সত্যিই অন্য গ্রহে যাওয়া যায় এই রহস্যময় আলো পেরিয়ে? মেরুপ্রভার আসল সত্যিটা কী?

Northern lights or Aurora Borealis: এর সৃষ্টির প্রকৃত কারণ ও কেন সময়ের সঙ্গে এরা বদলে যায়- সেসব কারণ খুঁজতে বছরের পর বছর ধরে গবেষণা চলেছে।

The northern lights

Painted the sky
With stories we
Hadn’t hard of yet
We learned back
Letting the colors
Wash over us
And paint new dreams
for us to follow


……Robyn Patrick

মেরু প্রদেশে রাতের আকাশে এক মায়াবী অপার্থিব সুন্দর আলোর প্রদর্শনী দেখতে পাওয়া যায়। অনেক মানুষেরই ইচ্ছাও থাকে, জীবনের কোনও না কোনও এক সময় মেরুতে গিয়ে এই আলোর খেলা স্বচক্ষে দেখবেন। মেরুপ্রভার সৌন্দর্য আদিকাল থেকে মুগ্ধ করেছে মানুষকে। কবিদের কল্পনায় এই মেরুপ্রভা কখনও হয়ে উঠেছে না শোনা গল্পের আলোক প্রদর্শনী, কখনও বা অন্য এক পৃথিবীর প্রবেশদ্বার। রহস্যময় এই সবুজ ম্যাজেন্টা নীল আলোর সেতুকে আমরা ভূগোল বা বিজ্ঞান বইতে একে মেরুপ্রভা বা অরোরা নামে জেনে এসেছি।

মেরুপ্রভার কার্যকারণ ১৯ শতকের শেষ দশকে ক্রিস্টিয়ান বার্কেল্যান্ড আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই। তবে, অনেককাল আগে ইতালিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও মেরুপ্রভার নামকরণ করেন ‘অরোরা', ভোরের দেবীর নামে। অএনেক এই আলোকে ‘নর্দার্ন লাইটস’ নামেও চেনেন। আসলে নর্দার্ন লাইটস হচ্ছে মেরুপ্রভার কেবল একটা প্রকার মাত্র। মেরুপ্রভা দুই মেরুতেই দেখা যায়। যদিও দুই মেরুতেই লোকে চেনে আলাদা আলাদা নামে। সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের মেরুপ্রভাকে যথাক্রমে বলে ‘অরোরা বোরেয়ালিস’ বা ‘নর্দার্ন লাইটস’ এবং ‘অরোরা অস্ট্রালিস’ বা ‘সাউদার্ন লাইটস। প্রাচীনকালে এর প্রকৃত উৎসের কারণ জানা না থাকায়, নানান লোককথা তৈরি হয় এই আলোকমালাকে ঘিরে। অনেকে মনে করতেন, মৃত পূর্বপুুরুষদের আত্মারা আনন্দ উৎসবে নৃত্য করছে বলে এই আলোর সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেকে মনে করতেন, স্বয়ং ঈশ্বর নাকি এই আলোর সেতু তৈরি করেছেন, কোনও এক বিশেষ উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

রাতের আকাশে এই আলোকমালা একটি ক্ষেত্র তৈরি করে যার পোশাকি নাম 'অরোরাল জোন'। এটিকে একটি চৌম্বক ফ্লাক্স টিউব হিসেবেও ভাবা যেতে পারে যা অরোরাল আয়নস্ফিয়ার থেকে আরও উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। অপরদিকে, প্রস্থে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর ৭০ ডিগ্রি জিওম্যাগনেটিক অর্থাৎ ভূচুম্বক অক্ষাংশ জুড়ে এটি বিস্তৃত। এটি একটি তীব্র চুম্বকিত প্লাজমা। যেখানে ইলেকট্রনের প্লাজমা কম্পাঙ্কের মান ইলেকট্রনের সাইক্লোট্রন কম্পাঙ্কের থেকে অনেক কম। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই অরোরাল প্লাজমা শীতল আয়নোস্ফিয়ার (তাপমাত্রা ~ ১ ইলেক্ট্রন ভোল্ট) ও উষ্ণ মেসোস্ফিয়ারের (তাপমাত্রা ~১০০ ইলেক্ট্রন ভোল্ট) মিশ্রণ।

এখন, বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো এই মেরুপ্রভা সৃষ্টি হয় কীভাবে?

আমরা জানি, সূর্য নিজেও প্লাজমা অবস্থায় আছে যার ভেতর ইলেকট্রন ও প্রোটন মুক্তভাবে বিচরণ করে। প্লাজমার ভিতর শক্তির পরিমাণ বেশি হলে এই আধানগুলো সূর্যের প্রবল মহাকর্ষিক ক্ষেত্র অতিক্রম করে বেরিয়ে আসে এবং ভীষণ বেগে ধাবিত হয় পৃথিবীর দিকে। একেই বিজ্ঞানীরা বলেন সৌরঝড়। চার্জড কণাগুলি গতিময় হওয়ার কারণে সৌরবায়ু নিজেই এক চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কাছে এলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যাদের চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রতি সমান্তরাল অবস্থানে আসে, তারাই বাধা অতিক্রম করে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। ফলে সৌরবায়ুর খুব অল্প সংখ্যক ইলেকট্রন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে সব থেকে সুবিধাজনক স্থান হচ্ছে পৃথিবীর দুই মেরু। এই প্রবেশের সময় ইলেকট্রনের স্রোত বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। ফলে অণুগুলোর ভিতরে কিছু শক্তি সঞ্চারিত হয়। ইলেকট্রনগুলি সেই শক্তি গ্রহণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করে (বোরের তত্ত্ব অনুসারে)। কিছুক্ষণ পরে, কণাগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় আসার জন্য এই অতিরিক্ত শক্তির নির্গমন করে, ফলে ইলেকট্রনের গতিশক্তি আলোকশক্তিতে পরিণত হয়। কোটি কোটি ইলেকট্রন দ্বারা এভাবে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মিই আমরা মেরুপ্রভারূপে দেখতে পাই।

আরও পড়ুন- “চরকায় সুতো কেটে দেশের উন্নতি হবে না!” গান্ধীর সমালোচনাই কাল হয়েছিল মেঘনাদ সাহার?

সাধারণত মেরুপ্রভাতে সবুজ রঙের ছটা অধিক দেখা যায়। অক্সিজেনের সঙ্গে ইলেকট্রনগুলির প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় এই উজ্জ্বল সবুজ রঙ। তবে বেগুনি বা নীল রঙের বাহারি আলো তৈরি হয় নাইট্রোজেনের সঙ্গে ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়ায়। চলমান এই আলোক প্রদর্শনী পদার্থবিদদের আকৃষ্ট করেছে যুগের পর যুগ। এর সৃষ্টির প্রকৃত কারণ ও কেন সময়ের সঙ্গে এরা বদলে যায়- সেসব কারণ খুঁজতে বছরের পর বছর ধরে গবেষণা চলেছে। হয়তো ম্যাগনেটোস্ফিয়ার ও মহাকাশ থেকে আগত রশ্মির মিথষ্ক্রিয়া পৃথিবীর উপর কী প্রভাব ফেলে সেই বিষয়ে অনেক অজানা তথ্যই অদূর ভবিষ্যতে জানা যাবে। সম্প্রতি ডঃ নাদিন কলমনির নেতৃত্বে UCL এবং নাসার একটি দল মহাকাশে সৌরঝড় বা কোনও তারকার বিস্ফোরণের পেছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই মেরুপ্রভার দ্রুত বদলে যাওয়া, অরোরার পুনর্গঠনের জন্যে শক্তির নির্গমন বিষয়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। আর এই মেরুপ্রভার গবেষণা কতোটা প্রাসঙ্গিক, তাও জানিয়েছেন,

" By studying auroras closely, we can map back to where in space the instabilities are occurring and study the physics that cause them. It’s much more efficient than trying to observe vast areas of space".

 

 


ঋণস্বীকার :

১. https://www.ucl.ac.uk/news/2018/nov/auroras-unlock-physics-energetic-processes-space
২. https://www.sciencedirect.com/topics/physics-and-astronomy/auroral-zone

More Articles