বিজেপি-কে 'সবক' শিখিয়েছিলেন, মৃত মুলায়মের ভার যে কারণে জীবিত-র থেকেও বেশি
Mulayam Singh Yadav: ১৯৯৭ সালে দেবগৌড়া সরকারকে হটানোর পর তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী যখন প্রধানমন্ত্রী খুঁজছেন, সিপিএম নেতা হরকিষাণ সিং সুরজিৎ মুলায়মের নাম সুপারিশ করেন।
পালোয়ানের বিদ্যা-বুদ্ধির ব্যাখ্যা করতে সাত লাঠিতে ফড়িং মারার উপমা উঠে আসে বাংলায়। কিন্তু হিন্দি বলয়ের কুস্তির আখড়াগুলি সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল একসময়। রাজনীতিতে আসার আগে সেখানেই শক্তি পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির কুলপতি মুলায়ম সিং যাদব। কুস্তির আখড়ায় প্রতিপক্ষকে যেমন বার বার ধরাশায়ী করেছেন তিনি, তেমনই বিচার বুদ্ধিতে রাজনীতির মাঠেও প্রবল পরাক্রমশালীদের কুপোকাত করার নজির রয়েছে তাঁর। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়েও আখড়ায় পাওয়া সম্প্রীতির পাঠ ভোলেননি তিনি। তাই উগ্র হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কখনও আপসে যেতে দেখা যায়নি তাঁকে। ঘরে-বাইরে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও, বার্ধক্যের কাছে শরীর হার মানলেও, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মূল্যবোধ থেকে একচুল সরেননি মুলায়ম।
ছয়ের দশকে কুস্তির আখড়ায় ঘুরেফিরে উঠে আসত সইফইয়ের তরুণ কুস্তিগীর মুলায়মের কথা। বাকপটু ছিলেন না তেমন, মুখ বুঁজে ঢুকতেন আখড়ায়। প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে প্রস্থানও ঘটত কোনও রকম হইচই ছাড়াই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কুস্তির আখড়াকে তিনি নিজের শক্তিপরীক্ষার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন হয়তো। কারণ সেই সময়ই রাজনীতির ময়দান কার্যত চষে ফেলছেন তিনি। রাম মনোহর লোহিয়া, রাজ নারায়ণ, চরণ সিংয়ের ছত্রছায়ায় শিখে নিচ্ছেন মারপ্যাঁচ। নিজেকে প্রমাণ করতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। ১৯৬৭ সালেই বিধায়ক নির্বাচিত হন। তারপর মোট ১০ বার বিধায়ক হন। সব মিলিয়ে সাত বারের সাংসদ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করলে গ্রেফতার হন মুলায়মও। ১৯ মাস জেল খেটেছিলেন। বেরিয়ে এসে সটান রাজ্যের মন্ত্রী। ১৮০০ সালে লোক দলের সভাপতি।
লোক দল ভেঙে যাওয়ার পর ক্রান্তিকারী মোর্চা নামের নিজের দল গঠন করেন মুলায়ম। এরপর ১৯৮৯ সালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে কেন্দ্রে ভিপি সিং সরকাররে পতন ঘটলে চন্দ্রশেখরের জনতা দল (সোশ্যালিস্ট)-এ যোগ দেন। তারপর কংগ্রেসের সমর্থনেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু কেন্দ্রে চন্দ্রশেখর সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেওয়ার পর, মুলায়মের সঙ্গও ছেড়ে দেয় কংগ্রেস। ১৯৯১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যায় মুলায়মের দল। এরপর আর কারও ছত্রছায়ায় নয়, ১৯৯২ সালে নিজের দল সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন মুলায়ম। কিন্তু হিন্দি বলয়ের রাজনীতিতে থেকে জাতপাত, ধর্মকে হাতিয়ার করার বদলে মুলায়মের রাজনীতি ছিল সমাজতান্ত্রিক। তৃণমূল স্তরের মানুষের দাবি-দাওয়া, প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেন। দলের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করেন।
আরও পড়ুন- কংগ্রেস-বিজেপির আধিপত্য ছাপিয়ে যাদব রাজত্বের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদব
দিল্লিতে সংসদ চলার ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের গুরুত্ব যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন মুলায়ম। তাই কংগ্রেস বা বিজেপির ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকতে চাননি তিনি। তার বদলে অ-কংগ্রেসি এবং অ-বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলিকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে উদ্যোগী হন। শোনা যায়, একবার ভাষণ দিতে গিয়ে সমাজবাদী নেতা হরমোহন সিং যাদবের ছেলে সুখরামের নাম মুখে আনতে অস্বীকার করেন ভিপি সিং। প্রকাশ্য সভায় তিন-তিনবার তাঁকে থামিয়ে দেন মুলায়ম। বাধ্য করেন সুখরামের নাম উল্লেখ করতে। দলের কর্মীদের নিয়ে এমনই স্পর্শকাতর ছিলেন মুলায়ম। কারও নামে মামলা হলে আইনি সাহায্যও করতেন। ১৯৯৭ সালে দেবগৌড়া সরকারকে হটানোর পর তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী যখন প্রধানমন্ত্রী খুঁজছেন, সিপিএম নেতা হরকিষাণ সিং সুরজিৎ মুলায়মের নাম সুপারিশ করেন।
কিন্তু মুলায়মকে প্রধানমন্ত্রী করায় আপত্তি জানান লালুপ্রসাদ যাদব। সেই নিয়ে কয়েক বছর আগে লালুকে খোঁচাও দিতে শোনা যায় মুলায়মকে। লালুপ্রসাদের ছোট মেয়ে রাজলক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছে মুলায়মের পরিবারে। সেখানে লালুকে পাশে নিয়েই মুলায়ম বলেন, ‘‘আজ আত্মীয় হয়ে ওঠা কিছু লোকের জন্যই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা অপূর্ণ থেকে গেল আমার।’’ ১৯৮৯-৯১, ১৯৯৩-৯৫ এবং ২০০৩-০৭, তিন দফায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুলায়ম। কোনও বারই যদিও পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সকলকে এক সুতোয় বেঁধে রাখার যে শিল্প কুক্ষিগত করেছিলেন মুলায়ম, উত্তরপ্রদেশের টালমাটাল রাজনীতিতে সেই কৃতিত্ব অন্য কেউ অর্জন করতে পারেননি।
ভিপি সিংয়ের সঙ্গে মুলায়মের দ্বন্দ্বের কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু ক্যানসারের সঙ্গে যখন যুঝছেন ভিপি সিং, বন্ধু ওয়াসিম আহমেদকে রাজ্যসভায় পাঠাতে মুলায়মকে অনুরোধ করেন তিনি। কথা রাখেন মুলায়ম। তাঁর জন্য নিজের দলের একটি রাজ্যসভা আসনের দাবি ছেড়ে দেন। কংগ্রেসবিরোধী হিসেবে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটলেও, ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তির জেরে বামেরা হাত তুলে নিলেও, একইভাবে ২০০৮ সালে আস্থাভোটে তদানীন্তন ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেন মুলায়ম। বিজেপি এবং কংগ্রেসকে রুখতে উত্তরপ্রদেশের চিরাচরিত রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দেন তিনি। বিজেপিকে রুখতে বহুজন সমাজ পার্টির হাত ধরে নজির গড়েন। পরে মায়াবতীর সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছলেও, কঠিন সময়ে ছেলে অখিলেশ যাদবকেও বাবার দেখানো রাস্তাই ধরতে হয়। তার জন্য বিরোধীরাও মুলায়মকে ‘নেতাজি’ বলে সম্বোধন করেন আজও। আদর্শ জোটের সংজ্ঞা আসলে মুলায়মের হাতেই উপস্থাপিত হয় গোটা দেশের কাছে।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে একেবারেই বাকপটু ছিলেন না মুলায়ম। তার জন্য ঘষেমেজে নিজেকে তৈরি করেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষার প্রতি বিন্দুমাত্র সদয় ছিলেন না তিনি। বরং সরকারি কাজে ইংরেজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে একাধিক বার সরব হয়েছেন। প্রশাসনিক চিঠিপত্র, আদালতের কাজকর্মে হিন্দি ব্যবহারে সিলমোহর পড়ে মুলায়মের উদ্যোগেই। নয়ের দশকে অনগ্রসর, কৃষিক, শ্রমিকদের কাছে তিনিই ছিলেন প্রকৃত ‘ধরিত্রীপুত্র’। এই নয়ের দশকই মুলায়মের পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর বাবরি মসজিদ অভিমুখে এগনো করসেবকদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। সেই সময় তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘অযোধ্যায় ঢোকার চেষ্টা করুক ওরা। আইনের অর্থ বুঝিয়ে দেব।’’
আরও পড়ুন- হাওয়াই চটি বনাম পল্টুরাম || দেশে বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে বেশি এগিয়ে কে?
অশনি সংকেতের ইঙ্গিত পেয়েও সেই সময় বাবরি মসজিদ অভিযান নিয়ে কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। তাই মুলায়মের কড়া অবস্থান তাঁকে সেই সময় সংখ্যালঘুদের ‘একমাত্র রক্ষক' করে তোলে। সমাজবাদী পার্টির নেতা রেবতী রমণের বক্তব্য, ‘‘মোল্লা মুলায়ম বলে সেই সময় কটাক্ষ করা হয় নেতাজিকে। কিন্তু উনি সংবিধানকে রক্ষা করেছিলেন। সংবিধান মেনে চলায় বিশ্বাসী ছিলেন। আজও উত্তরপ্রদেশের গ্রামে ‘জিসকা জলওয়া কায়েম, উসকা নাম মুলায়ম’ স্লোগান শোনা যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানোর ক্ষমতা ছিল ওঁর।’’ সমালোচকরা যদিও মুলায়মের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণের অভিযোগ তোলেন কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই উত্তরপ্রদেশে হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন থেকে সংখ্যালঘুদের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন মুলায়ম। কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে সমাজবাদী পার্টি ভরসা হয়ে ওঠে সংখ্যালঘুদের কাছে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে আজও উত্তরপ্রদেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি কংগ্রেস। বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলে বর্তমানে দলিত, নিম্নবর্গের ভোট ভাগাভাগি হলেও, উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘুর সমর্থন আজও বড় শক্তি সমাজবাদী পার্টির।
১৯৯৬ সালে অল্প সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন মুলায়ম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব পান হাতে। ওই একবারই কেন্দ্রের মন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু যে উত্তরপ্রদেশকে ঘিরে জাতীয় রাজনীতির চাকা ঘোরে, তার গতিপথ নির্ধারণে মুলায়মের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এমনকী রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তুলে দিলেও, দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে মতান্তরের জেরে ছেলে অখিলেশকেও দল থেকে বহিষ্কার করতে পিছপা হননি তিনি। পরে যদিও ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগে। বয়সের ভারে যত নুয়ে পড়েন মুলায়ম, ততই সমাজবাদী পার্টির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন অখিলেশ। মুলায়ম-পুত্র দক্ষ রাজনীতিক, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, সে কথা মানতে আপত্তি নেই কারওই কিন্তু বাবার সঙ্গে তুলনায় বরাবরই পিছিয়ে থেকেছেন। বরং তাঁর আমলে, গত কয়েক বছরে উত্তরপ্রদেশে অনগ্রসর শ্রেণির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে বিজেপি। বিএসপি কার্যত এখন তাদের অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হচ্ছে। তাতে সমাজবাদী পার্টি শুধুমাত্র যাদবদের দল হয়ে রয়ে গিয়েছে। বাবার প্রয়াণে আরও বেশি করে সেই তুলনা টানা হবে। ফলে জীবিত মুলায়মের থেকে অখিলেশের কাছে প্রয়াত মুলায়মের রাজনৈতিক উত্তরাধিকাররে ভার অনেক বেশি। তা কাঁধে নিয়ে তিনি উতরে যান কিনা, সময়ই কথা বলবে।