"চরকায় সুতো কেটে দেশের উন্নতি হবে না!" গান্ধীর সমালোচনাই কাল হয়েছিল মেঘনাদ সাহার?
Meghnad Saha: চরকায় সুতো কেটে যে ভারতের উন্নতি ঘটানো যাবে না তা মেঘনাদ প্রকাশ্যেই বলতেন। ফলে নেহেরুর সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়।
ন্যাশনাল আকাডেমি অব সায়েন্সের সভাপতি হওয়ার পরের বছর মেঘনাদ সাহা কলকাতায় তৈরি করেন ‘ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি’। সেখান থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’। তাঁরই উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস অব ইন্ডিয়া’। ১৯৩৪ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতির বক্তৃতায় সাহা জাতীয় পর্যায়ে সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে ১৯৩৫ সালে এই ইনস্টিটিউটের প্রথম অধিবেশন বসে। পরে অবশ্য এর নাম বদলে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আকাডেমি অব সায়েন্স’ করা হয়, এর সদর দপ্তরও চলে যায় দিল্লিতে। তিরিশের দশকের গোড়ার দিক থেকেই মেঘনাদ সাহা চাইছিলেন তাঁর পরিচিত শহর কলকাতায় ফিরে আসতে। ১৯৩২ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দ্য কাল্টিভেশান অব সায়েন্সে ‘মহেন্দ্রলাল সরকার অধ্যাপক’ পদ তৈরির এক তোড়জোড় চলছিল। মেঘনাদ সাহা সেই পদের বিষয়ে সিভি রমনকে চিঠি লেখেন। কিন্তু রমন পদটি মেঘনাদকে না দিয়ে অধ্যাপক কৃষ্ণণকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরের বছর রমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালিত প্রফেসর’ পদ ছেড়ে দিলে সেই পদে যোগ দেন অধ্যাপক ডি. এম বসু। সেবারের মতো মেঘনাদের আর কলকাতায় ফেরা হলো না। রমনও এদিকে কাল্টিভেশান ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রথম ভারতীয় পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের আরও কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান (ইসনা)’ গড়ে তোলেন পাশ্চাত্যের ‘নেচার’ ও ‘সায়েন্স’ সাময়িকীর আদলে। এই 'ইসনা' থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ পত্রিকা। শুধু প্রতিষ্ঠাই নয় আজীবন এই পত্রিকাতে লিখে গেছেন তিনি। নিউট্রন আবিষ্কারের পর থেকেই মেঘনাদ সাহা নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কৃত্রিম আইসোটোপ নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁরই ছাত্র দৌলতরাম সিং কোঠারির সঙ্গে সে বিষয়ে প্রায়শই আলোচনা করতেন তিনি। বিটা কণা বিকিরণ সংক্রান্ত কাজও অনেকটা এগিয়েছিল– যা পরবর্তীতে ফার্মি আবিষ্কার করে জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন।
১৯৩৬ সালে মেঘনাদ সাহা এক বছরের জন্য কার্নেগী ফেলোশিপ পান। এক বছরের জন্য তিনি বৈজ্ঞানিক ভ্রমণে বের হন। কোপেনহেগেনে নীল্স বোরের ইনস্টিটিউশনেও কিছুদিন কাজ করেন। সেখানেই মেঘনাদের সাক্ষাৎ হয় দেশের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের আর এক প্রবাদ প্রতিম জ্যোতিষ্ক হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার। ইউরোপ থেকে আমেরিকা যান মেঘনাদ দু’মাসের জন্য। কাজ করেন হার্ভার্ড অবজারভেটরিতে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি বার্কলেতে সাইক্লোট্রোন যন্ত্রের উদ্ভাবক লরেন্সের সঙ্গেও কাজ করেন কিছুদিন। ফেরার সময় তাঁর ছাত্র বি. ডি. নাগচৌধুরিকে লরেন্সের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করে আসেন মেঘনাদ।
আরও পড়ুন- নেই লেখা ছাপানোর বা গবেষণার টাকা, বৈষম্যের লড়াইয়ে তাও ময়দান ছাড়েননি মেঘনাদ সাহা
১৯৩৭ সালের নভেম্বরে স্যার জগদীশ বসুর মৃত্যুর পর ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’-এর দায়িত্ব এসে পড়ে অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসুর ঘাড়ে। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পালিত প্রফেসর’ পদটি খালি হয়। পরের বছর সেই পদে যোগ দেন অধ্যাপক মেঘনাদ। পনেরো বছর পর আবার কলকাতায় ফিরলেন তিনি। সেইসময় নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সম্ভাবনা দেখে তার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে মেঘনাদের এবং তিনিই প্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন। দেশের প্রথম সাইক্লোট্রন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে বিশ্বমানের গবেষণার জন্য একটি পৃথক ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন মেঘনাদ।
কলকাতায় ফিরে আসার পর বিজ্ঞানের পাশাপাশি রাজনীতিতেও কিছুটা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৩৮ সালে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে থাকতেই সুভাষের সঙ্গে পরিচয় ছিল মেঘনাদের। কলেজ স্ট্রিটের মেসেও আসা-যাওয়া ছিল সুভাষের। মেঘনাদ তাঁর ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ জার্নালে প্রবন্ধ লিখলেন 'ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি' গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে। নেতাজি মেঘনাদ সাহাকে অনুরোধ করলেন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করার জন্য। কাজ শুরুও করলেন মেঘনাদ সাহা। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও শিল্পপতিদের সঙ্গে ক্রমেই যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে মেঘনাদ সাহার। ১৯৩৯ সালে জাতীয় জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন মেঘনাদ। জওহর লাল নেহেরু তাঁকে সমর্থন করেন। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ও দুই সাব-কমিটির সভাপতি ছিলেন মেঘনাদ। ‘শিক্ষা’ এবং ‘জ্বালানি ও শক্তি’ উপকমিটির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক মেঘনাদ দেশের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা-ব্যবস্থা ও জ্বালানি-শক্তি সমস্যা সমাধানের বিস্তারিত পরিকল্পনা জাতীয় কমিটিতে পেশ করেন। নৌ পরিবহন ও সেচ-প্রকল্পের উপ-কমিটিরও সদস্য ছিলেন মেঘনাদ সাহা। সেচ প্রকল্পের কমিটির সদস্য হিসেবে মেঘনাদ সাহা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী শাসনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর জোর দেন। আমেরিকার টেনেসি নদীর জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মতো করে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশান গঠন করার জন্য মেঘনাদের প্রস্তাব ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে গৃহীত হয়।
কংগ্রেসে সুভাষ চন্দ্র ও নেহেরুর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ না থাকলেও পদ্ধতিগত বিরোধ ছিল। সুভাষ ছিলেন সরাসরি এবং দ্রুত ফল লাভের পক্ষে, আর নেহেরুর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল অনেক বেশি গান্ধী প্রভাবিত-নরমপন্থার। মেঘনাদ সাহা তো এমন রাজনৈতিক আচার-ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তিনি রেখে ঢেকে কথা বলতে জানতেন না। যা বলার সরাসরি মুখের উপর বলে দিতেন। গান্ধীর যে নীতি কংগ্রেস মেনে চলত– যেমন বিদেশি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে দেশিয় চরকায় সুতো কেটে খদ্দর তৈরি করা– এগুলোর প্রশংসা করে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখা মেঘনাদের পক্ষে কখনই সম্ভব হয়নি। তিনি স্যুট-কোট পরাকে অন্যায় মনে করেননি কখনই। চরকায় সুতো কেটে যে ভারতের উন্নতি ঘটানো যাবে না তা তিনি প্রকাশ্যেই বলতেন। ফলে নেহেরু সহ আরও অনেক কংগ্রেসী নেতার সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়।
এমনকী বৃহৎ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপের জন্য কংগ্রেসের ধীর নীতির সমালোচনা করে প্রবন্ধও লেখেন মেঘনাদ। এই সময় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবাও ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়নের পরিকল্পনা নিয়ে নেহেরুর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নেহেরু ভাবাকেই মেঘনাদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবুও নেহেরু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য এবং সাইক্লোট্রন স্থাপন করার জন্য মেঘনাদ সাহাকে টাটা ও বিড়লা গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেন।
এদিকে অধ্যাপক লরেঞ্জের কাছ থেকে মেঘনাদ সাহার ছাত্র বি. ডি. নাগচৌধুরি সাইক্লোট্রনের কাজ শিখে এসেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইক্লোট্রন প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। তখন উপচার্যের আসনে আশুতোষ পুত্র শ্যামাপ্রসাদ। তিনি সাইক্লোট্রন স্থাপনের জন্য দোতলা ভবন তৈরি করে দিলেন। নেহেরুর সুপারিশে টাটা গোষ্ঠীর কাছ থেকে ষাট হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছে। বিড়লা গোষ্ঠীও প্রায় সমপরিমাণ অনুদান দিয়েছে। কিন্তু সাইক্লোট্রনের যন্ত্রপাতির যা দাম তাতে এই টাকা খুবই সামান্য। তবুও কাজ থেমে থাকল না। কলকাতায় স্থাপিত হলো ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন। এবং একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলো মেঘনাদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ শ্যামাপ্রসাদ এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর দু’বছর পর ১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি এই ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী মেরী কুরির কন্যা আইরিন কুরি। অধ্যাপক মেঘনাদই আমৃত্যু পরিচালক ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের। তাঁর মৃত্যুর পর এটি পরিচিত হয় ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স' নামে।
আরও পড়ুন- নোবেলের জন্য চার বার মনোনয়ন! বাংলাতেই তবু জাতের লড়াইয়ে কোণঠাসা ছিলেন মেঘনাদ সাহা
১৯৪৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন মেঘনাদ সাহা। একই বছর কাল্টিভেশান সেন্টারের দায়িত্বও নেন তিনি। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত আকাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনীতি দেখে মুগ্ধ হন তিনি। সোভিয়েত মডেলকেই তাঁর শ্রেষ্ঠ মডেল বলে মনে হয়। ১৯৪৭ সালে সোভিয়েত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন তাঁর প্রথম ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘মাই এক্সপেরিয়েন্স ইন সোভিয়েত রাশিয়া’।
১৯৪৬ সালের ১০ মে অ্যাটমিক রিসার্চ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় হোমি ভাবার সভাপতিত্বে। সিদ্ধান্ত হয়, ভারত সরকার পারমাণবিক গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে এবং এই সংক্রান্ত সব কাজ ও গবেষণা নিয়ন্ত্রিত হবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা চেয়েছিলেন তাঁর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউটই হবে সেই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেখা গেল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে হোমি ভাবার প্রতিষ্ঠিত বোম্বের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-কেই ঠিক করা হয়েছে। ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন মেঘনাদ, বিরোধিতা করলেন। কিন্তু কোনও কাজ হলো না।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দেখা গেল, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী কোনও কমিটিতেই মেঘনাদ সাহাকে রাখা হয়নি। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। স্বাধীনতার পর হাজার হাজার শরণার্থীর পুনর্বাসনের জন্য তিনি ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ গঠন করলেন। ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচারে’ সরকারের কাজের আলোচনা ও সমালোচনা চলতেই থাকল। হোমি ভাবাকে সভাপতি করে যখন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন গঠন করা হলো, মেঘনাদ তার তীব্র বিরোধিতা করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন, দেশে প্রয়োজনীয় পরমাণু-জনশক্তির অভাব যেরকম রয়েছে, তেমনই এখনও কোন সুষ্ঠু শিল্পনীতি গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় পরমাণু শক্তি কমিশন গড়ে তোলার কোনও দরকার নেই। এইসব মতবিরোধের কারণে ক্রমাগত একঘরে হয়ে পড়েন মেঘনাদ।
আরও পড়ুন- নিচু জাতের বলে বারবার অপমানিত! নিজের কাজেই নিজের পরিচয় গড়েছিলেন মেঘনাদ সাহা
মেঘনাদ টের পান তাঁর চিন্তাভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে আইনপ্রণয়ন ক্ষমতার অংশীদার হতে হবে। তাই ১৯৫১ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ওই বছরই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার নির্বাচনে দাঁড়ালেন। কংগ্রেসের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা আসনে লোকসভার সদস্য হলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। ১০টা - ৫টা পড়ানো থেকে লম্বা বিরতি নিলেন এতদিনে। চোখে তখন দেদার স্বপ্ন। লোকসভায় যোগদান করেই তিনি শিক্ষার উৎকর্ষ বৃদ্ধি, শিল্প-নীতি, নদী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের পারমাণবিক শক্তির বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ সংক্রান্ত নীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন।
১৯৫২ সালে ভারত সরকারের সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ কাউন্সিলের অধীনে পরিচালিত দিনপঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মেঘনাদ সাহা। সারা ভারতে তিরিশ রকমের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল সেই সময়। বিভিন্ন ধর্মের, সংস্কৃতির এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন ছিল এই দিনপঞ্জিকাগুলিতে। এগুলিকে বিচার বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে প্রমিত দিন-পঞ্জিকা তৈরি করার দুরূহ কাজ সফল ভাবে সম্পাদনা করেছিলেন মেঘনাদ ও তাঁর কমিটি।
সরকারের যে কোনও ভুল সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে সায়েন্স ও্যান্ড কালচারে মেঘনাদের প্রবন্ধ প্রকাশ তখনও অব্যাহত। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই সমালোচনায় স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা খুশি ছিলেন না। শুধু সমালোচনাতেই থেমে থাকেননি মেঘনাদ। নেহেরুকে ব্যক্তিগত ভাবেও চিঠি লিখেছেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে। এত বড় বিশ্বমানের এক বিজ্ঞানীর রাজনীতিতে আসাকে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা ভালো চোখে নেননি। কেবল নেহেরুই নয়, কৃষ্ণণের মতো দার্শনিকও বিশ্বাস করতেন, মেঘনাদ সাহার রাজনীতিতে আসা আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য ক্ষতিকর। যদিও মেঘনাদ বারবার বলেছেন, আইন প্রণয়নের বলে বলীয়ান না হলে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসার একরকম অসম্ভব।
একদিকে বিজ্ঞান প্রসার, অন্যদিকে ব্যস্ত সাংসদ, সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালনা- এতগুলো দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে জীবনের শেষ কয়েকটা বসন্ত নিমেষেই বিদায় নিয়েছিল তাঁর জীবন থেকে। অনেক দিন থেকেই তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। তারপরেও শরীরকে বিন্দুমাত্র বিশ্রাম দেননি কখনও। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে প্ল্যানিং কমিটির অফিসে যাওয়ার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ বছর বয়সেই চলে যান মেঘনাদ সাহা। আধুনিক জ্যোতিপদার্থ বিদ্যার উজ্জ্বলতম এক জ্যোতিষ্ক খসে পড়ে, হঠাৎ করেই!
পর্ব শেষ
সমস্ত-পর্বের জন্যে ঋণস্বীকার :
1. শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ
2. অত্রি বন্ধপাধ্যায়, অবিনাশ মেঘনাদ সাহা, অনুষ্টুপ
3. গবেষণা পত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যসূত্র আন্তর্জাল ও উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে
4. মেঘনাদ সাহা, জীবন ও সাধনা -সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র, ১৯৮৮: শ্রীভূমি পাবলিশিং কো.