আপনার শরীরের প্রেমে পড়তে পারে মশারাও! 'মশক চুম্বকে'র গবেষণায় মিলল অবিশ্বাস্য তথ্য

Mosquito Magnet: মশার জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে, ঘ্রাণশক্তিকে বিনষ্ট করে তার মানুষ চেনার ক্ষমতা নষ্ট করা এখনও সম্ভব হয়নি।

কখনও কি এমন মনে হয়েছে যে, আপনার আশে পাশে থাকা মানুষের থেকে আপনাকেই মশা বেশি কামড়ায়? সেই ভাবনা একেবারেই ভুল নয়। হতেই পারে আপনি একজন ‘মশক চুম্বক’ (Mosquito magnet)। নিছক মশকরা নয়, গবেষণা এমনটাই দাবি করছে। গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই সব নতুন নতুন তথ্য যেখানে দেখা যাচ্ছে, মানুষের শরীরে থাকা বেশ কিছু উপাদান মশাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করতে পারে। অর্থাৎ, কেউ কেউ মশার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। রকফেলার ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক বিজ্ঞানী লেসলি ভশাল (Leslie Vosshall) এবং মারিয়া এলেনা ডি ওবাল্ডিয়া (Maria Elena De Obaldia) এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন বিগত তিন বছর ধরে। এই গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে Cell নামক একটি বিজ্ঞান পত্রিকায়।

মশা কীভাবে মানুষ চিনতে পারে?

পূর্ববর্তী গবেষণা থেকে জানা সম্ভব হয়েছিল, মানুষের শরীর খুঁজে বের করার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি একটি স্ত্রী মশার। নিঃশ্বাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, শরীরের তাপ এবং শরীরের গন্ধ শনাক্ত করে মানব প্রজাতির যেকোনও সদস্যকে আক্রমণ করে মশা। এছাড়াও মশা তার খাদ্যবস্তুর দিকে কতটা ধাবিত হবে তা ব্যাখ্যা করার অনেক জনপ্রিয় তত্ত্বই রয়েছে। এই তত্ত্বগুলির ভিত্তি হল মানুষের রক্তের ধরন, রক্তে শর্করার মাত্রা, রসুন বা কলা খাওয়া, মহিলা হওয়া এবং শিশু হওয়া ইত্যাদি। তবুও বেশিরভাগ ব্যাখাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েই গেছে। এই কারণেই ভোশাল এবং মারিয়া এলেনা ডি ওবাল্ডিয়া নতুন তত্ত্বের অন্বেষণ শুরু করেন।

আরও পড়ুন- প্লেগের কারণেই হু হু করে বাড়ছে আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি! বিজ্ঞানীদের গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য

গবেষণা চলল কোন পদ্ধতিতে?

এই গবেষণায় বিভিন্ন বয়সের আটজন অংশগ্রহণকারীকে দিনে অন্তত ছয় ঘণ্টা করে উর্ধ্ববাহুতে নাইলনের স্টকিংস (মোজা জাতীয় এক ধরনের আঁটোসাঁটো পোশাক) পরে থাকতে বলা হয়। এই কাজটি বেশ কিছু দিন ধরে করেন তাঁরা। পরের কয়েক বছর ধরে, গবেষকরা রাউন্ড-রবিন স্টাইল টুর্নামেন্টের (একটি প্রতিযোগিতা যেখানে প্রত্যেক প্রতিযোগী অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে একবার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পান। ক্রিকেট খেলার টুর্নামেন্ট এবং সেখানে যেভাবে প্রতিটি দল অপর দলের সঙ্গে খেলে তাকেই আমরা উদাহরণ হিসেবে ভেবে নিতে পারি) মাধ্যমে সম্ভাব্য জোড়ায় নাইলন স্টকিংসগুলিকে একে অপরের বিরুদ্ধে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় উপকরণ হিসেবে একটি গ্লাস চেম্বার এবং তার সঙ্গে যুক্ত দুই নল বিশিষ্ট একটি যন্ত্র ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। এডিস ইজিপ্টি মশা অর্থাৎ যে সব মশা জিকা, ডেঙ্গু, হলুদ জ্বর, এবং চিকুনগুনিয়ার প্রাথমিক বাহক প্রজাতি, তাকে প্রধান চেম্বারে রাখা হয়। তারপর গবেষকদ্বয় পর্যবেক্ষণ করেন, মশাগুলি কোন নাইলনের দিকে বেশি মাত্রায় উড়ে যায়। এডিস ইজিপ্টির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় লক্ষ্য ছিল সাবজেক্ট ৩৩ বা ৩৩ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। গবেষণায় স্বচ্ছতার জন্য সংগৃহীত নমুনাগুলিকে শনাক্ত না করে বরঞ্চ এলোমেলোভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তার মধ্যে থেকে যেকোনও এক জোড়াকে বেছে নিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। ফলত, গবেষকরা জানতেন না যে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কোন ব্যক্তি কোন নাইলন ব্যবহার করেছেন। তা সত্ত্বেও গবেষকদল লক্ষ্য করেন, সাবজেক্ট ৩৩ এর সঙ্গে অন্য যেকোনও নাইলনের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে যে মশারা বারবার সাবজেক্ট ৩৩ নমুনার দিকেই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।

আরও গবেষণা ও তার ফলাফল

ফলাফল নিশ্চিত করতে, বিজ্ঞানী ভোশাল আরও ৫৬ জন ব্যক্তিকে নথিভুক্ত করান এবং আরও একবার সম্পূর্ণ পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি হয়। এবারেও দেখা যায় যে, মশাদের কাছে সাবজেক্ট ৩৩ সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এরপর তাঁরা তাঁদের পরীক্ষার নমুনাগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, মানুষের ত্বক নিঃসৃত কার্বক্সিলিক অ্যাসিডের উপস্থিতির কারণেই মশা মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যে ব্যক্তির ত্বকে কার্বক্সিলিক অ্যাসিডের উপস্থিতি বেশি তাকেই মশা কামড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।

আমাদের ত্বকের রোমকূপ থেকে এক ধরনের তেল নিঃসরণ হয়। ত্বকের উপরিভাগে উপস্থিত বিভিন্ন অণুজীব সেই তেল বা সেবাম (Sebum) থেকে কার্বক্সিলিক অ্যাসিড তৈরি করে থাকে। এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নমুনা বেশ কয়েক বছর ধরে একটানা পরীক্ষা করা হয়। গবেষকরা একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করেন! পরীক্ষার জন্য যেসব ব্যক্তিদের নির্বাচন করা হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শারীরিক এবং ব্যবহারিক বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তিত হয়ে গেলেও, যারা একবার ‘মশক চুম্বক’ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মশাকে আকর্ষণ করতে পারেন, তাঁদের সেই ক্ষমতা থেকেই যায়। এ থেকেই বোঝা যায় যে এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মশা কামড়ানোর যে কারণগুলি খুঁজে বের করেছেন সেগুলির স্থায়িত্ব ও গুরুত্ব এই জাতীয় অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের থেকে অনেকাংশে বেশি।

আরও পড়ুন- ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ

মশার জিনগত পরিবর্তন কি আমাদের মশার কামড় থেকে দূরে রাখতে পারবে?

মানুষ প্রধানত দু’ধরনের গন্ধ উৎপন্ন করে যা মশারা তাদের দেহের গন্ধ গ্রহণকারী দু’টি ভিন্ন অংশ- Orco এবং IR দ্বারা শনাক্ত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা মশার জিনগত পরিবর্তন করে Orco ও IR নামক গন্ধ গ্রহণকারী অংশকে নিষ্ক্রিয় করেন। তারপর সেই মশাদের ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এখানে দেখা যায় মশার ঘ্রাণতন্ত্রে (Olfactory system) গন্ধ শনাক্তকারী অংশ নিষ্ক্রিয় হওয়ার পরেও মানুষের ব্যবহারকারী নাইলন স্টকিংসগুলিকে তারা শনাক্ত করতে পারছে। মশার জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে, ঘ্রাণশক্তিকে বিনষ্ট করে তার মানুষ চেনার ক্ষমতা নষ্ট করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাই তার কামড় থেকে ও মশা জনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মানুষের পরিত্রাণ এই পদ্ধতিতে এখনও সম্ভব নয়।

এই পরীক্ষার ফলাফলগুলি থেকে সহজেই বোঝা যায় যে মশার মানুষের প্রতি যে ঝোঁক তার সঙ্গে মানুষের ত্বকের রাসায়নিক বা বলা ভাল জৈব রাসায়নিক গঠনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এই তত্ত্ব ও তথ্য আমাদের পথ দেখাচ্ছে, যদি কোনওভাবে আমরা ত্বকের জৈব-রাসায়নিক চরিত্রকে সাময়িকভাবে বদলে ফেলতে পারি অর্থাৎ যে সমস্ত রাসায়নিক মশাকে আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে সাহায্য করে তাকে কমিয়ে ফেলতে পারি, তবে মশাকে বেশ খানিকটা দূরে রাখা সম্ভব হবে। যদিও এই ধরনের গবেষণার কাজ এখনও বাকি রয়েছে। এই বিষয়ে ভবিষ্যৎ গবেষণা আমাদের মশা প্রতিরোধক নতুন কোনও কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কারে সাহায্য করবে। বর্তমান পৃথিবীতে যেভাবে মশা বাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে সেখানে এ ধরনের গবেষণা ও তার সুদুরপ্রসারী ফলাফল আমাদের আশ্বস্ত করতে পারে।

More Articles