মেহেফিল পড়ে রইল, পড়ে রইল অসম্পূর্ণ বন্দিশ! চলে গেলেন উস্তাদ রাশিদ খান

Ustad Rashid Khan: শোনা যায়, ছোটবেলায় নাকি গানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না রাশিদের। সেই রাশিদ খান সম্পর্কে পরবর্তীকালে পণ্ডিত ভীমসেন যোশী নাকি বলেছিলেন, তিনিই ছিলেন 'ভারতীয় কণ্ঠসঙ্গীতের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা'।

যে তারানা তিনি শুরু করেছিলেন, তা শেষ করা হল না তাঁর। মাঝপথেই থামল সুরের সফর। অসমাপ্ত মেহফিল থেকেই উঠে যেতে হল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী রাশিদ খানকে। মঙ্গলবার, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন সুরসম্রাট।

গত বেশ কিছু ধরেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন রাশিদ খান। নভেম্বর মাস থেকেই ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। বছর কয়েক আগেই শরীরে এসে বাসা বাঁধে প্রস্টেট ক্যানসার। তবে চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিল শরীর। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হন শিল্পী। ডিসেম্বরে ব্রেন স্ট্রোক হয় তাঁর। শুরু হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। তবে তার পরেও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। এরই মধ্যে মঙ্গলবার হঠাৎ করেই শরীরের অবনতি হয় শিল্পীর। তাঁকে তড়িঘড়ি ভেন্টিলেশনেও দেওয়া হয়। রাখা হয় অক্সিজেন সাপোর্টেও। তবু শেষমেশ বৃথা হল সমস্ত চেষ্টা। মঙ্গলবার দুপুর ৩টে বেজে ৪৫ মিনিট নাগাদ প্রয়াত হন উস্তাদ রাশিদ খান। তাঁর প্রয়ানে শোকের ছায়া দেশ জুড়ে। 

ধ্রপদী সঙ্গীতের জগতের দিকপাল রাশিদ খান সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলে দিতে হয় না। তাঁর গলায় ছিল সাক্ষাৎ সুরের দেবতার বাস। রাগ যতই কঠিন হোক না কেন, যত জটিলই হোক না কেন সেই মুরকি, রাশিদ খানের গলায় সেই সুরের যাতায়াত ছিল অবাধ এবং সহজ। ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্মগ্রহণ করেন রাশিদ খান। পরিবারেই ছিল সঙ্গীতের আবহ। দাদু উস্তাদ নিশার হুসেনের কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তার। অবশ্য খুব বেশিদিন উত্তরপ্রদেশে থাকা হয়নি রাশিদের। অল্প বয়সেই চলে আসেন কলকাতায়।

আরও পড়ুন: দিয়েছিলেন বিসমিল্লা খানকে টেক্কা, প্রথম মহিলা সানাইবাদক বাগেশ্বরী যেন সুরের সরস্বতী

শোনা যায়, ছোটবেলায় নাকি গানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না রাশিদের। সেই রাশিদ খান সম্পর্কে পরবর্তীকালে পণ্ডিত ভীমসেন যোশী নাকি বলেছিলেন, তিনিই ছিলেন 'ভারতীয় কণ্ঠসঙ্গীতের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা'। উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান ছিলেন সম্পর্কে রাশিদ খানের ভাইপো। সেই কাকার কাছেই তালিম নেওয়া শুরু হয় রাশিদের। পরে সেই গুলাম মুস্তাফার হাত ধরেই মুম্বইয়ে পাড়ি দেন রাশিদ। সেখানে গিয়ে উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কাছে গানের তালিম শুরু হয় তাঁর। ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার ক্রমশ দক্ষ শিল্পী হয়ে ওঠেন রাশিদ খান৷ উস্তাদ আমির খান ও উস্তাদ ভীমসেন যোশীর স্টাইলের বিশেষ প্রভাব ছিল তাঁর উপরে।

মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম বার কনসার্ট করেন রাশিদ খান। তার পর থেকে একের পর এক কনসার্টে সুরের জাদুতে দর্শকদের মন মাতিয়েছেন শিল্পী। মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হলেও ফিউশন বা বলিউড এবং টলিউডের ছবিতে বহু জনপ্রিয় গানও গেয়েছেন রাশিদ খান। 'যব উই মেট', 'কিসনা', 'হাম দিল দে চুকে সনম', 'মাই নেম ইজ খান', 'রাজ ৩'-র মতো বলিউড ছবির পাশাপাশি 'মিতিন মাসি', 'বাপি বাড়ি যা', 'কাদম্বরী'-র মতো বাংলা ছবিতেও তাঁর গান দর্শকদের মন কেড়েছে। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার থেকে শুরু করে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ-সহ একাধিক সম্মান ছিল তাঁর ঝুলিতে।

আরও পড়ুন:বাংলা ছবির গান থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় রামধনুর মতো ছড়িয়ে সুরের আকাশে

খাঁটি হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকে হাল্কা বাদ্যযন্ত্রের ঘরানার সঙ্গে মিশ্রিত করার প্রচুর পরীক্ষানিরিক্ষায় অংশ নিতেন উস্তাদ রাশিদ খান। পশ্চিমি যন্ত্রবাদক লুই ব্যাঙ্কসের সঙ্গে তাঁর পরীক্ষামূলক কনসার্ট দারুণ সাফল্য পেয়েছিল। সেতারবাদক শহীদ পারভেজ-সহ একাধিক শিল্পীর সঙ্গে যুগলবন্দি করেছেন তিনি। বাকি ছিল আরও কাজ। সেই মেহফিল অসম্পূর্ণ রেখেই জীবনমঞ্চ ছাড়লেন উস্তাদ রাশিদ খান। রয়ে গেল তাঁর অসম্পূর্ণ খেয়াল, বন্দিশ আর রাগেরা। যারা থেকে গেল এই পৃথিবীর সমস্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনুরাগীর বুকে। যা ভারতীয় ধ্রপদী সঙ্গীতের ইতিহাসে থেকে যাবে আদিঅনন্ত কাল। আর সেখানেই অক্ষয় হয়ে রইলেন সুরের উস্তাদ রাশিদ খান।

More Articles