জাহাজে চেপে হাজির মশাল! কেন অলিম্পিকের আগুন এত গর্বের?

Olympic Games Paris 2024: ৯ মে থেকে মশালের রিলে শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের ৪০০ শহর ঘুরে, হাজার হাজার নামী মানুষের হাত হাতে আগুন গিয়ে পৌঁছবে প্যারিস।

৮ মে, বিজয় দিবসের ছুটি ফ্রান্সে। ১৯৪৫ সালে এইদিনে জয় ঘোষণা করে বিশ্বযুদ্ধে দাঁড়ি পড়ে৷ সচরাচর ছুটির দিনে দুপুরবেলায় এ তল্লাটে বেশি মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। এ বছর নিয়মের বাইরে। সকাল থেকে মার্সেই শহরের রাস্তায় তিলধারণের জায়গা নেই। বন্দর বরাবর নিত্যদিনের ঘরে ফেরার রাস্তায় ব্যারিকেড৷ পুলিশ বলছে, হয় পথ ঘুরে বাড়ি ফিরতে হবে, না হয় জাহাজ দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। সেই দিন ছিল উৎসবের দিন। এমন উৎসব যা ফ্রান্স এ যাবৎকালে বিশেষ দেখেনি।

বেলেম জাহাজ ভিড়েছে পুরনো বন্দরে। জাহাজে চেপে এসেছে ২০২৪ অলিম্পিকের মশাল। আগের ক'দিনের ঝড় বৃষ্টি কাটিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ ছিল। টারকোয়াজ রঙ ছিল ভূমধ্যসাগরের জলে। ২৭ এপ্রিল এথেন্সের পিরেউস বন্দর থেকে রওনা হয়ে ১২ দিনের জল পেরিয়ে, তিন-মাস্তুলে সফেদ পাল তুলে ৮ মে মার্সেই বন্দরে পৌঁছল এলেমদার জাহাজ বেলেম।

মার্সেই এই একদিনের প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়েছে বহুদিন ধরে। রূপ বদলে প্রাচীন বন্দর হয়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মঞ্চ। সংগঠকরা বিরল স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শহরবাসীকে। এখানে রঙের ফোয়ারা ছুটবে, উঠবে গানের হিল্লোল, এই আশায় মার্সেইয়ের রাস্তাঘাট উপচে পড়েছে। অনুমান, দু' লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল ছোট্ট বন্দরে। ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী এরা সকলে।

উত্তরকূল থেকে পরিক্রমা শুরু। সারাদিন ঘুরে দক্ষিণ কূলবৃন্ত ছুঁয়ে সন্ধে সাতটায় সে পৌঁছেছে শহরের প্রাচীনতম বন্দরের এক চিলতে ল্যাসিদঁ বে-তে। সারাদিন তার সঙ্গ দিয়েছে হাজারেরও বেশি ছোট বড় নৌকা-বজরা-ডিঙি। মার্সেই মানেই উত্তেজনা, মার্সেই মানেই বিস্ময়, মার্সেই মানেই ইতিহাস।

আরও পড়ুন- মানুষ মরে গেলে কবর দিতে হয়, কবে শিখল আদিম মানুষ?

ইওরোপে প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে অন্যতম জীবিত শহর বর্তমানের মার্সেই। যে ল্যাসিদঁ গলিপথে ২৬০০ বছর আগে গ্রিস থেকে এসে ফিনিশিয়ানরা এই মাটিতে বসবাস শুরু করে, বেলেমের যাত্রাপথ বাঁধা হয়েছে সেই ঐতিহাসিক ম্যাপ অনুযায়ী! ফরাসিরা গল্প ভালোবাসে, ফরাসিরা ভালোবাসে আলঙ্কারিক প্রয়োগ৷ 'অলিম্পিকের মশাল', সে নিজেই ইতিহাস, পুরাণ, উপকথার এক জ্যান্ত প্রতীক। গ্রিসের অলিম্পিয়া শহরে এই খেলার শুরু। খেলোয়াড়রা মশাল নিয়ে শহরবাসীকে জানাত, যুদ্ধ ছেড়ে এবার খেলায় ফেরা হোক। মশালের আগুন শান্তির দূত। বিশ্বাস ছিল, এই আগুন এসেছে ভগবানদের সমর্থনরূপে। যতদিন খেলা চলত, হেস্টিয়া দেবীর মন্দিরের সামনে অনির্বাণ জ্বলত অলিম্পিকের মশাল। আধুনিক সময়ে অলিম্পিকের আগুন জ্বালানো এবং তা এক দেশ থেকে পরের দেশে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরপম্পরা শুরু হয় ১৯২৮ সালে আমস্টার্ডামে। অলিম্পিকের আগুন ঘিরে এতরকম অভিনব গল্পের তালিকায় যোগ হলো ফিনিশিয়ানদের দেখানো জলপথে জাহাজ চেপে গ্রিস থেকে মার্সেই আসা আগুন নিয়ে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ।

বেলেমকে ঘিরে চলেছে নানা অনুষ্ঠান। জল-জাহাজের প্যারেড। উড়োজাহাজের খেলায় মেঘে মেঘে রঙের বাহার। স্থলে ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করছে প্যারিস ২০২৪-এর অফিশিয়াল থিম, লিখেছেন ভিক্তর ল্য মাসনে। শহরের বাসিন্দা হয়েও এতসব আয়োজনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস বা উপায় কোনওটাই আমার হয়নি। বন্দরের দু' পা দূরত্বে থাকার সুবাদে জানলা দিয়ে দেখেছি অলিম্পিকের চিহ্ন পাঁচ মহাদেশের মধ্যে নীল আর সবুজ বলয় এঁকে উড়ে যাছে এরোপ্লেন। ঠিক আমার বাড়ির আকাশে। শুনছি, আতসবাজির রমরমা, মানুষের উল্লাস। এসবের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে সারা শহর তোলপাড় করে গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত মার্সেইয়েজ।

পাশের গ্রাম অন্দুম থেকে এসেছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী এলিয়া, সঙ্গে বন্ধু ফস্তিন্। এলিয়া বলছে, "এমন দিনের সাক্ষী হয়ে থাকতেই হবে, আজ এখানে ইতিহাস রচনা হচ্ছে, এক জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা আর হবে না!" মেরিন বায়োলজির ছাত্র মাক্সিম বন্ধুর দল নিয়ে এসেছে উত্তরের শহর ব্রেস্ত থেকে। বলছে, "বেলেমের পরিক্রমার এক মুহূর্তও ছাড়া যাবে না, আমরা ওকে অনুসরণ করে সারাদিন ঘুরব, তারপর মশালটা দেখব! অলিম্পিকের আগুন, চোখ দিয়ে ছুঁতে পারলেও যেন ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা!"

একে বেলেম জাহাজ আসা নিয়েই এত উত্তেজনা, জাহাজ থেকে মশাল হাতে প্রথম কে ফরাসি মাটিতে পদার্পণ করবে, সেই নিয়েও জল্পনার শেষ নেই। জানা ছিল, প্রথম নামবেন ফ্লোরঁ মানোদু, ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের সাঁতার চ্যাম্পিয়ন। কথামতো হলোও তাই। উল্লাসের রোল উঠল বন্দর জুড়ে। মানোদু-র হাত থেকে মশাল এল দ্বিতীয় কিংবদন্তি নানতনাঁ কেইটার হাতে। প্যারাঅলিম্পিক অ্যাথলেট নানতনাঁ ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ৪০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান। মশাল হাতে হাঁটার পর আপ্লুত কেইটা মার্সেইবাসীকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, "প্যারিস-২০২৪ রিলে-র প্রথম মহিলা মশালবাহী হয়ে আমি গর্বিত। তার চেয়েও বড় পাওনা, প্যারাঅলিম্পিক অ্যাথলেট হিসেবে এই সম্মান পাওয়া। এর থেকে বোঝা যায়, আমরা, ফরাসিরা খেলাধুলোর জগতে সমানাধিকারের দিকে এক কদম এগোতে পারলাম!"

এবার তৃতীয় ব্যক্তির পালা। কেইটার হাত থেকে কে মশাল নেবে, এই নিয়ে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা ছিল, কারণ কর্তৃপক্ষ থেকে কোনও নাম দেওয়া হয়নি এর আগে। কানাঘুষো শোনা গেছিল, জিনাদিন জিদান! অনেকেই এই গুজবে খুশি! বাস্তবে দেখা গেল, তৃতীয় ব্যক্তি এগিয়ে যাচ্ছেন, মশাল হাতে নিচ্ছেন, তাঁর মুখ ঢাকা স্বচ্ছ সাদা ওড়নায়। মশাল নিয়ে ভিড়ের দিকে এগিয়ে আসতে, মুখের আড়াল সরাতে দেখা গেল, অলিম্পিকের মশাল হাতে এগিয়ে আসছেন জুল! মার্সেই খ্যাত র‍্যাপার, জুল! গোটা অঞ্চলে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।

আরও পড়ুন- কেন এত জনপ্রিয় ফরাসি চুম্বন?

নীরবতার আংশিক দায়, জিদানকে দেখতে না পেয়ে। বাকি দায়, একজন র‍্যাপারের হাতে অলিম্পিকের মশাল উঠতে দেখে। এই দুই দলে বিভক্ত স্বভাব তার্কিক ফরাসি এখনও চোখ ঘুরিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে। আপত্তির কারণ সরাসরি না বললেও বোঝা যাচ্ছে, 'লিবারতে, এগালিতে, ফ্রাতেরনিতে' স্লোগান ওড়ানো বিপ্লবের দেশে মানুষ এখনও কিছু জিনিস এলিট রাখতেই চায়। অলিম্পিকের মশাল, তার আভিজাত্যের সঙ্গে আম-আদমির পথের র‍্যাপারের মেলবন্ধন ফরাসিদের মন কাড়েনি। অপরদিকে, মার্সেই শহরে বা গোটা দেশে, জুল-এর যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা, তার ধারেকাছে বর্তমান ফরাসি শিল্পীর কেউ আছেন কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।

কর্তৃপক্ষ বলছে, "অলিম্পিক কেবল অ্যাথলেটদের কেন, শিল্পীদেরও। আমরা সেই ধারণাটাই আরেকবার জাগিয়ে দিতে চেয়েছি।" মোট কথা, ফরাসি মাটিতে অলিম্পিকের মশাল বহনের মধ্যে ফরাসি কায়দায় মিশে গেছে সামান্য একটু বিপ্লব, অথবা, বিপ্লবের অভিপ্রায়!

৯ মে থেকে মশালের রিলে শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের ৪০০ শহর ঘুরে, হাজার হাজার নামী মানুষের হাত হাতে আগুন গিয়ে পৌঁছবে প্যারিস। খেলা শুরু ২৬ জুলাই। অনুষ্ঠানিক শুরুটা ঘটে গেছে মার্সেই বন্দরে। প্যারিস ২০২৪-এর একজিকিউটিভ ডিরেক্টর তিয়েরি রোবুল জানিয়েছেন, "মার্সেইয়ের মাটি অত্যাশ্চর্য! অবিস্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করে মানুষের মনে আজীবনের ছাপ ফেলার জন্য মার্সেইয়ের চেয়ে উর্বর জমি ভাবাই যায় না!"

সবশেষে মঁসিয় মাক্রোঁ সাংবাদিকদের বলেন, "এক ভাগ ফ্রান্স আছে, যারা সদাসংশয়ী। আরেক ভাগ, অস্থির। আমার সহযাত্রীদের মধ্যে অনেকেরই মনে হয়েছিল, আমার দেশ অলিম্পিকের দায়িত্ব নিতে পারবে না। আর এই আজ, আমরা খেলায় ঢুকলাম। আমার ধারণা, জনগণের উৎসাহ উদ্দীপনা এই সাফল্যের চাবিকাঠি। সেই অপরিসীম উৎসাহ আর আশার অংশীদার হতে আজ আমি সবার সঙ্গে জমায়েতে সামিল হয়েছি। আপামর ফরাসির সাফল্যে আমি আজ গর্বিত, আমি চাই তারাও আমাদের সংঘবদ্ধ শক্তির গর্ব করুন।" প্রাচীন অলিম্পিকের সূত্র ধরে মাক্রোঁ বক্তব্য শেষ করলেন, "এই আমরা খেলায় ঢুকলাম। খেলা যেন এবার শান্তির পথে যাত্রা হয়ে ওঠে।"

More Articles