জাতীয় পতাকাতেই অনীহা সংঘের! প্রমাণ ইতিহাসে-বর্তমানে, 'অ্যান্টি ন্যাশনাল' কে!
ক্ষমতাসীন দলের ‘অভিভাবক সংগঠন’-এর তরফে এই উপেক্ষা কি অবমাননাজনক নয়, উঠছে প্রশ্ন।
কৃষক আন্দোলনের রেশ সবে আছড়ে পড়েছে রাজধানীর বুকে। প্রজাতন্ত্র দিবসে লালকেল্লার বাইরের টাঙানো হচ্ছে নিশান সাহিব পতাকা। টেলিভিশনে সেই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিল সংবেদনশীল মন। ‘আন্দোলনজীবী’দের সেই আচরণের নিন্দা করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতীয় পতাকার অবমাননায় গোটা দেশ ব্যাথিত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
কাট টু ২০২২, এই দেড় বছরে যমুনার কালো জল থিতিয়ে এসেছে অনেকটাই। স্বাধীনতার অমৃতকাল উদ্যাপনে জাতীয় পতাকার ‘হৃত মর্যাদা’ পুনরুদ্ধারে নেমেছে কেন্দ্র। ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ ওড়াতে সরকারি, বেসরকারি ভবন থেকে আম জনতার বাড়ির ছাদে তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়াতেও জাতীয় পতাকা ওড়ানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী থেকে গেরুয়া শিবিরের ছোট, বড়, মাঝারি নেতারা ফেসবুক, ট্যুইটারে নিজের ছবির বদলে ডিপি সাজিয়েছেন তেরঙ্গায়। কিন্তু দেশপ্রেম জাহিরের এই হিড়িকে নিশ্চুপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সংঘ, তাদের ছত্রছায়ায় থাকা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠন। সংগঠনের আশ্রয়ে থেকে দেশের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা নেতাদের থেকে এ ব্যাপারে নিরাপদ দূরত্বই বজায় রাখতেই দেখা যাচ্ছে তাদের। আর এই দূরত্বই শূল হয়ে বিঁধছে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে। লালকেল্লার চূড়ায় বসানো জাতীয় পতাকা স্পর্শ না করে, লালকেল্লার বাইরে কয়েক ফুট উঁচু খুঁটিতে নিশান সাহিবের পতাকা টাঙানোয় যদি তেরঙ্গার অবমাননা হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের ‘অভিভাবক সংগঠন’-এর তরফে এই উপেক্ষা কি অবমাননাজনক নয়, উঠছে প্রশ্ন।
কথায় কথায় জাতীয়তাবাদের ভাবনা উস্কে দিতে অভ্যস্ত দিল্লির বর্তমান সরকারের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে সঙ্ঘের সমীকরণের হাজারো ব্যাখ্যা রয়েছে যদিও। গুজরাত থেকে দিল্লির সর্বেসর্বা হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা সঙ্ঘের দ্বারা পরিচালিত হন না, বরং সঙ্ঘকে নিজেদের সুবিধার্থে সময়বিশেষে সঙ্ঘকে ছাঁচে পেলে গড়েপিটে নেওয়ার কাজে হাত দিয়েছেন বলে কুৎসা করেন নিন্দুকেরা। কিন্তু দেশের প্রশাসনিক প্রধানের সঙ্গে নাম জড়িয়ে থাকার দায়বদ্ধতা থেকে তেরঙ্গা বিতর্কে সাফাই দিতে হয়েছে সঙ্ঘকে। তাদের যুক্তি, অমৃতকাল এবং তার সঙ্গে আওতায় সমস্ত সরকারি কর্মসূচিতেই সমর্থন রয়েছে তাদের। তাই খামোকা বিষয়টির রাজনীতিকরণ উচিত নয় বলে মত তাদের। কিন্তু তার পরেও সঙ্ঘ, তাদের শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে তেরঙ্গার দেখা মেলেনি। বরং ৫ অগাস্ট বিকেল পর্যন্ত সঙ্ঘের ট্যুইটার ডিপি-তে সংগঠনের গেরুয়া পতাকা এবং প্রতীকই জ্বলজ্বল করতে দেখা গিয়েছে। কভার পিকচারে রয়েছে স্বয়ম সেবকদের জমায়েতের ছবি। হিন্দু ধর্ম রক্ষায় ব্রতী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডিপি-তেও সংগঠনের নাম ও ব্রত জ্বলজ্বল করছে। কভার পিকচার হিসেবে শোভা পাচ্ছে অযোধ্যায় নির্মীয়মান রামমন্দির, রামচন্দ্র এবং সংগঠনের প্রতীকী ছবি। সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত, সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলের প্রোফাইলও তেরঙ্গার শোভাবর্জিতই রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে সরকারকে বিঁধছেন বিরোধীরা। স্বাধীনতার পর ৫২ বছর যারা তেরঙ্গা ওড়ানোর গরজ অনুভব করেনি, তারা জাতীয়তাবাদ তথা ইতিহাস নিয়ে শিক্ষাদানের আদৌ যোগ্য কিনা, উড়ে আসছে প্রশ্ন।
তেরঙ্গা নিয়ে সঙ্ঘের অবস্থান ঘিরে বিতর্ক আজকের নয় যদিও। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে যেই সময় আম ভারতীয় প্রাম বিসর্জন দিতে পিছপা হননি, সেই সময় ইংরেজ শাসকের প্রভুত্ব মেনে নিতে আপত্তি নেই জানিয়ে লেখা বিনায়ক দামদর সাভারকরের চিঠি নথিবদ্ধ রয়েছে ইতিহাসে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের জিগির তোলার নজিরও লিপিবদ্ধ রয়েছে সুস্পষ্ট হরফে। তেরঙ্গা নিয়েও সংখ্যাগহরিষ্ঠের বিপরীত মেরুতেই অবস্থান ছিল তাদের, তা-ও স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই।
সংঘের তেরঙ্গা বিরোধিতার কার্যকারণ
১৯৪৭-এর ১৭ এবং ২২ জুলাই সঙ্ঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর দু’টি প্রতিবেদনে তেরঙ্গার বিরোধিতা করা হয়। সেই সময় লেখা হয়, ‘তেরঙ্গাকে কখনও আপন করে নেবে না হিন্দুজাতি, হিন্দুদের কাছে কখনও সম্মান পাবে না তেরঙ্গা’। তেরঙ্গার বিরোধিতায় যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তা হল, ‘তিন শব্দটিই অশুভ। পতাকায় তিনটি রং রাখলে মনস্তত্ত্বের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য এবং দেশের পক্ষেও তা ক্ষতিকর’। হিন্দুধর্মে যদিও তিন শব্দ বা তিন সংখ্যাটির আকছার ব্যবহার চোখে পড়ে, ‘ত্রিশূল’, ‘ত্রিমূর্তি’, দেবতাগণের মধ্যে তিন শ্রেষ্ঠতম ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়। তেরঙ্গার বিরোধিতা করতে গিয়ে যদিও সেই তিন শব্দ এবং তিন সংখ্যাকেই অশুভ বলে ব্যাখ্যা করেছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সঙ্ঘ।
সঙ্ঘের তৎকালীন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রধান মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের লেখাতেও তেরঙ্গার বিরোধিতা চোখে পড়ে। তেরঙ্গাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে চিহ্নিত করার কোনও প্রয়োজনীতাই অনুভব করেননি তিনি। ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ে তিনি লেখেন, ‘আমাদের প্রাচীন এবং মহান দেশের গৌরবময় অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজের কোনও পতাকা ছিল না? হাজার হাজার বছর আগে আমাদের কি জাতীয় প্রতীক ছিল না কোনও? নিঃসন্দেহে বলা যায়, ছিল। তাহলে মনে এই অসম্পূর্ণতা, শূন্যতা কেন’? কিন্তু সামগ্রিক বাবে একটি অখণ্ড দেশ হিসেবে প্রাচীন ভারতের নির্দিষ্ট জাতীয় পতাকা বা জাতীয় প্রতীক বলে আদৌ কিছু ছিল কিনা, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি গোলওয়ালকর। তবে তেরঙ্গা নয়, মধ্যভাগ থেকে অর্ধ্বেক খণ্ডিত, গেরুয়া ধ্বজা, যা কিনা সঙ্ঘের প্রতীক, তাকেই যে জাতীয় পতাকা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন গোলওয়ালকর, তার মাধ্যমে ভারতকে হিন্দু দেশ হিসেবে তুলে ধরের বাসনা ছিল তাঁর মনে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। সঙ্ঘের ইতিহাসেই তার প্রমাণ মেলে। ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট, ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দেশের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে এবং তার ৫২ বছর পর, ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি সদর দফদরে তেরঙ্গা উড়িয়েছিল তারা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে কংগ্রেসের ভূমিকা বর্তমানে মুছে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন মোদি-শাহরা, জওহরলাল নেহরুর যাবতীয় কৃতিত্ব খারিজ করতে কংগ্রেসেরই যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নিজেদের বলে চালাতে চাইছেন তাঁরা, সেই পটেলই তেরঙ্গাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে মেনে নিতে একপ্রকার বাধ্য করেছিলেন সঙ্ঘকে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক বছরও কাটেনি, সঙ্ঘের প্রাক্তন সদস্য তথা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সদস্য নাথুরাম গডসের হাতে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি খুন হন মহাত্মা গান্ধি। সেই সময় দেশের উপ প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন প্যাটেল। গান্ধিহত্যার পরই দেশে সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। সরকারি বিবৃতিতে দেশজুড়ে ঘৃণা এবং হিংসার শিকড় ছড়ানোর জন্য দায়ী করা হয় সঙ্ঘকে। প্রকাশ্যে গীতাপাঠের নামে সঙ্ঘের জমায়েতের পিছনে আসলে কী উদ্দেশ্য, তার উপর নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্তও ছিল তাঁরই। সে বছর ১৮ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে সঙ্ঘকে দেশের জন্য বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। দিনে দিনে সঙ্ঘ বেপরোয়া হয়ে উঠছে, দেশজুড়ে বিধ্বংসী কাজকর্মে লিপ্ত সঙ্ঘ, সে কথাও উল্লেখ করেন। সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলতে সেই সময় প্যাটেলের কাছে কার্যতই অনুনয় বিনয় চালিয়ে যেতে থাকেন গোলওয়ালকর। প্রায় ১৮ মাস তা কানে তোলেননি প্যাটেল। শেষমেশ ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, তবে তার আগে দেশের সংবিধান, জাতীয় পতাকার প্রতি সঙ্ঘের আনুগত্য আদায় করেন প্যাটেল। কোনও রকম হিংসাত্মক, গোপন কাজকর্মে সঙ্ঘ অংশ নেবে না বলে মুচলেকাও আদায় করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সঙ্ঘের প্রতি গোড়ার দিকে নরমই ছিলেন প্যাটেল। তিনি মনে করতেন, সঙ্ঘ দেশকে ভালবাসলেও পথভ্রষ্ট একটি সংগঠন। সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে সঙ্ঘের সদস্যদের কংগ্রেস যোগদানের আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
সেই ধারণা থেকেই শেষমেশ প্যাটেল সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। ১৯৫০ সালের ১৫ অগাস্ট মারা যান প্যাটেল। তার পর থেকে দীর্ঘ ৫২ বছর আর জাতীয় পতাকা ওড়েনি সঙ্ঘের সদর দফতরে। ২০০০ সাল থেকে সংসদে সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হলে ২০০২ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে সঙ্ঘের সদর দফতরে তেরঙ্গা ওড়ানো হয়। তবে একরকম দায়ে পড়ে তেরঙ্গা ওড়ালেও, দেশের জাতীয় পতাকা গেরুয়াসর্বস্ব হওয়াই বাঞ্ছনীয় বলে আজও দাবি করেন সঙ্ঘের নেতা-কর্মীরা। ২০২৫ সালে ভাগবত খোদ দাবি করেন, ‘‘বিআর আম্বেদকরও জাতীয় পতাকার রং শুধুমাত্র গেরুয়াই রাখতে চেয়েছিলেন। সংস্কৃতকে জাতীয় ভাষা করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। কিন্তু আমরা তাতে সফল হইনি।’’
দীর্ঘ পাঁচ দশক জাতীয় পতাকা না ওড়ানোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সঙ্ঘ নেতাদের বলতে শোনা যায়, তাঁদের কাছে প্রতিদিনই স্বাধীনতা দিবস, তাই আলাদা করে পালনের কোনও বিষয় নেই। এমনকি সরকারি বিধিনিষেধের জেরেই বেসরকারি সংগঠন হিসেবে পাঁচ দশক তেরঙ্গা ওড়ানো যায়নি বলেও কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দাবি করত সঙ্ঘ। কিন্তু ২০০২ সালের আগে পর্যন্তও দেশের ‘ফ্ল্যাগ কোড’-এ সাফ বলা ছিল, প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মহাত্মা গান্ধির জন্মদিন-সহ দেশের স্বাধীনতা উদ্যাপনের দিনগুলিতে দেশের সমস্ত নাগরিক তেরঙ্গা ওড়াতে পারবেন। কোথাও কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। অর্থাৎ সঙ্ঘের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি এখনও সময় বিশেষে সঙ্ঘ তো বটেই বিজেপি-র কিছু নেতাকেও বলতে শোনা যায়, সেই দিন আসতে আর বেশি দেরি নেই, যেদিন তেরঙ্গার বদলে গেরুয়া ধ্বজাই দেশের জাতীয় পতাকা হিসবে গন্য হবে। তাই স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদ্যাপনে আম নাগরিককে সোশ্যাল মিডিয়া তেরঙ্গায় রাঙাতে উদ্বুদ্ধ করার আগে, মোদির উচিত ছিল নিজের অভিভাবক সংগঠনে তেরঙ্গার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা, এমনটা বলা অনুচিত নয়।