, নাকি স্ত্রী হয়ে যায়?

দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ, অন্য সম্প্রদায়ের মহিলাদের নির্যাতন যতক্ষণ দৃশ্য হিসাবে থাকে ততক্ষণ দেখতে কারও কারও ভালো লাগতে পারে। নিজে দৃশ্য হয়ে গেলে কিন্তু সব ভালো লাগা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কেবল মানসিক নয়, একেবারে শারীরিক বেদনা নিয়ে, “যাদের করেছ অপমান,/অপমানে হতে হবে তাহাদের
সবার সমান!”

 


তথ্যসূত্র

১। The Truth: Gujarat 2002: Babu Bajrangi

More Articles