১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে পিষে মেরেছিল ট্রেন, রুটির টুকরোরা আজও জ্যান্ত

Migrant Labors Run Over By Goods Train: করোনার বিভীষিকা নয়, পণ্যবাহী ট্রেনের ধাক্কা নড়বড়ে করে দিয়েছিল সারা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এমন অনেক পরিবারকেই।

ভারতবর্ষে দুইখানি বস্তুই সুলভ। শ্রমিক ও শৌচালয়। দু'টিই প্রয়োজনীয়, তাই দুইয়েরই চাহিদা বিপুল। সুলভ শ্রমিকরা পথে হাঁটে, গাছতলায় জিরোয়, গনগনে আঁচে নিজেদের সেঁকে, আর রাত হলে সেঁকা রুটি নিয়ে বসে পড়ে ভারতবর্ষের সুলভতম পরিবহনের পথে। ভারতীয় রেলপথে ভারতের শ্রমিকদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে থাকে। রুটির গায়ে রক্তের ছিটে, কুচো মাংসের টুকরো। পণ্যবাহী ট্রেন এসে ভারতবর্ষের শিরদাঁড়া চেপ্টে চলে যায়। ১৬ জন মরে যায়, মরে যায় কেবল সুলভ পরিযায়ী শ্রমিকের পরিচয় নিয়ে। কোভিডের ভীতির মাঝে এই ট্রেন দুর্ঘটনা ক্ষণস্থায়ী বুদবুদ তোলে, ঢেউ তোলে না তেমন। ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু সাধারণ, পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু আরও সাধারণ। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালগাড়ির ধাক্কায় এত এত মানুষের চলে যাওয়া ফের রেললাইনের রুটির টুকরোর ছবি ভাসিয়ে তোলে। সে ভেসেই যায়, ঢেউ কি তোলে?

ঠিক ৩ বছর আগে। মে মাসের গা জ্বালানো গরম। দেশজুড়ে লকডাউন। করোনাভাইরাস ঠেকাতে মানুষের পাশ থেকে মানুষকে সরে যেতে বলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। স্রেফ ফিজিক্যাল নয়, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং দরকার রোগ ঠেকাতে। তাই সমাজ রোগ ঠেকাতে, আপন গৃহে সেঁধিয়ে গেল। যাদের নির্দিষ্ট গৃহই নেই, যারা পরিযায়ী, তারা হাঁটতে শুরু করল। পরিবহন নেই, খাবার নেই, অর্থ নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই, প্রাণের ভরসা নেই। তবু বাড়ি ফেরার টান আছে, যে টানে মানুষ হেঁটে পাহাড় ডিঙোতে পারে, সাগর সাঁতরাতে পারে। মাঝেমধ্যে শরীর বিশ্রাম চাইলে, আকাশের নীচে জমি আছে, গাছ আছে, পরিত্যক্ত বাসস্টপ আছে, সরকারের রেললাইন আছে। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় এই রেললাইনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকরা। পণ্যবাহী ট্রেনের ধাক্কায় তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হয় না। ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিক নিহত হন।

আরও পড়ুন- অঘটনের শুরুয়াত, দেশ বিদেশের প্রথম রেল দুর্ঘটনার ইতিবৃত্ত

সারা দিনের হাঁটা, যাবেন একরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। দেহ অবসন্ন। পেটে রুটি পড়লে চোখ বুঁজে আসে, শব্দ ক্ষীণ। প্রায় ২০ জন সুলভ পরিযায়ী শ্রমিক ২০২০ সালের ৭ মে মহারাষ্ট্রের জালনা ছেড়ে প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দূরে ভুসাওয়ালের দিকে রওনা দিয়েছিলেন, হেঁটে। এই ভুসাওয়াল থেকে আরও ৮৫০ কিলোমিটার দূরে মধ্যপ্রদেশের উমারিয়া এবং শাহদোলে তাদের ভিটেমাটি। ভেবেছিলেন ভুসাওয়াল থেকে 'শ্রমিক স্পেশ্যাল' ট্রেনে চড়ে পড়বেন। একবার বাড়ি ফিরতে পারলে, কিছু না কিছু বন্দোবস্ত তো হয়েই যাবে বাঁচার।

প্রায় ৪০ কিলোমিটার হাঁটার পরে, এই শ্রমিকরা বিশ্রামের জন্য কারনাড এবং বদনাপুর রেল স্টেশনের মধ্যে রেললাইনের উপরেই বসে পড়েন। চোখে দেশের ক্লান্তি নেমে আসে। ভোর ৫.১৫ নাগাদ ধেয়ে আসে মালগাড়ি। ১৪ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান, আরও দু'জন পরে হাসপাতালে মারা যান। রেললাইন থেকে খানিক দূরে ঘুমোচ্ছিলেন যে তিন শ্রমিক, কেবল বেঁচে যান তারা। জালনার একটি ইস্পাত কারখানায় কর্মরত ছিলেন এই শ্রমিকরা। দেশ কোভিড কাটিয়ে উঠল, কিন্তু এই শ্রমিকদের আর বাড়ি ফেরা হলো না কোনওদিনই।

পণ্যবাহী ওই খালি ট্রেনটি হায়দরাবাদের কাছে চের্লাপল্লী স্টেশন থেকে নাসিকের মনমাড়ের কাছে পানওয়াড়ি স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। মোটরম্যান নাকি বেশ কয়েকবার হর্ন বাজিয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু হঠাৎ করে দ্রুতগামী ট্রেনের গতি কমাতে পারেননি। ট্রেন একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়া মুহূর্তে ওই তিনজন শ্রমিকও চিৎকার করে নিজের সহকর্মীদের জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। অবসন্ন দেহ ট্রেনের কম্পন, শব্দ, সহকর্মীদের সতর্কতাবাণী কিছুই টের পায়নি। দ্রুতগামী চাকার তলায় টুকরো হয়ে যায় ভারতের পরিযায়ী ১৬ জন শ্রমিক।

আরও পড়ুন- ৫ মাসের শিশুর লাশ ব্যাগে ঝুলিয়ে ফিরছে বাবা! বাংলায় পরিযায়ী শ্রমিকরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে

বেঁচে যাওয়া তিন শ্রমিকের একজন জানিয়েছিলেন, একজন ঠিকাদার ইস্পাত কারখানাতে তাঁদের চাকরি জুটিয়ে দেন। প্রাপ্য মজুরি চাইতে গেলে সরাসরি না করে দেয় সে। ৭ মে মজুরি না পাওয়ার পরেই এই শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বেতন দেওয়া হয়নি তাঁদের। বিশেষ ট্রেনের পাস পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তারা কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও সাহায্য মেলেনি। তবে এই সুলভ পরিযায়ী শ্রমিকদের শেষকৃত্যের দায়িত্ব নিয়েছিল মধ্যপ্রদেশ সরকার। নিহতদের প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। লকডাউন একসময় শেষ হয়, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ শিথিল হয়ে আসে। পরিবারও একসময় প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার শোক বালিশ চাপা দেয়। শ্রমিকদের মৃত্যু, রেললাইনের রুটি হয়ে এই বিশ্বের অর্বুদ নির্বুদ আন্তর্জালিক চিত্রসমাহারে তলিয়ে যায়, তলিয়ে যায়, ঢেউ তোলে না কেবল।

করোনার বিভীষিকা নয়, পণ্যবাহী ট্রেনের ধাক্কা নড়বড়ে করে দিয়েছিল সারা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এমন অনেক পরিবারকেই। দেশ অবশ্য কর্তব্য পালন করেছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্যয় এড়াতে কী কী করা উচিত এই নিয়ে বৈঠক করেছে। রেলওয়ে নিরাপত্তা কমিশন, যা কিনা সমস্ত গুরুতর রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করে, তারা জানিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিক বা অন্যান্য ব্যক্তিদের এই রেললাইন ধরে হাঁটার ঘটনা নজরে এসেছে, মৃত্যু বা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রেল মন্ত্রক ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেয়। রেলওয়ে নিরাপত্তার প্রধান কমিশনার রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে সতর্কতার আহ্বান জানান। আর রাষ্ট্র ভুলে যায় এই মৃতদের পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণের টাকা ফুরিয়ে এল কিনা, রাষ্ট্র ভুলে যায় মৃত শ্রমিকদের পরিবারে আরও কেউ মারা গেল কিনা। রাষ্ট্র কীটনাশক জল ছিটিয়ে দেয় সুলভ শ্রমিকদের উপর, তাঁদের ঘামের গন্ধের উপর, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার উপর। ভারতবর্ষে ঠিক কত পরিযায়ী শ্রমিক আছে, কেন এই শ্রমিকদের অন্য রাজ্যে কাজ খুঁজতে যেতে হয়, এই তথ্যও থাকে না দেশের কাছে। তবে মানুষ অকাতরে মরে। দুর্ঘটনা নামে আমরা তাকে ডেকে থাকি। রেলপথে যাত্রী ও মাল নিয়ে ছুটে যায় ট্রেন, উল্টে যায় ট্রেন, শয়ে শয়ে লাশ ডিঙিয়ে সাংবাদিকরা ছুটে যান দুর্ধর্ষ খবরের খোঁজে। সোশ্যাল মিডিয়া চোখের জল ফেলে। সরকার লাশ গোনে, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কষে।

এসব তো বড় বড় দেশে হয়েই থাকে। আর ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, রুটির ছড়িয়ে পড়া? ছোট ছোট মানুষদের সঙ্গে অমন হয়েই থাকে।

More Articles