সেই রাতে যৌনহেনস্থা আর এক মহিলাকেও? যে ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল আরজি কর-অভিযুক্তের পলিগ্রাফ টেস্টে
Sanjay Roy Polygraph Test: এদিকে পলিগ্রাফ টেস্ট থেকে জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের ঘটনার দিন দু-দু'টি যৌনপল্লিতে যাওয়ার কথাও।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তরুণী-চিকিৎসক খুনে উত্তাল দেশ। দোষীর শাস্তির দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভে নেমেছে গোটা রাজ্য, সেই আন্দোলনের জের রাজ্য ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশেও। ইতিমধ্যেই ওই ঘটনায় তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। এমনকী সেই ঘটনা নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছে সুপ্রিম কোর্টও। ইতিমধ্যেই আরজি কর কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছে সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে। গত সপ্তাহেই তাকে শিয়ালদহ আদালতে তোলা হয়, যেখান থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়েছে অভিযুক্তকে। আদালতে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন অভিযুক্ত, আর সেই দাবির পরেই সঞ্জয়ের পলিগ্রাফ টেস্ট হয়। রবিবারই সেই পরীক্ষা করা হয়েছে তার।
অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই উঠেছে একাধিক বিস্ফোরক অভিযোগ। গত ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের বক্ষ বিভাগের সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল ওই চিকিৎসকের দেহ। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় সঞ্জয়কে। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছিল বক্ষ বিভাগের বাইরে সঞ্জয় রায়ের ঘোরাফেরা। সেই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ গত ১০ অগস্ট তারিখে। সম্প্রতি ধৃত সঞ্জয় রায়ের নতুন করে মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল তৈরি করার নির্দেশ দেয় সিবিআই। সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে সঞ্জয় রায়ের সম্পর্কে বিস্ফারিত সব তথ্য। পর্নগ্রাফিতে আসক্তি থেকে শুরু ভয়ঙ্কর অপরাধপ্রবণতার ছাপ উঠে এসেছে সেই রিপোর্টে। দিন কয়েক আগে সঞ্জয়কে শিয়ালদহ আদালতে তোলা হলে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। তার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করতে দেখা যায় তাকে। এরপরেই রবিবার তার পলিগ্রাফ টেস্ট করার পথে হাঁটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
কী এই পলিগ্রাফ পরীক্ষা? কী ভাবেই বা তা কোনও মামলার তদন্তে সাহায্য করে? এই পলিগ্রাফ পরীক্ষাকে ‘লাই ডিটেক্টর’ পরীক্ষাও বলা হয় কোথাও কোথাও। অভিযুক্ত মিথ্যা বলছেন কি না, তা যাচাই করা হয় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। উনিশ শতকে ইটালির অপরাধ বিশেষজ্ঞ সিজ়ার লোমব্রোসো প্রথম পলিগ্রাফের অনুরূপ একটি পরীক্ষা করেন। তিনি অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের রক্তচাপের পরিবর্তন মাপার জন্য একটি যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী কালে আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম মার্স্ট্রন ১৯১৪ সালে এবং ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ অফিসার জন লারসন ১৯২১ সালে এই নিয়ে আরও পরীক্ষা করেছিলেন। পলিগ্রাফ পরীক্ষা সাধারণত জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে করা হয়। ‘কার্ডিও-কাফ’ বা সংবেদনশীল ইলেক্ট্রোডের মতো কয়েকটি যন্ত্র তারের মাধ্যমে অভিযুক্তের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সেই সময় অভিযুক্তের রক্তচাপ, নাড়ির গতি ইত্যাদি স্বাভাবিক আছে কি না, তা মেপে নেওয়া হয়। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির যদি জ্বর বা অন্যান্য অসুখ থাকে, তা হলে সেই সময় পলিগ্রাফ পরীক্ষা হয় না। অভিযুক্তের শারীরিক প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক থাকলে তবেই ওই পরীক্ষা করা হয়।
আরও পড়ুন: পশুর মতো প্রবৃত্তি! ধৃত সঞ্জয় রায়ের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা যা বলছে
পলিগ্রাফ পরীক্ষায় অভিযুক্তকে তদন্ত সংক্রান্ত একাধিক প্রশ্ন করেন তদন্তকারীরা। অভিযুক্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় তাঁর হৃৎস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসে পরিবর্তন বা রক্তচাপের হ্রাস-বৃদ্ধির উপর একটি বৈদ্যুতিন স্ক্রিনের মাধ্যমে নজর রাখেন চিকিৎসক এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। এমনকী, উত্তর দেওয়ার সময় অভিযুক্তের ঘাম হচ্ছে কি না, তার উপরেও নজর রাখা হয়। প্রতিটি প্রশ্ন শোনার পর এবং উত্তর দেওয়ার সময় অভিযুক্তের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়াগুলি একটি গ্রাফ বা লেখচিত্রের মধ্যে ধরা পড়ে। পরে এই লেখচিত্র বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয় যে, অভিযুক্ত মিথ্যা কথা বলছেন না সত্যি। যদিও পলিগ্রাফ পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক ভাবে একশো শতাংশ সঠিক ফলাফল দেয় বলে প্রমাণিত হয়নি। চিকিৎসকদের মধ্যেও এই পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতে তদন্তের ক্ষেত্রে বহু সময়েই এই পলিগ্রাফ টেস্টের শরনাপন্ন হতে দেখা গিয়েছে পুলিশ ও তদন্তকারীদের।
তবে সূত্রের খবর, সেই পলিগ্রাফ পরীক্ষাতেও সঞ্জয় রায়ের বয়ানে ধরা পড়েছে একাধিক অসঙ্গতি। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদেনে জানানো হয়েছে, এই পরীক্ষার সময় সঞ্জয় রায়কে অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে দেখা যায় । সিবিআই নানান প্রমাণ সামনে রেখে সঞ্জয়কে ওই পরীক্ষায় প্রশ্ন করা শুরু করলে,সে নানান অজুহাত দিতে থাকে। তার দাবি, সেমিনার হলে পৌঁছে তরুণীকে মৃত অবস্থায় দেখে সে। সেই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, লাই ডিটেক্টর টেস্টে সঞ্জয় রায় বলে, ওই তরুণীকে মৃত অবস্থায় দেখে তিনি ঘটনাস্থল থেকে ভয়ে পালিয়ে যান। এর আগে যখন কলকাতা পুলিশ সঞ্জয়কে গ্রেফতার করে, তখন তিনি ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ স্বীকার করেছিল বলে জানা গিয়েছিল। এদিকে, জেলে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীদের সঞ্জয় জানায়, সে এই ধর্ষণ ও খুনের বিষয়ে কিছু জানত না সে। যে দাবি শিয়ালদহ জুডিশিয়াল আদালতেও করেছিল সে।
এদিকে পলিগ্রাফ টেস্টে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করলেও সঞ্জয় নিজের মুখের আঘাত ও ঘটনাস্থলে তার উপস্থিত থাকা নিয়ে সেভাবে কোনও যুক্তি দিতে পারেনি বলে দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। এদিকে, সঞ্জয় রায়ের হয়ে লড়া আইনি কৌঁসুলি এই পলিগ্রাফ টেস্ট নিয়ে সিবিআইকে কাঠগড়ায় তুলেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সঞ্জয় রায়ের কৌঁসুলিকে পলিগ্রাফ পরীক্ষার ব্যাপারে কিছুই জানায়নি সিবিআই। কারণ নিয়ম অনুযায়ী, পলিগ্রাফ পরীক্ষার সময় প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁর আইনজীবীরও উপস্থিত থাকার কথা। এই প্রসঙ্গে মানবাধিক লঙ্ঘনের অভিযোগও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে তুলেছেন তিনি। সিবিআই সূত্রে জানানো হয়েছে,প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে চলেছে সঞ্জয়ের জিজ্ঞাসাবাদ।
প্রাথমিক ভাবে সঞ্জয় রায়ের পক্ষে লড়ার জন্য কোনও আইনজীবীই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। পরে সেই ভার যায় প্রবীণ আইনজীবী কবিতা সরকারের কাঁধে। তিনি জানিয়েছিলেন, সঞ্জয়ের হয়ে মামলা লড়লেও ব্যক্তিগত ভাবে তিনি নির্যাতিতার শাস্তি চান। তবে এ দেশে যেহেতু সকলেরই আইনের অধিকার রয়েছে, এমনকী অভিযুক্তেরও। সেই হিসেবেই পেশাদার ভাবে আরজি কর কাণ্ডের অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের হয়ে লড়ছেন তিনি।
আরও পড়ুন: আদালতে আরজি কর কাণ্ডের ধৃত! কে লড়বেন অভিযুক্ত সঞ্জয়ের হয়ে আইনি লড়াই?
এদিকে পলিগ্রাফ টেস্ট থেকে জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের ঘটনার দিন দু-দু'টি যৌনপল্লিতে যাওয়ার কথাও। সঞ্জয় জানিয়েছে, দুটি যৌনপল্লীতে গেলেও সেখানে কারও সঙ্গে সঙ্গম করেনি সে। বরং নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছিল, তার থেকে নগ্ন ছবিও চেয়েছিল। পরে হাসপাতালে আসার সময় এক মহিলাকে রাস্তায় উত্ত্যক্তও করে সঞ্জয়। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের আগে ঠিক কী কী করেছিল সঞ্জয় রায়? পলিগ্রাফ টেস্টের পর সূত্র মারফৎ জানা গেছে, রাত ১১.১৫ নাগাদ সে তার এক বন্ধুর সঙ্গে মদ খেয়েছিল। তারপর প্রথমে গেছিল উত্তর কলকাতার এক যৌনপল্লীতে, তারপর সেখান থেকে সে আসে দক্ষিণ কলকাতায়। কয়েক ঘণ্টা সেখানে সময় কাটানোর পর ভোর ৪টের কিছু আগে সঞ্জয় পৌঁছয় আরজি কর হাসপাতালে। সোজা চলে যায় সেমিনার হলে। সেখানের সিসিটিভি ফুটেজেই তাকে দেখা গেছিল। ওই পলিগ্রাফ পরীক্ষায় সময় সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা একাধিক প্রমাণ সঞ্জয়ের সামনে হাজির করে, যার মাধ্যমে তার অভিযোগ প্রমাণ করা যায়। যদিও সঞ্জয় নিজের বিভিন্ন অ্যালিবাইয়ের কথা তুলে ধরে নানা অজুহাত খাঁড়া করেছে বলেই দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে।
এই পলিগ্রাফ পরীক্ষা কি আদৌ খুশি করতে পারল তদন্তকারীদের? নাকি পরবর্তী কালে নার্কো পরীক্ষার মতো আরও জটিল কোনও পরীক্ষার পথেই হাঁটতে চাইবে সিবিআই। আরজিকর কাণ্ডের অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? থাকছে সেই প্রশ্নও।