বাড়াবাড়ি করলেই এনআরসি, তাড়িয়ে দেব, ফুটবলে বলা যায়?

Mohun Bagan East Bengal Fight : দু'দল মিলিয়ে সেদিন মাঠে ছিলেন একজনমাত্র বাঙালি, শুভাশিস, এই ক্ষয়ের প্রতিকার কী?

আমি মোহনবাগান সমর্থক, ঘটি, অতএব প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ইস্টবেঙ্গল বিরোধী, বাঙাল বিরোধী। তাই আমার পক্ষে স্বাভাবিক যে আমি মোহনবাগানের যে কোনও দুষ্কর্মই নস্যাৎ করব, নিদেন আড়াল করব।

এইসব ধারণা সচরাচর ঠিকই হয়ে থাকে, কিন্তু আমার মোহনবাগান সমর্থক হওয়ার ইতিহাস একটু অন্যরকম। ঘটিবাড়িতে জন্ম, বাবা-মা-দাদা মোহনবাগান সমর্থক, তাই আমিও জন্মগতভাবেই মোহনবাগান সমর্থক হতে বাধ্য, এমনই হওয়ার কথা ছিল হয়তো, কিন্তু হয়নি। আমি ফুটবল খানিক বুঝতে শেখার পর প্রথমে ছিলাম ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, তারপর মহমেডান স্পোর্টিং সমর্থক, তারপর মোহনবাগান সমর্থক। অনেকটা বর্তমান কিছু রাজনৈতিক নেতার শিবির বদলের মতোই আমার প্রিয় ফুটবল ক্লাব বদলেছে বারবার। কেন? একটু বিচিত্র কারণে। আমি আসলে ফুটবল খেলাটা খানিক বুঝতে শেখার পর কোনও ক্লাবের সমর্থক ছিলাম না, এক ফুটবলারের সমর্থক ছিলাম।

মোহনবাগান জিতেছে ২০২৩ সেপ্টেম্বরের তিন তারিখে, আজ, এই লেখাটা যখন লিখছি, আজকের তারিখ সাত সেপ্টেম্বর। মাঝে কয়েকটা দিন চলে গেছে। অনেক গুজবের জন্ম ও মৃত্যু এর মাঝে হয়েছে। যেমন, ইস্টবেঙ্গলের দুই সমর্থক মারাত্মক আহত মোহনবাগান সমর্থকদের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে, একজন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। ভুল, মিথ্যে, বিপজ্জনক মিথ্যে। এরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। যে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক টুইট করে মূলত এটা রটিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন।

গুজব দুই, এক বাচ্চার রক্তমাখা মুখের ছবি পোস্ট করে প্রচার হয়েছিল যে মোহনবাগান সমর্থকরা মেরেছে, বাচ্চাটির আত্মীয়রা জানিয়েছেন ওটা মিথ্যে কথা, বাচ্চাটা বাড়িতে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে।

আরও পড়ুন- পূর্বপুরুষকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল যারা, তাদের হয়েই ফুটবল খেলত কৃষ্ণাঙ্গরা…

আমি জন্মেছি ১৯৭৩ সালে। সেই সময় কলকাতা ময়দান দাপাতেন এক জাদুকর ফুটবলার, সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান লিগের ছোটখাটো ম্যাচ খেলত যার যার নিজের মাঠে, আর তিন প্রধানের নিজেদের মধ্যে খেলা হতো ইডেন গার্ডেন্সে। যুবভারতী স্টেডিয়াম তখনও হয়নি। ১৯৭৯ সাল। আমার ছ'বছর বয়স। আমার ফুটবলপাগল বাবা আমাকে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখাতে নিয়ে গেলেন ইডেন গার্ডেন্সে। বাবা মোহনবাগান সমর্থক, আমি কাদার তাল, যে কেউ আমায় জিতে নিতে পারে, গড়ে নিতে পারে। তখনও 'মোহনবাগান-মহিমা' বুঝি না। খেলা শুরু হলো, আমাকে জিতে নিলেন, গড়ে নিলেন, কিনে নিলেন ওই জাদুকর, সুরজিৎ সেনগুপ্ত! কী অবিশ্বাস্য স্কিল! মাঠের আর কেউই তো এই লোকটার মতো খেলে না! আমি হয়ে গেলাম সুরজিৎ-সমর্থক, অটোমেটিক্যালি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক।

পরের বছর, ১৯৮০ সাল। সুরজিৎ চলে গেলেন মহমেডান স্পোর্টিংয়ে। অতঃপর নিরুপায় আমিও মহমেডান সমর্থক। ১৯৮১, সুরজিৎ এলেন মোহনবাগানে, সঙ্গে নিয়ে এলেন আমাকে। ১৯৮৩, সুরজিৎ সিরিয়াস ফুটবল থেকে অব্যাহতি নিলেন মোহনবাগানে থাকা অবস্থাতেই, আমাকে ফেলে গেলেন আমৃত্যু মোহনবাগান সমর্থক করে।

এরকম একটা বিচিত্র সমর্থকজীবনের জন্যই আমি খুব গোঁড়া সমর্থক আজও হয়তো হতে পারিনি। মোহনবাগান ছাড়া অন্য যে কোনও দলের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল বা মহমেডান খেললে, আমি নির্দ্বিধায় ওই দুই দলকেই সমর্থন করি। এত কিছু লিখে এটুকুই বোঝাতে চাইলাম যে আমার বিশেষ দায় নেই মোহনবাগান সমর্থকদের 'কুকীর্তি' ঢাকার।

তেসরা সেপ্টেম্বর, রবিবার কি কিছুই হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। মোহনবাগান সমর্থকরা একজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে রাস্তায় একা পেয়ে তাঁর গায়ের ক্লাব জার্সি টেনে ছিঁড়ে দিয়েছেন। জঘন্য আচরণ। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সামনাসামনি ও সামাজিক মাধ্যমে 'কাঁটাতার' 'রিফিউজি' 'উদ্বাস্তু' বলে গালাগাল দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত রেসিস্ট আচরণ। এই রেসিস্ট আচরণের সাফাই দেওয়া হয়েছে যে, এটা তো ওঁরাই ব্যাজ অফ অনার হিসেবে নিজেদের বলে থাকেন। একেবারেই কুযুক্তি। কেউ নিজের দলিত পরিচয়কে অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ব্যাজ অফ অনার হিসেবে তুলে ধরতে পারেন, কিন্তু তাতে আমার অধিকার জন্মায় না তাঁকে "এই দলিত! এই দলিত!" বলে আক্রমণ করার।

আরও পড়ুন- ৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…

আমাদের দেশে গত কিছু বছর ধরে এক অদ্ভুত জুজু দেখানো শুরু হয়েছে। এনআরসির জুজু। নিজের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে দেওয়ার জুজু। ফের, এই ফের শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ, ফের উৎখাত করে দেওয়ার জুজু। এই ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করছে রাষ্ট্র, খুব স্পষ্ট করে বললে একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল, বিজেপি। এই জুজুর লক্ষ্য একবার ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া পূর্ববঙ্গের মানুষজন। হতাশাজনক বিষয় হলো, আমরা, ঘটিরা, এই অত্যাচারিতদের সহনাগরিকেরা খুব ভালো করে জানি, চিনি, বুঝি, টের পাই, ওপার বাংলা থেকে বাধ্য হয়ে চলে আসা এই মানুষগুলোর ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অসহায়তা, ভীতি, শঙ্কা, বেদনার স্নায়ুগুলোকে। তাই আমরা অনায়াসে হাত রাখতে পারি সেখানে, যন্ত্রণা দিতে পারি, বলতে পারি, ফুটবল মাঠে বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু এনআরসি এনে তাড়িয়ে দেব তোদের। ভাবা যায়! এটা আদৌ বলা যায়! এই ভয় দেখানোর প্রতিবাদে এক অসাধারণ টিফো নিয়ে মাঠে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা, তাতে লেখা ছিল, "রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়!" এত অনবদ্য রাজনৈতিক টিফো সাম্প্রতিককালে আমার তো আর নজরে পড়েনি।

টিফো বলতে মনে পড়ল, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরাই কয়েক বছর আগে আরেকটা টিফো নিয়ে মাঠে এসেছিলেন। তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বড় স্পনসর আছে, মোহনবাগান ক্লাব স্পনসর পাচ্ছে না, ফুটবলারদের বেতন দিতে পারছে না। সর্বস্ব হারানোর বেদনা যাঁরা জানেন, সেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা সেসময় একটা টিফো নিয়ে মাঠে ঢুকলেন, তাতে লেখা, "ভিখারি মাচা"।

ফলে বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের বাতাবরণ এই দুই ক্লাবের মধ্যে বিরাজমান অনেক বছর ধরেই। কিন্তু গত তেসরা সেপ্টেম্বর বিশেষ কী এমন হলো যে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেল ছিছিক্কারে? উত্তর হলো, বিশেষ কিছুই হয়নি। বহু বছর ধরেই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে গ্যালারিতে ও মাঠের বাইরে গালিগালাজ চলে, সেগুলো কোনও সময়ের মাপকাঠিতেই শালীন ছিল না, (গালিগালাজ শালীন কবেই বা হয়!) এখনও নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই ফুটবল গুন্ডামি থেকে শুরু করে ফুটবল দাঙ্গা পর্যন্ত হয়, বেশ কিছু প্রাণহানির উদাহরণও আছে, সেখানে কলকাতা ময়দানে সেই ১৯৮০ সালের ১৬ অগাস্টের ভয়াবহ ঘটনার দিনটা বাদ দিলে ওরকম আর কিছু আজ পর্যন্ত কোনওদিন হয়নি।

আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার

তাহলে কী হয়েছে? মাঠের, গ্যালারির তীব্র বিদ্বেষ, গালিগালাজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে অসংখ্য মানুষ, যাঁরা মাঠে যান না, তাঁদের সামনে উঠে এসেছে। তাঁরা শিহরিত হয়েছেন, চমকিত হয়েছেন, স্ক্যান্ডালাইজড হয়েছেন যে এসব কী! এমনও হয়! এই কি সভ্য মানুষের আচরণ? তাঁদের মনে হয়েছে এগুলো বুঝি বা সমসময়ের অবদান। আসলে একটা প্রাইভেট সার্কাস, যা মুষ্টিমেয় মানুষ উপভোগ ও অংশগ্রহণ করতেন, তা পাবলিক হয়ে যাওয়াতেই একটা হায়-হায় রব উঠেছে। প্লিজ মেনে নিন, বাঙালি বরাবরই এরকম ছিল, এরকমই অশ্লীল, খিস্তিপ্রবণ, আক্রমণাত্মক, কলহপরায়ণ জাতি।

কিন্তু তেসরা সেপ্টেম্বর কি শুধুই এগুলোই হয়েছে। না। দু'দলের প্রায় সত্তর হাজার মানুষ মাঠে গেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই সুস্থ দেহে বাড়ি ফিরেছেন। কোনও দাঙ্গা হয়নি, প্রাণহানি হয়নি, অগ্নিসংযোগ হয়নি, ভাঙচুর হয়নি। এগুলো কোনও গর্বের বিষয় নয়, এগুলো ঘটাই অস্বাভাবিক ছিল, সেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি উভয় পক্ষের সিংহভাগ মানুষই শুভবোধসম্পন্ন বলে। এটা চিহ্নিত করে বিশেষভাবে উল্লেখ না করলে এঁদের অপমান করা হয়।

ফেসবুকেই পড়লাম, এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক লিখেছেন, মোহনবাগান সমর্থকরা তাঁকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছেন। তাঁর লেখাতেই পেলাম, খুব তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তাঁকে এক অপরিচিত মোহনবাগান সমর্থকই হাতের না খোলা জলের বোতল এগিয়ে দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা দুটোই। কোনটা নিয়ে তিনি ভবিষ্যতে পথ চলবেন, তিনিই জানেন।

বাঙালির ফুটবল নিয়ে আবেগ আছে, উন্মাদনা আছে, তার বহিঃপ্রকাশ দু'তরফেরই মৌখিক বাগযুদ্ধে, যা প্রায়শই শালীনতার সীমা ছাড়ায়, উভয়পক্ষেই। তা চিন্তার অবশ্যই, কিন্তু উত্তেজনার মুহূর্তে বা সামাজিক মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ওয়ান আপম্যানশিপের লোভে ওটা হয়ে যায়। আসল উদ্বেগের হলো, এই আবেগ-উন্মাদনার পজিটিভ প্রতিফলন মাঠে ঘটছে কি? দু'দল মিলিয়ে সেদিন মাঠে ছিলেন একজনমাত্র বাঙালি, শুভাশিস, এই ক্ষয়ের প্রতিকার কী?

More Articles