পথে যে বিবস্ত্র, সে আমার কেউ না

Manipur and Civil Society: মহাভারতে নিয়ম, বিনাযুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী না দেওয়া। মণিপুরে মহাভারত পালারই রূপায়ণ চলছে।

আমি আমার পড়শিকে চিনি না। আমার পড়শিও আমায় চেনে না। আমার পড়শি রাজাবাজার-পার্কসার্কাসে থাকে, আমি তার জীবন, অভ্যাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানি না, জানতে চাই না। এই না চেনার ফলাফল খুব সরল। যারা বিভাজনের রাজনীতি হাতিয়ার করেই জীবিকা নির্বাহ করে, তারা সহজে আমাদের বুঝিয়ে দেয়, করোনা ছড়ায় মুসলিম সমাজ। রাওলাপিন্ডিকে রাজাবাজার বলে চালিয়ে দেওয়া যায় সহজেই। আমার গা গোলায়, আমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাই, অপরকে ঘেন্না করি, আমার মনের দখল নেয় স্থায়ী ঘৃণা। আমি ভাবি মুসলমান হেলমেট পরে না। বাচ্চা পয়দা করে এই দেশটা ছেয়ে ফেলতে চায়। ঘৃণার মন নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে এমন পড়শিকে দেখেও দেখি না। তার বিপদ আমার বিপদ নয়। ন্যূনতম অনুকম্পা, সহানুভূতির বোধ পড়শির প্রতি নেই আমার। পড়শি আমার পর। পর বলেই মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছিল, মণিপুর সংবাদপত্রের পাঁচের পাতায় কোণে জায়গা করে নিচ্ছিল কোনওমতে। মণিপুরের সাধারণ মানুষ, অনেকটা ওই অপরিচিত মুসলিমের মতো, আমার কেউ নন। মণিপুরের মেয়ে? আরওই কেউ নন। মণিপুরের মেয়েরা 'চিঙ্কি'। ওদের আমরা কালেভদ্রে দেখেছি, বিক্রমগড়ের দিকে থাকে, এক ফ্ল্যাটে ঠাসাঠাসি তিনজন। শুনেছি ওরা স্নান করে না, ওরা নোংরা থাকে, ওরা নেপালি অথবা মণিপুরি, ও সবই এক। ওরা আর যাই হোক আমার মতো নয়, আমার কেউ নয়। তবে হ্যাঁ, মণিপুর আমার দেশ। মণিপুর আমার দেশ কিন্তু ল্যাংটো হয়ে রাস্তায় ঘুরতে বাধ্য হওয়া মণিপুরের মেয়ে আমার সহনাগরিক না। ওদের ভালোমন্দে আমি আমার রবিবার মাটি করতে পারব না। পথে যে বিবস্ত্র, সে আমার কেউ না।

একটু ভেবে দেখা যাক। এমনটাই আমাদের মনের গড়ন নয়?

আমাদের মানে এই আমরা, যারা সভ্য সমাজের সুশীল নাগরিক, রাজনীতি সচেতন, ট্রেনে বাসে দেশকাল নিয়ে ভাবি, খবরের কাগজ পড়ি, ফেসবুকে চেনা নেতার পিতৃশ্রাদ্ধ করি, পরের দুঃখে, অচেনার মরণে আমাদের কিচ্ছু এসে যায়? বরং আমার দৃষ্টিসীমা যতদূর প্রসারিত তাতে আমি কোনও অপরকে দেখতে চাই না। দেখতে পাই না। আমিও দেখতে পাই না, আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীও পান না। তিনি সদাব্যস্ত। মার্কিন-ইজিপ্ট সফরের পাশে মণিপুরকে রাখা চলে নাকি! মন কি বাত-এ তুমি মণিপুর প্রত্যাশা করো! তুমি কি জানো না, নীরবতা আসলে সম্মতি, যা চলছে তা চলতে দেওয়া? প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনা প্রশ্নাতীত। ১৮০০ ঘণ্টা লাগলেও, ধ্যান একদিন তাঁর ভাঙেই। মণিপুর নিয়ে মৌনব্রত ভেঙে দু'চার কথা তিনি বলেন, একদিন, সহসা। অখণ্ড দেশের নিটোল ছবিটি সওদা করেই তাঁর দলের দিনানুদিন চলে। কিন্তু অপরের দেহ লজ্জায় যন্ত্রণায় শতখণ্ড হয়ে গেলে, বিবস্ত্র শরীর নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরলে দেশের অখণ্ড ছবিটা থেকে রক্ত ঝরে না, দেশভক্তির লেজ লজ্জায় গুটিয়ে যায় না। নির্বিকার থাকতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী জাতির অভিভাবক। তাঁরই মতো আমাদের সিংহভাগেরই মণিপুর নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

আরও পড়ুন- শোকের বিগ্রহ

অবশ্য মাথাব্যথার যে হবে, তার জন্যে মাথায় ধাক্কা দিতে হয়। মাথায় ধাক্কা দেয় দৃশ্য। শব্দ। অভিমত। এই কাজটা যুগে যুগেই করে মিডিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া। যার শক্তি আছে। ক্যামেরা আছে। লোকবল আছে। যে কোনও বিষয়ে পক্ষ বিপক্ষে মত নিয়ে, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে একই সঙ্গে জনমত গঠন ও সরকারি সিদ্ধান্ত প্রণয়নকে তরান্বিত করার ক্ষমতা আছে। মণিপুরের ক্ষেত্রেও তাই মিডিয়া এগিয়ে এলে, মনবদল হতো, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও আসত। কিন্তু এই চতুর্থ স্তম্ভ নামক সোনার পাথরবাটি মণিপুর নিয়ে প্রথম থেকে কিছুই বলেনি জোরালো ভাবে। কেন এই নীরবতা? কারণ ওই শুরুতে যা বলছি, মণিপুর আমার অপর, তার দুঃখ-কষ্ট, রণ-রক্তে টিআরপি নেই। অ্যাড্রিনালিন-ছুট নেই। বিজ্ঞাপন আনবে না এই যুদ্ধ। তাছাড়া মণিপুর বিজেপি শাসিত রাজ্য। মোডিয়া (মোদির ভৃত্যসম মিডিয়া) কী করে বলবে এক বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাঙ্গাদমনে ব্যর্থ হয়েছেন? মোডিয়া চালায় ইট বালি সিমেন্ট আপেল ব্যবসায়ী। তাকে প্রকল্প, সুবিধে পাইয়ে দেয় সরকার বাহাদুর। তার ট্যাক্সমুকুব হয়, সেজ করিডোরে জায়গা হয়, বিজ্ঞাপন জোটে সরকারের বদান্যতায়, বিনিময়ে তাকে সাভারকার জয়ন্তী পালন করতে হয়, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে যোগী আদিত্যনাথের ইন্টারভিউ করতে হয়। একদিকে হেলে থাকাই দস্তুর। সে কী করে বলবে দেশ জ্বলছে! অনুগত দাসানুদাস, নুন খাওয়া চাকর কী করে বলবে, রাজা তোর কাপড় কোথায়! হিন্দু মেইতেই-দের বিরুদ্ধে কলম ধরলে যদি হিন্দুত্ব নামক ভাবাবেগে আঘাত লাগে! চাকরি থাকবে? রাজা তোমায় রাখবেন?

মিডিয়া চায়নি তাই আমরা কেউ মণিপুর নিয়ে কিছু জানি না। মণিপুরের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এই একটা ব্যাপারে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তাঁরা জানে, তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। জতুগৃহ থেকে মাঝেমাঝে ফাঁক গলে দু'একটা গুজব বাইরে আসে। তাই দু'চারজন বলছে, কুকিরা পাহাড়ে গাঁজা উৎপাদন ও মায়ানমার থেকে অবৈধ মাদক সরবরাহ করে। এসব আটকাতে চায় বিজেপি সরকার। সেই কারণেই এত হিংসা। এই গোল গোল কথাকে শক্তিশালী করতে মোডিয়া কুকিদের জঙ্গি দাগিয়ে দিচ্ছে সুযোগ পেলেই। আমরা বিশ্বাস করছি। আমাদের ঘৃণা, আমাদের সমর্পণ আর উদাসীনতার উল্টোদিকে মণিপুর জ্বলে যাচ্ছে। জ্বলছে মণিপুরের মেয়েদের শরীর।

যে কোনও যুদ্ধে যেমন হয় আর কী। মহাভারত থেকেই হয়ে আসছে। যুধিষ্ঠির-দুর্যোধন লড়ছে, বাজি দ্রৌপদীর শরীর। কাশ্মীরে একজন মেয়েকে ধর্ষণের 'অধিকার' দু'পক্ষেরই আছে। পড়েছি, শুনেছি একবার বাড়ির পুরুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ধর্ষণ করে সেনা। আরেকবার তাকে ধর্ষণ করে জেলফেরত হতাশ জেহাদি। একদিনে পাঁচবার ধর্ষণ করা হয়েছে একজন মেয়েকে, এমন ঘটনাও ঘটেছে কাশ্মীরে। যে কোনও যুদ্ধে, রণ-রক্তে নারীশরীর ডবল মার্জিন। মণিপুরেও নিশ্চয়ই অন্যথা হবে না। ধর্ষণের 'অধিকার' হাতে তুলে নিচ্ছে প্রতিপক্ষকে সবক শেখাতে চাওয়া যোদ্ধারা। রাষ্ট্র চুপ। চুপ মানে সম্মতি। আর তাছাড়া, ধর্ষকের পরিণতি এমন কী আর! আমরা তো চর্মচক্ষে দেখছি, খোলামনে ঘুরছে বিলকিস বানোর ধর্ষকরা। আজাদি কা অমৃৎ মহোৎসবে তারাই সবচেয়ে আজাদ। চিনেপটকা ফাটল তাদের মুক্তিতে। বরং হেনস্থা হতে হলো, ধর্ষিতার পক্ষ নেওয়া সমাজকর্মীকে। এসব যারা দেখেছে, শুনেছে, তারা জেনে গেছে, ল্যাংটো করে রাস্তায় ঘোরানো, উপর্যুপরি ধর্ষণ-রাষ্ট্রকাঠামোতে কিছুই অসম্ভব নয়। হোক না ধর্ষিতার স্বামী রাষ্ট্রেরই নুন খাওয়া কর্মী। থাকুক না তার ঘরে সন্তান। শত্রুপক্ষের স্ত্রীকে ধর্ষণ না করে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া যাবে না। মহাভারতে এটাই নিয়ম।

আরও পড়ুন-পথ বেঁধে দিল…

মহাভারতে নিয়ম, বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী না দেওয়া। মণিপুরে মহাভারত পালারই রূপায়ণ চলছে। মণিপুরের মেইতেইরা সমতলের বাসিন্দা। স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, উন্নয়নের যাবতীয় আঙিনায় তাদের পয়লা অধিকার। অর্থনীতির যাবতীয় আবর্তন এই সমতলেই। দু'টি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ যাবৎকালের মণিপুরের সমস্ত মুখ্যমন্ত্রী মেইতেই। কিন্তু এই সমতল দশ শতাংশ। মেইতেইরা সংখ্যায় বেড়েছে, ক্ষমতায় বেড়েছে, জমির মালিকানা সম্প্রসারিত করতে পারেনি। এবার তাদের পাহাড়ে জমি চাই। কারণ তাদের দশ শতাংশ জমিতে ভাগ বসাচ্ছে রাজ্যের বাইরের লোক, এমনকী চাইলে পাহাড়নিবাসী জনজাতি- কুকি, মিজো নাগারাও এই জমি কিনতে পারে। কিন্তু আইন বলছে পাহাড়ে মেইতেইরা জমি কিনতে পারবে না। কারণ তারা বর্ণহিন্দু। তফসিলি নয়। পাহাড়ে জমি কিনতে চাই তফসিলি তকমা। হবে না, এ কথা সরকার তাদের বলবে না। কারণ এ কথা বললে হিন্দু ভাবাবেগের বেলুন ফেঁসে যেতে পারে। আর জল জঙ্গলের বাসিন্দা কুকিরা বলছে, সমস্ত ক্ষমতা তোমাদের, পাহাড় আমাদের। ওদিকে হাত বাড়িও না। কুকিরা বলছে মুখ্যমন্ত্রী নিজে মেইতেই, তাই পক্ষপাতদুষ্ট। কুকিরা বলছে আমাদের সকলে জঙ্গি বলে, অনুপ্রবেশকারী বলে। এটা আর মানব না। আলাদা রাজ্য দাও। এখান থেকেই যুদ্ধ। ধর্ষণ। অবিরাম রক্তপাত।

নীরব মোডিয়া চাইলেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত, বিবাদমান গোষ্ঠীর প্রধানদের মধ্যে সমঝোতাসূত্র খোঁজা যেত। মন্ত্রীদের মনে সমস্যার গুরুত্ব তুলে ধরা যেত। দশ বছর আগেও আমরা জানতাম এটাই মিডিয়ার কাজ। কিন্তু কেউ খুঁজে দেখাতে পারবে, বিজেপি অকিঞ্চিৎকর ভোটে জিতলে যেসব টিভি অ্যাঙ্কাররা কাছা খুলে নাচেন প্রকাশ্যে, তারা এই নিয়ে একটিও সান্ধ্য আলোচনা আয়োজন করেছেন?

তত্ত্ব বলছে (স্পাইরাল অফ সাইলেন্স), অপরের পক্ষে আজ যারা কথা বলছে, তারা সদা শঙ্কায় থাকে। সমাজবিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় (ফিয়ার অফ আইসোলেশন) তাদের ঘিরে রাখে। টার্গেট হওয়ার ভয়। এইভাবে অপরের স্বর চিরতরে হারিয়ে যায়। মণিপুরের জন্যে কলম ধরার, পথে নামার, কেউই তাই নেই। মণিপুর আমাদের মানসপট থেকে হারিয়ে যাক, এইটুকুই চাই। হারিয়ে যাবেও।

এই হারিয়ে যাওয়ার আগে দু'চার দিন একটু অস্বস্তি। লজ্জা করে। লজ্জা করে বাংলার বামপন্থীদের কথা ভাবলে। যে মায়ের বস্ত্র নেই, যে ভাইয়ের ভাত জোটেনি, তার জন্য ভাবার কথা তো বামপন্থীদেরই ছিল। খালেদ চৌধুরীরা তো তাইই করেছিলেন একদা! ছুটে গেছেন বন্যায়, দাঙ্গায়।

এখন এই কথা পড়েই কেউ পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, তুমি কী করলে? আমি ভিক্ষে করতে পারি। এ লেখা যারা পড়লেন তাদের কাছে করজোড়ে ভিক্ষে করতে পারি। আমার লেখার জন্যে আমি কোনও পারিশ্রমিক নিচ্ছি না। যারা পড়লেন তাদের মধ্যে কাউকে যদি ভাবাতে পারি তিনি আমার পারিশ্রমিক ধার্য করুন। সেই টাকাটা মণিপুরের মানুষের চেয়ে খারাপ ভাবে বাঁচা মানুষদের ভাত ডাল জোটানোর জন্য, ন্যূনতম ওষুধপথ্য জোগাড়ের জন্যে পাঠান। রাষ্ট্রের অপর, নুনছাল ওঠা মানুষ, মরতে মরতে একবেলা বাঁচুক। কথা দিচ্ছি, দ্রুত আমরা সব ভুলে যাব।

More Articles