মুঘল আমল থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাশিয়ার, জেনে নিন সেই অজানা ইতিহাস

১৬৯০ সালে রাশিয়ার রাজা পিটার দ্য গ্রেট ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী ছিলেন। পিটার দ্য গ্রেট, ম্যালেনকোভকে কাশিমভের মতো একই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে যেতে বলেছিলেন।

ভারত-রাশিয়ার সম্পর্ক কিন্তু আজকের কথা নয়। প্রায় ৬০০ বছর ধরে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক। মুঘল সম্রাটদের সময় থেকেই ভারতে এসেছে রাশিয়ান পর্যটকদের দল।

 

১৬৯০ সালের জানুয়ারি মাস। দিল্লির সিংহাসনে তখন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। মালপত্র নিয়ে সুরাট বন্দরে এসে পৌঁছল একটি বিদেশি জাহাজ। যাত্রীদের মধ্যে অর্ধেক ভারতীয়, অর্ধেক পার্শিয়ান এবং একদল রাশিয়ান নাগরিক। সেই কোন পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন রাশিয়ান পর্যটক আফেন্সি নিকিতিন। তার প্রায় দেড়শো বছর পর আবার একদল রাশিয়ান ব্যবসায়ীর আগমন ঘটল ভারতে। ভারতের সম্পদ তখন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। সেই সম্পদের লোভেই সেমিয়ন ম্যালেনকোভ নামের এক তরুণ ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে ভারতে এসেছিল রাশিয়ানরা। ম্যালেনকোভের উদ্দেশ্য ছিল কিছু বছর ভারতে কাটিয়ে নিজের সম্পত্তি বৃদ্ধি করে রাশিয়ায় ফিরে যাওয়া।

 

১৬৯৫ সালে রাশিয়ার অস্ত্রাখান শহর থেকে ম্যালেনকোভ ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সুরাট বন্দরে পৌঁছনোর আগে অবধি ভারত সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল খুবই সামান্য। ম্যালেনকোভ কেবল জানতেন, মুঘলরা ভারত শাসন করে এবং মুঘলদের রাজত্বে ভারতের ধনসম্পদ ক্রমবর্ধমান।

 

আরও পড়ুন: ইংল্যান্ডের রানি পরতে ভয় পান, কেন আজও বিতর্কিত তৈমুর রুবি?

 

ম্যালেনকোভই প্রথম নন, এর আগেও রাশিয়ার জারেরা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্যোগী হয়েছেন। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সময়েও রাশিয়ার জারের প্রতিনিধি ভারতের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন। সপ্তদশ শতকে রাশিয়ানদের ধারণা ছিল, ভারতে প্রচুর পরিমাণে হিরে, চুণী পাওয়া যায়। এমনকী, রাশিয়ান পর্যটকেরা কোনও কোনও লেখায় ভারতকে 'হিরের দেশ' বলে পরিচয় দিয়েছেন।

 

রাশিয়ান পর্যটক নিকিতিন ও মার্কো পোলোর লেখা থেকেই মূলত রাশিয়ানরা ভারতের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পারেন। এই প্রসঙ্গে আমেরিকান পণ্ডিত রবার্ট এইচ. স্টাসি তাঁর বই ‘ইন্ডিয়া ইন রাশিয়ান লিটারেচার’-এ লিখেছেন, "বারবার মার্কো পোলোর লেখায় উঠে এসেছে ভারতের সম্পদের কথা। শুধু মার্কো পোলো নন, ওই সময়ে যেসব ইউরোপিয়ান পর্যটক ভারত ভ্রমণে এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের লেখাতেই উঠে এসেছে ভারতের সম্পদের প্রাচুর্যের কথা। এইসব লেখা থেকেই ইউরোপের দেশগুলোর মনে একটা পাকাপাকি ধারণা তৈরি হয়েছিল, ভারত খুবই ধনী দেশ। সেখান থেকেই রাশিয়া-সহ অন্যান্য ইউরোপিয়ান সাহিত্যেও ভারতের উল্লেখ এভাবেই করা হয়েছে।"

 

১৬৪০ নাগাদ রাশিয়ার জার আলেস্কি মিখাইলোভিচের আমলেই একাধিকবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করেছে রাশিয়া। এর মধ্যে বারতিনেক জার নিজের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে। রাশিয়ানরা একাধিকবার ভারতে আসার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ সময়েই এই অভিযান সফল হয়নি। তার একটা বড় কারণ রাশিয়ানদের ভারতে আসতে হলে মধ্য এশিয়ার পথ ধরে আসতে হত। তখন মধ্য এশিয়ার শাসকদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কের ক্রমাবনতি রাশিয়ানদের ভারতে প্রবেশের পথে সমস্যা সৃষ্টি করছিল।

 

রাশিয়ার প্রথম দিল্লি অভিযান
১৬৭৫ সালে রাশিয়ার জার মিখাইলোভিচের উৎসাহেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরির পরিকল্পনা করেন রাশিয়ানরা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তখন দিল্লির অধীশ্বর। রাশিয়ার এই দিল্লি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহম্মদ ইউসুফ কাশিমভ এবং ভাসিলি দাউদভ নামের দুই ব্যক্তি। এই অভিযানে তাঁদের সঙ্গে ছিল ভারতীয় ভাষা জানা একদল অনুবাদক। এই দুই ব্যক্তির ভারতে আসার গোটা বিবরণের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৫৮ সালে ভারত বিশেষজ্ঞ কোকা আন্তনোভার লেখা ‘রুশো: ইন্ডিয়ান রিলেশনস ইন সেভেনটিনথ সেঞ্চুরি’ বইয়ে।

 

কাশিমভ এবং অন্য চারজন বুখারা থেকে বলখের দিকে অগ্রসর হন, অন্যদিকে দাউদভ মস্কো ফিরে যাওয়ার আগে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য বাণিজ্যনগরীগুলি পরিদর্শনে যান। জার কাশিমভকে আওরঙ্গজেবকে দেওয়ার জন্য ল্যাটিন, তাতার এবং রাশিয়ান ভাষায় একটি চিঠি-সহ কিছু উপহার দিয়েছিলন। কাশিমভকে মুঘল সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন জার। জার চেয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত পাথরের কারিগররা রাশিয়ায় চলে যান।

 

১৬৭৬ সালের মধ্যে, কাশিমভ এবং তাঁর প্রতিনিধি দল কাবুলে পৌঁছন। কাবুল পৌঁছে সেখানকার গভর্নর মুকাররম খান মির ইসহাকের সঙ্গে দেখা করেন। রাশিয়ার প্রতিনিধি দল আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছনোর জন্য তাঁর মধ্যস্থতা প্রার্থনা করেন। যদিও তাঁদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। শাহজাহানাবাদে থাকা আওরঙ্গজেবকে কাবুলের গভর্নর রাশিয়ান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিলেও আওরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

 

ম্যালেনকোভের ভারতে আগমন
পরবর্তী কয়েক দশকেও ভারতের প্রতি রাশিয়ার আগ্রহ কমেনি। ১৬৯০ সালে রাশিয়ার রাজা পিটার দ্য গ্রেট ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী ছিলেন। পিটার দ্য গ্রেট, ম্যালেনকোভকে কাশিমভের মতো একই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে যেতে বলেছিলেন। তখনও মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির, তাই ম্যালেনকোভ সমুদ্রপথে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

১৬৯৫ সালের মে মাসে মস্কো থেকে যাত্রা শুরু করেন ম্যালেনকোভ। পারস্য উপকূলে পৌঁছানোর পর, দলটি ঘোড়া ও উটে চড়ে শামাখি শহরে এখনকার আজারবাইজানে যাত্রা করে। সেখান থেকে রুশরা সাফাভিদ শাহের সাথে দেখা করতে ইস্ফাহানে যাত্রা করে। তারা ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করলে সাফাভিদ সাম্রাজ্যে ব্যবসা করার অনুমতি প্রদান করেন। ম্যালেনকোভের নেতৃত্বাধীন রাশিয়ান দলটি ১৬৯৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পারস্যে বসবাস করেছিল এবং তারপরে আব্বাস বন্দর থেকে সুরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।

 

কাশিমভের সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হলেও ম্যালেনকোভের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। প্রথমে ম্যালেনকোভ আওরঙ্গজেবের কোষাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেখানে তিনি নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। এরপরই রাশিয়ান বণিকটিকে আওরঙ্গজেবের তাঁবুতে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্রাটের মনোভাব কয়েক দশক আগে থেকেই পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল। রাশিয়ানদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি একটি ফরমান জারি করেন। ফরমানে রাশিয়ান ব্যবসায়ীদের মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে যে কোনও জায়গায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়।

 

ম্যালেনকোভের ভারত-বৃত্তান্ত
বুরহানপুরে কয়েক মাস কাটানোর পর, রাশিয়ান বণিকরা আগ্রায় যাত্রা করেন। রাশিয়ান ব্যবসায়ী দলের অন্যতম সদস্য আন্দ্রেই সেমিয়েনভ আগ্রা ফোর্ট সম্পর্কে লিখেছেন: "শহরটি তিনটি দেওয়ালে নির্মিত, এবং সেই দেওয়ালের মধ্যে কোনও বাসস্থান নেই। শুধুমাত্র রয়েছে একটি প্রাসাদ, অফিস এবং একটি মসজিদ। সেই দেওয়ালের চারপাশে একটি বড় খাল ছিল।"

 

ম্যালেঙ্কির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল আস্ট্রাখান ত্যাগ করার পরেই রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। তাদের জিনিসপত্র পারস্যের শাহের সরকার রাশিয়ায় পাঠিয়েছিল। এ-বিষয়ে যতটুকু জানা যায়, তা থেকে ঐতিহাসিকদের ধারণা প্রতিনিধি দলের সকল সদস্য ১৭০২ সালে প্লেগে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও ভারতীয় জীবনযাপন নিয়ে রাশিয়ার সম্রাটদের উৎসাহ ভারত-রুশ সম্পর্কের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

More Articles