নেই লেখা ছাপানোর বা গবেষণার টাকা, বৈষম্যের লড়াইয়ে তাও ময়দান ছাড়েননি মেঘনাদ সাহা

Meghnad Saha: প্রথমদিকে বুঝতে পারছিলেন না, কার কাছে কাজ করবেন। তাঁরই প্রাক্তন বন্ধু প্রেসিডেন্সি কলেজের আর এক প্রাক্তনী স্নেহময় দত্ত তাঁকে পরামর্শ দিলেন বিজ্ঞানী ফাউলারের সঙ্গে গবেষণা করতে।

দ্বিতীয় পর্ব

ইতিমধ্যে সত্যেন বসুও জার্মান শিখে ফেলেছেন। সেইসময় শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (অধুনা আই.আই.ই.এস.টি) বোটানি পড়াতেন জার্মান অধ্যাপক ব্রুল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বোটানির পরিবর্তে তিনি পড়াতে শুরু করলেন ফিজিক্স। তাঁর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে দুই তরুণ প্রতিভার। সেই সুবাদে বেশ কিছু জার্মান ভাষায় লেখা সাম্প্রতিক বই, পত্র পত্রিকার সাহায্য পেলেন দুই বন্ধু। আবার দেবেন্দ্রমোহন বসুও তখন জার্মানি থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসেন প্লাঙ্কের লেখা 'থার্মোডায়নামিক' এবং 'ওয়ারমেস্ট্রালন' বই দু'টি। প্লাঙ্কের লেখা বই দু'টি পেয়ে ডুবে গেলেন দুই তরুণ প্রতিভা। বিজ্ঞান কলেজের ছাত্ররা এবার আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বিষয়গুলোও জানতে শুরু করল তাঁদের থেকে।

স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াতে পড়াতে তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিত্য নতুন তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে থাকলেন মেঘনাদ । সেই সঙ্গে ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সব মূল গবেষণাপত্রগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজে হাত দিলেন দুই তরুণ বিজ্ঞানী। আর তাঁদের পরিশ্রমের সেই ফসল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেপে বের হলো ১৯১৯ সালে ‘প্রিন্সিপালস অব রিলেটিভিটি’ শিরোনামে। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন পরিসংখ্যান গণিতের আর এক দিকপাল প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ। বলাবাহুল্য, সারা বিশ্বে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এটাই সর্বপ্রথম জার্মান থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ, যা এখনও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। এই অনুবাদের সূত্রেই আইনস্টাইনের সঙ্গেও পরিচয় হয় তাঁদের।

ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব সম্পর্কিত মেঘনাদ সাহার কাজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে “অন ম্যাক্সওয়েলস স্ট্রেসেস” শিরোনামে। ওই বছরই তাঁর আলোর ব্যতিচার সম্পর্কিত গবেষণা প্রকাশিত হয় আমেরিকার বিখ্যাত ফিজিক্যাল রিভিউতে “অন দ্য লিমিট অব ইন্টারফেয়ারেন্স ইন দি ফ্যাব্‌রে-পেরট ইন্টারফেরোমিটার” শিরোনামে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ইলেকট্রনের গতি বিষয়ক লিয়েনার্ড-উইচার্ট (Lienard-Wiechert) বিভবের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় সেই কাজ। ওই বছরেই স্থিতিস্থাপকতা সম্পর্কিত নতুন কাজ প্রকাশ করেন সাহা, ‘অন আ নিউ থিওরম ইন ইলাস্টিসিটি’ শিরোনামে যেটি প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে। ওই একই সংখ্যায় আলোর চাপ সংক্রান্ত আরেকটি কাজ প্রকাশিত হয় সাহার। যার সহলেখক ছিলেন তাঁরই ছাত্র সুবোধ চক্রবর্তী।

আরও পড়ুন- নোবেলের জন্য চার বার মনোনয়ন! বাংলাতেই তবু জাতের লড়াইয়ে কোণঠাসা ছিলেন মেঘনাদ সাহা

এদিকে কলেজের দীর্ঘদিনের সাহপাঠী সত্যেন বোসের সঙ্গে নতুন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়েও কাজ শুরু করেছেন এর মধ্যে। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবাদপ্রতিম দুই প্রাক্তনীর প্রথম যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ‘অন দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব দ্য ফাইনাইট ভলিয়্যুম অব মলিকিউল্‌স অন দ্য নিউ ইকুয়েশান অব স্টেট’ নামে। ১৯১৭ ও ১৯১৮ এই দুই সালে প্রকাশিত সর্ব মোট ছয়টি পেপারের ভিত্তিতে ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস জমা দেন মেঘনাদ সাহা, কোনও পরিদর্শক ছাড়াই। তাঁর তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব ও বিকিরণের চাপ বিষয়ক কাজটি পর্যালোচনা করেন সেই সময়ের প্ৰখ্যাত তিন পদার্থবিদ রিচার্ডসন, ক্যাম্পবেল ও পোর্টার। উল্লেখ্য, পদার্থবিদ্যায় বহুল পরিচিত 'রিচার্ডসন দুসমান' সমীকরণের রিচার্ডসন, তার বছর দশেকের মাথায় ১৯২৮ সালে নোবেল পান। তাঁদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১৯ সালে মেঘনাদ সাহাকে 'ডক্টর অব সায়েন্স' প্রদান করে।

Meghnad Saha

১৯১৭ সাল থেকেই মেঘনাদ শক্তির বিকিরণের চাপ নিয়ে মৌলিক গবেষণা আরম্ভ করেছিলেন। সে বছরের শেষে ‘সিলেকটিভ রেডিয়েশান প্রেসার’ নামে বেশ বড়সড় একখানা গবেষণাপত্র অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে পাঠান প্রকাশের জন্য। মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে সৌর-পরমাণুর উপর বিকিরণের চাপ কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছিলেন সেখানে। কিন্ত পেপারটি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু দীর্ঘ হওয়ায় জার্নাল কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিল। তাঁরা বললেন ছাপানো সম্ভব, যদি লেখক প্রকাশের খরচ বহন করেন, সে প্রায় ১০০ ডলার! সে সময় মেঘনাদ সাহার পক্ষে এতগুলো টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। অগত্যা 'বিকিরণের চাপ সংক্রান্ত' সেই কাজ সেবারের মতো অপ্রকাশিত রয়ে গেল। এখনও অনেক তৃতীয় বিশ্বের গবেষক এই একই সমস্যার সম্মুখীন হন। এই ঘটনার প্রায় দু' দশক পরে ১৯৩৬ সাল নাগাদ মেঘনাদের সঙ্গে নিউইয়র্কে যখন ডঃ মর্গানের সাক্ষাৎ হয়, তখন ডঃ মর্গান তাঁকে ১৯১৭ সালের বিকিরণের চাপ সম্পর্কিত মেঘনাদ সাহার খসড়াটা দেখান। পেপারটি এতদিন বন্ধ খামেই পড়েছিল। ফলত বিকিরণের চাপের উপর সাহার এই তাত্ত্বিক কাজের কথা সকলের অগোচরে রয়ে গেল বেশ অনেক বছর। ১৯২১ সাল নাগাদ বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারে তাঁর এ বিষয়ক আরেকটি কাজ “দ্য স্টেশনারি এইচ এন্ড কে লাইন্স অব ক্যালসিয়াম ইন স্টেলার এটমস্ফিয়ার” শিরোনামে প্রকাশিত হলে তা তৎকালীন গবেষকদের নজর কাড়ে এবং এর উপর ভিত্তি করে অনেকেই নতুন নতুন কাজ শুরু করেন। যেকোনও ফলপ্রসু মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার সাফল্য এমনই।

কম বয়সে আগ্নেস ক্লার্কের সূর্য ও নক্ষত্রজগৎ নিয়ে লেখা দুটো বই পড়ে জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানের মায়ায় জড়িয়ে পড়েন মেঘনাদ। সেই সময় থেকেই নক্ষত্রের আবহাওয়া মণ্ডল ও তার রাসায়নিক গঠন, তাপমাত্রা, ঘনত্ব এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বিভাগে তাপগতিবিদ্যা ও বর্ণালী বিক্ষণের ক্লাস নেওয়ার সময় সেই চিন্তা আরও গভীর হয়। সেখান থেকেই তাপীয় আয়ননের ধারণা দানা বাঁধতে শুরু করে মেঘনাদের অন্দরে। ইতিমধ্যেই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী নার্নস্ট তাঁর তাপীয় তত্ত্ব প্রকাশ করে ফেলেছেন। আবার ১৯১৯ সালে নার্নস্টের এক ছাত্র এগার্ট এক গবেষণায় উচ্চ-তাপমাত্রার জন্য তারাদের অভ্যন্তরে যে অধিক আয়নন পরিলক্ষিত হয়, তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। মেঘনাদের চোখে সেই পেপারের কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। বিশেষত এগার্টের প্রস্তাবিত তাপীয় আয়নন ফর্মুলায় পরমাণুর আয়নন বিভব নির্ণয় বিষয়ক কোনও প্রচেষ্টা মেঘনাদের নজরে পড়েনি। তাই তিনি মনস্থির করলেন আয়নন বিভব সঠিকভাবে গণনা করবেন, যাতে যেকোনও তাপে ও চাপে যেকোনও পরমাণুর আয়নন নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায়। এ সম্পর্কিত চারটি পেপার ১৯১৯ সালের গোড়ার দিকে বিখ্যাত ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে পাঠালেন, যেগুলি পরের বছরই প্রকাশিত হয়। তাঁর বিখ্যাত তাপীয় আয়ননের সূত্র যা ‘সাহা থার্মাল আয়নাইজেশান ফর্মূলা’ নামে সেই সময়ে বিজ্ঞানমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেটি “আয়নাইজেশান ইন দ্য সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার” গবেষণাপত্রের অংশবিশেষ। বিভিন্ন নক্ষত্রের চারপাশে থাকা গ্যাসিও স্তরের কত শতাংশ নিস্তড়িৎ ও কত শতাংশ আয়নিত- তা সাহার এই তাপ আয়নন সূত্র থেকে নির্ণয় করা যায়। এমনকী নিখুঁতভাবে তাপমাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও এই সূত্র কাজে লাগে। এই সম্পর্কিত আর একটা কালজয়ী গবেষণা পত্র প্রকাশ হয় ১৯২১ সালে রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংসে "অন আ ফিজিক্যাল থিওরি অব স্টেলার স্পেকট্রা" শিরোনামে। তৎকালীন বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ এডিংটন সাহার এই তত্ত্বকে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশটি তত্ত্বের একটি বলে দাবি করেন। পরবর্তী কালে ১৯৫৩ সালে কলকাতায় এসে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অটো স্ট্রোভ মন্তব্য করেছিলেন, মেঘনাদ সাহার এই সূত্র নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণে শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার। মেঘনাদ সাহার জগৎ বিখ্যাত এই কাজ বুঝতে গেলে আমাদেরকে কোনও পরমাণুর আয়নন বিভব কী, তা বুঝতে হবে।

প্রকৃতির সমস্ত পদার্থের কাঁচামাল আসে ৯২টি বিভিন্ন প্রকারের পরমাণু থেকে। আর বাকি ১৪ টি পরমাণু গবেষণাগারে তৈরি করা সম্ভব। কোনও পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর তার কেন্দ্রে ছোট জায়গায় কেন্দ্রীভূত থাকে- যার নাম নিউক্লিয়াস। যাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে থাকে ঋণাত্মক আধান যুক্ত ইলেকট্রনগুলি। কেন্দ্রকের সব থেকে দূরতম কক্ষে যে ইলেকট্রনগুলি বন বন করে ঘুরতে থাকে, তাদেরকে কিছু শক্তির জোগান দিলে তারা কেন্দ্রের আরও দূরের অস্থায়ী কক্ষপথে যেতে পারে। এই সব কক্ষপথে কিছু সময়ের জন্য থেকে ইলেকট্রনটি যখন আগের স্থায়ী কক্ষপথে ফিরে আসে, তখন সে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে। দু'টি আলাদা পরমাণু থেকে বিকিরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও আলাদা আলাদা হয়। ফলে বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে সহজে বোঝা যাবে সেটি কোন পরমাণু থেকে এসছে। পরমাণুর কেন্দ্রকের সব থেকে দুরবর্তী স্থায়ী কক্ষের ইলেকট্রনকে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করা যায় তাহলে সেটি পরমাণুর বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। ফলত পরমাণুটি পরিণত হবে একটি ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট আয়নে। এই আয়ন তৈরিতে ন্যূনতম যে শক্তির দরকার হয় তারই পোশাকি নাম আয়নন বিভব। তারাগুলি মহাকাশের যে স্তর থেকে আলো বিকিরণ করে, সেখানকার তাপমাত্রা এতই বেশি থাকে যে বেশ কিছু পরমাণু আয়নে পরিণত হয়। একটা সময় এই আয়ন ও মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পায় যে তারা মিলিত হয়ে আবার অবিভক্ত পরমাণুটি তৈরি করে। চাপ ধ্রুবক থাকাকালীন যে নির্দিষ্ট তাপে পরমাণুর ভাঙন ও গঠনের হার সমান হয় তাকে বলে আয়নন তাপ। তারাদের বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে এই তাপের মান বার করা যায়। গবেষণাগারে নির্ণীত আয়নন বিভব ও ক্যালসিয়াম আয়নের বর্ণালী থেকে সূর্যের বাইরের স্তরের তপমাত্রার পরিমাপ করেন সাহা। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জগতে এটি একটি অন্যতম প্রধান ও মৌলিক আবিষ্কার।

১৯১৯ সালে 'অন দ্য হাভার্ড ক্ল্যাসিফিকেশন অব স্টেলার স্পেকট্রা' নামক প্রবন্ধের জন্য মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি লাভ করেন। ওই বছরই ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ’ বৃত্তি পেয়ে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে যান গবেষণার জন্য। সেখানে গিয়ে আলাপ হয় আর এক ভারতীয় বিজ্ঞানী ভাটনাগরের সঙ্গে। প্রথমদিকে বুঝতে পারছিলেন না, কার কাছে কাজ করবেন। সেই সময় তাঁরই প্রাক্তন বন্ধু প্রেসিডেন্সি কলেজের আর এক প্রাক্তনী স্নেহময় দত্ত তাঁকে পরামর্শ দিলেন বিজ্ঞানী ফাউলারের সঙ্গে গবেষণা করতে। পৃথিবী বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ নরম্যান লক্‌ইয়ারের ছাত্র ফাউলার তখন আবার ছিলেন নেচার সাময়িকীর প্রথম সম্পাদক, পাশাপাশি তিনি তারাদের বর্ণালী নিয়ে কাজ করছিলেন সেই সময়। ফাউলার প্রথমে ভেবেছিলেন সাহা বুঝি পিএইচডি করতে এসছেন তাঁর কাছে। পরে যখন জানতে পারলেন তিনি এসছেন স্বল্প সময়ের জন্য তাও আবার নিজের গবেষণা যাচাই করতে, স্বাভাবিকভাবেই একটু বিরক্ত হলেন ফাওলার। যদিও কিছু দিনের ভেতরে ফিলোজফিক্যাল পত্রিকায় “আয়নাইজেশান ইন দ্য সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার” নামে সাহার এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ফাওলার মেঘনাদের মেধার নাগাল পান। তখন তিনি সাহাকে তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ব্যবহারেরও আমন্ত্রণ জানান। ফাওলারের সঙ্গে মাস পাঁচেক গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ। এই সময়কালে, সাহা স্পেকট্রোস্কোপি এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন আধুনিক গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হন। এরই ভিতরে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা আর এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জে জে থমসনকে সাহা অনুরোধ করেছিলেন কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবেরটরিতে তাঁর তত্ত্বের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতে। কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করার মতো যন্ত্র তাঁর গবেষণাগারে সেই সময় না থাকায় থমসন সাহাকে নার্নস্টের সঙ্গে কথা বলতে বললেন।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই জার্মানির প্রতি মেঘনাদের এক অমোঘ টান ছিল। হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় সাফল্যের জন্য। অগত্যা পরের গন্তব্য বার্লিন। বিজ্ঞানী নার্নস্টের তখন এমনিতেই খুব নামডাক। সে বছরই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন তিনি। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির পারাজয়ের কারণে লন্ডনের ছাত্রদের উপর নার্নস্ট একটু খাপ্পা। প্রথমদিকে লন্ডন থেকে আসা কোনও ছাত্রকেই তিনি তাঁর ল্যাবে ঢুকতে দিতে চাননি। কিন্তু ভারতে তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন চলছে। নার্নস্ট ভাবলেন সাম্রাজ্যবাদী এই ব্রিটিশদেরকে ভারতীয়রাই উচিত শিক্ষা দেবে। ফলত একটু খুশি মনেই তিনি সাহাকে তাঁর ল্যাবে কাজ করতে দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে, বার্লিনে থাকাকালীন মেঘনাদ সাহা জার্মান ভাষায় পেপার লেখেন, তা প্রকাশিত হয় তৎকালীন জার্মানির বিখ্যাত জার্নাল Zeitschrift fur Physik-এ । সেই সময় তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় হয় ম্যাক্স প্ল্যাংক, আর্নল্ড সামারফেল্ড ও আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো ভুবনজয়ী দিকপালদের। মজার ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও সাহার ব্যক্তিগত আলাপ হয় এই বার্লিনেই, সামারফেল্ডের মাধ্যমে। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমন্ত্রণ পেলেন দেশে ফিরে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার।

১৯২০ সালে ‘হিলিওফিলাস' ছদ্মনামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রিফিথ মেমোরিয়াল পুরস্কার পান মেঘনাদ। অধ্যাপক ডি. এম. বসু ছিলেন এই পুরস্কারের বিচারক। পুরস্কার হিসেবে মিলল এক হাজার টাকা। এদিকে বাংলার বাঘ আশুতোষ তখন আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ১৯১৯ সালে আশুতোষ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন খয়রার রাজা গুরুপ্রসাদ সিং ও রানি বাগেশ্বরী দেবীর ভিতরে দীর্ঘদিনের চলা মামলার নিষ্পত্তি হয়। রানি বাগেশ্বরী ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া ছয় লক্ষ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। স্যার আশুতোষ সেই টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদ তৈরি করেন। বার্লিনে থাকাকালীন আশুতোষ মেঘনাদ সাহাকে টেলিগ্রাম করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘খয়রা অধ্যাপক’ হিসাবে যোগদান করার জন্য। পরের বছর, ১৯২১ সালের নভেম্বরে কলকাতায় ফিরে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দেন মেঘনাদ। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতাই পাচ্ছিলেন না আশুতোষ। মেঘনাদের সতীর্থ সত্যেন বোস তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেঘনাদ তাঁর স্বপ্নের গবেষণাগার তৈরির কোনও আর্থিক সাহায্য জোগাড় করতে পারছেন না সরকারের থেকে। যদিও আড়াই লক্ষ টাকার একটা অনুদান ১৯২২ সালে পাওয়া গেল, সঙ্গে উপরি পাওনা হিসাবে যা বিধি নিষেধ বলবৎ হলো আশুতোষ আত্মমর্যাদার জলাঞ্জলি দিয়ে সে অর্থ কিছুতেই নেবেন না। মেঘনাদ পড়লেন ধর্মসংকটে। সেই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধান রমনের সঙ্গেও কিছু মতানৈক্য তাঁর আগে থেকেই ছিল। এই অস্বস্তিকর সময়ে তিনি পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ পান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রেসিডেন্সি কলেজের আর এক প্রাক্তনী ও তাঁর বন্ধু ডঃ নীলরতন ধর তখন এলাহাবাদে রসায়ন পড়াচ্ছেন। মূলত তাঁর টানেই কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েই পরের বছর যোগদান করলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাওয়ার আগে ব্যক্তিগত গাবেষণার খাতে কিছু বারাদ্দ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নিকট। যদিও সিন্ডিকেট তাতে সাড়া দেয়নি। অগত্যা...

আরও পড়ুন- পুরস্কারের লজ্জা! নোবেল পায়নি জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহাদের

এখানে যোগ দিয়ে মেঘনাদ বুঝলেন, এখানকার অবস্থা আরও শোচনীয়। গবেষণার সুযোগ, ফান্ড বিশেষ কিছুই নেই, উপরন্তু শতাধিক ছাত্রের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে। সঙ্গে আছেন একজন মাত্র সহযোগী অধ্যাপক, একজন প্রভাষক ও দু’জন প্রদর্শক। বিভাগের জন্য নতুন বই, পত্রপত্রিকা কেনার টাকা চাইতেই জুটছে তিরস্কার। একদম গোড়া থেকে শুরু করলেন মেঘনাদ। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের খোলনলচে বদলে ফেললেন পুরোপুরি।পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে তৎকালীন ভারতের যেকোনও নামী প্রতিষ্ঠানের স্তরে উন্নীত করেন তিনি। আর তারই ফসল এন কে সুর, পি কে কিচলু, ডি এস কোঠারি, আর সি মজুমদার, আত্মারাম, কে বি মাথুর, বি ডি নাগচৌধুরি, বি এন শ্রীবাস্তব প্রমুখরা। এঁরা প্রত্যেকেই ভবিষ্যতে দেশের পদার্থবিজ্ঞানের এক একটা স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন।

মেঘনাদ সাহা তাঁর তত্ত্বকে যাচাই করার জন্য শুধু দেশে নয়, আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন বিদেশেও। উইলসন অবজারভেটরির এইচ এন রাসেলের কাছে কিছু ফান্ডের জন্য অনুরোধ করেন ১৯২৪ সাল নাগাদ। যদিও অপরদিক থেকে কোনও সদুত্তর মেলেনি। পরের বছর ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে ফিজিক্স সেকশানের সভাপতি মনোনীত হন সাহা। বছর দুয়েক পর, ১৯২৭ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেলেন মেঘনাদ সাহা। তখন পরাধীন ভারতে রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তাও আবার মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে। এলাহাবাদের তদানীন্তন গভর্নর এ খবর পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সাহার গবেষণার জন্য বছরে পাঁচ হাজার টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করেন। ঘটনাক্রমে গভর্নর ছিলেন ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে রাদারফোর্ডের সহপাঠী। সাহার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমহলে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আরও উজ্জ্বল হলো। সেই বছরে এলাহাবাদ থেকে সাহা ও কলকাতা থেকে অধ্যাপক ডি. এম. বোস ইতালি সরকারের আমন্ত্রণে কোমো সম্মেলনে যোগ দেন। ফেরার পথে সাহা বার্লিন ও কোপেনহেগেনেও যান। সেখানে আলাপ হয় সাইক্লোট্রনের আবিষ্কারক লরেন্সের সঙ্গে।

১৯২৮ সালে বিদেশ থেকে ফিরে সাহা বর্ণালী বীক্ষণ যন্ত্র স্থাপনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। কলকাতায় তখন একই ধরনের কাজ করছিলেন সি ভি রমন। সে বছরের শেষের দিকে এলাহাবাদে সাহার কাজকর্ম দেখতে আসেন সামারফেল্ড। ১৯৩০ সালে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র নোবেল পুরষ্কারের জন্য সাহার মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অবশ্য সেই বছরেই ডি ব্রগলি, রাদারফোর্ড, উইলসন, বোরের মতো নোবেল জয়ী দিকপালরা মনোনয়ন দেন রমনকে। শেষমেশ ১৯৩০ সালে রমনের হাত ধরেই পরাধীন ভারতে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল আসে। এরপরে ১৯৩৭ এ কম্পটন, ১৯৩৯ এ আবার শিশিরকুমার মিত্র এবং ১৯৪০ এ আবারও কম্পটন সাহাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য। এরই মধ্যে ১৯৩১-এ সাহা তাঁর বিশেষ ছাত্র শ্রীবাস্তবের সঙ্গে সাম্মিলিত ভাবে প্রকাশ করলেন তাঁর কালজয়ী পাঠ্যবই ‘আ টেক্সট বুক অব হিট’। পরে আরও পরিমার্জন করে তা প্রকাশ হয় 'আ ট্রিটাইস অব হিট' নামে। বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন সদ্য নোবেলজয়ী রমন নিজে। দু'জনের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও রমন এই বইয়ের মুখবন্ধে সাহার ব্যাপক প্রশংসা করেন। বড়ই বিচিত্র সম্পর্ক ছিল এই দুই বিজ্ঞানীর। গবেষণার পাশাপাশি পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের জন্যে বিভিন্ন সংগঠন ও সায়েন্স জার্নাল প্রকাশে মনযোগী হন তিনি। তারই ফলস্বরূপ ১৯৩১ সালে এলাহাবাদে তিনি গঠন করলেন ইউনাইটেড প্রভিন্স আকাডেমি অব সায়েন্সেস। পরবর্তীতে যা নামাঙ্কিত হয় ন্যাশনাল আকাডেমি অব সায়েন্সে। ১৯৩২ সালের ১ মার্চ থেকে আকাডেমির কাজকর্ম শুরু হয়। অধ্যাপক সাহা হলেন আকাডেমির প্রথম সভাপতি।

 

তৃতীয় পর্ব আসছে...

 

More Articles