রক্তের বদলে শরীরে দুধ! উনিশ শতকের যে পরীক্ষা ছিল শিউরে ওঠার মতো

Substitute of Blood: রক্তের বিকল্প হিসেবে শরীরে চালানো হয়েছিল দুধ! সফল হয় কি সেই পরীক্ষা?

কথায় বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না! সে কথা একশো শতাংশ খাঁটি। তবে যদি বলি রক্তের বিকল্প দুধ, বিশ্বাস করবেন? চিকিৎসক বা বিজ্ঞানের ছাত্ররা এমন শব্দ শুনে রে রে করে তেড়ে আসতে পারেন। কেন না এতদিনে এটুকু তো আমরা জেনেই গিয়েছি, যে রক্তের বিকল্প শুধুই রক্ত। মুমূর্ষ রোগীর শরীরে রক্তের ঘাটতি মেটাতে পারে শুধুমাত্র মানুষের রক্তই। কোনও কৃত্রিম উপায়ে বা বাইরে থেকে এই জিনিসটি তৈরি করার জো নেই। শুধু রক্ত দিলেই তো হল না, রক্তের রয়েছে চার-চারটি গ্রুপ। যে গ্রুপের রক্ত সে গ্রুপকে না দিলেই সমস্যা। আগে অবশ্য ও পজেটিভ গ্রুপের রক্তকে সর্বজনীন দাতা ও এবি পজিটিভ রক্তকে সর্বজনীন গ্রহীতা বলা হত। তবে আজকের দিনে আর সেই ঝুঁকিটুকুও নিতে চান চিকিৎসকেরা। যে গ্রুপের রক্ত সেই গ্রুপের রক্তের অধিকারী শরীরেই চালানো হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তা এমন কড়াকড়ি যে জিনিস নিয়ে, সেই রক্তের নাকি বিকল্প হিসেবে এককালে ধরে নেওয়া হয়েছিল দুধকে।

অবিশ্বাস্য হলেও এমন কাণ্ডই ঘটেছিল ১৮০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। একটা দীর্ঘ সময় ধরে রক্তের বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা কম হয়নি। একসময় ব্যার্থ হতে হতে হাল ছাডড়েন বিজ্ঞানীরা। দু-একটা পরীক্ষা অবশ্য সাফল্যের পথে হাঁটতে হাঁটতেও মুখ থুবড়ে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষী, ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ এবং ওই সময়ে নাকি এশিয়াটিক কলেরা সারানোর ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে পাঠানো হত দুধ।

আরও পড়ুন: জ্যান্ত বিড়াল হল টেলিফোন, ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম পরীক্ষার জন্য বিখ্যাত যে দুই বিজ্ঞানী

দুধ না খেলে যে ভালো ছেলে হওয়া যায় না, সে ব্যাখ্যা না হয় বোঝা গেল। তাই বলে রক্তে-দুধে মিশে সেসময় রোগীদের শরীরে যে কী ঘণ্টটা পাকত, তা ভেবে শিউড়ে উঠতে হয়। আসলে সে সময় জনা কয়েক চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের ধারনা হয়েছিল, মানুষের রক্তের যে শ্বেতকণিকা, যা নাকি মানুষের রোগপ্রতিরোধ শক্তির নিয়ামক, সেই শ্বেতকণিকা ব্যাপারটিকে নতুন করে তৈরি করতে নাকি সাহায্য করে দুধ। দুধও সাদা, শ্বেতকণিকার নামেও সাদা। এই সব অঙ্ক মিলিয়েই কি দুয়ে দুয়ে চার করতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কে জানে! তবে দুধের এই দাওয়াই কোনও দিনই তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি চিকিৎসকমহলে। শিগগিরই চিকিৎসকেরা বন্ধ করেন এই ভয়ঙ্কর চিকিৎসা পদ্ধতি।

Milk was used as a blood substitute for transfusions in 19th century

এমনকী রক্তের বিকল্প হিসেবে স্যালাইন ওয়াটার চালানোরও চেষ্টা হয়েছে। বাদ যায়নি বিয়ার, মূত্র, এমনকী গাছের রসও। সব কিছুই কখনও না কখনও রক্ত হিসেবে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। এবং প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সেসব পরীক্ষা। স্যালাইন ওয়াটারের বিকল্পটি প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল ব্যাঙের উপরে। খানিকটা সফলও হয় তা। শরীরে স্যালাইন নিয়ে বেশ খানিকটা সময় বেঁচে ছিল ব্য়াঙগুলো। তবে পরে জানা যায়, সেই ফল ছিল বেশ বিভ্রান্তিকর। কারণ ব্যাঙেরা নাকি রক্তসঞ্চালন ছাড়াই বেশ কিছুটা সময় বেঁচে থাকতে পারে।

১৮০০-র দশকে হিমোগ্লোবিন ও প্রাণীর প্লাজমা দিয়ে মানুষের শরীরের রক্তের বিকল্প গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। তবে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। কারণ হিমোগ্লোবিনকে বড় অংশে বিচ্ছিন্ন করে কাজে লাগানো কঠিন। আর প্রাণীর প্লাজমায় এমন বহু উপাদান থাকে, যা বিষাক্ত। সেই বিষ অপসারণের কাজ সহজ নয়। ফলে সেই পরীক্ষাও মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্রমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেন কার্যকরী কৃত্রিম রক্ত তৈরির কাজ মোটেই সহজ নয়।

Milk was used as a blood substitute for transfusions in 19th century

১৮৮৩ সাল নাগাদ রিংগার দ্রবণ দিয়ে রক্তের প্রতিস্থাপক বের করার চেষ্টা করা হয়। কী সেই দ্রবণ? সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড এবং সোডিয়াম বাইকার্বনেট দ্বারা তৈরি ওই দ্রবণ। দেখা গিয়েছিল, সেই দ্রবণ ব্যবহার করে ব্যাঙের হৃদপিণ্ড সচল রাখা সম্ভব। এই আবিষ্কার ছিল একটি মাইল ফলক। কারণ রক্ত পাতলা রাখার কাজে এই উপাদানগুলি ব্যবহার করা হয় আজও। যাদের হৃদপিণ্ডের ধমনীতে ব্লকেজ থাকে, তাঁদের অনেককেই রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে। তবে এই রিংগার দ্রবণ যে রক্তের বিকল্প নয় কোনও মতেই তা বুঝতে দেরি হয়নি চিকিৎসকদের।

আরও পড়ুন:ওষুধ হিসেবে যাত্রা শুরু, যেভাবে বাড়ল টমেটো সসের রমরমা..

এর পরে ক্রমে রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার হয়, রক্ত কেন জমাট বাঁধে তার তত্ত্ব আবিষ্কার হয়। আর সেই সব সত্য হাতে উঠে আসা শুরু হতেই বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন মানবশরীরের রক্তের বিকল্প কেবলমাত্র রক্তই। কোনও ভাবে বাইরে থেকে কৃত্রিম কোনও কিছু দিয়েই সেই রক্তকে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব নয়। সেই জন্যই রক্তদানকে মহৎদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ যে অসুস্থ শরীরে রক্তের প্রয়োজন, তার অভাব পূরণ করতে পারে কেবল মাত্র দ্বিতীয় জনের রক্তই। বিভিন্ন দুর্ঘটনা তো বটেই, রক্তবাহিত বহু রোগের ক্ষেত্রেই রোগীদের নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারেন কেবল মানুষই। প্রতিবার গ্রীষ্মকাল পড়তেই রক্তের তীব্র সঙ্কট শুরু হতে থাকে। শীতকালে বিভিন্ন জায়গায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজনে ভরসা সেগুলোই। আর সে জন্যই গড়ে উঠেছিল ব্লাডব্যাঙ্কের ধারণা। পরবর্তীকালে ব্লাডব্যাঙ্কগুলি নিজেদের এতটাই ছড়িয়ে ফেলতে পেরেছিল যে রক্তের বিকল্প খোঁজার পরীক্ষা থেকে সরে আসে তাবড় চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী মহল।

More Articles