হিন্দু-মুসলিম, শ্মশান-কবর, রামমন্দিরেই আটকে গেল ভারতবর্ষ
Prime Minister Modi: মোদি বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা'। তিনি জোর গলায় ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেন, তাতে কি দেশে ভ্রষ্টাচার কমে গেল?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফল। তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর সাফল্যের নেপথ্যের অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে, তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতে পেরেছেন। বিষয়টা খানিকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো। তিনি জনগণকে বুঝিয়েছেন, লড়াইটা আমি বনাম 'পাপ্পু'। একজন বিরোধী নেতাকে তিনি এভাবেই ডাকতে পছন্দ করেন। ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি ৩২ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল। আর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের জোটটি ৩৮ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালে বিজেপির ভোট শতাংশ ৩২ থেকে বেড়ে হয় ৩৮ শতাংশ এবং এনডিএ জোটের ভোট দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি। তাহলে ভারতীয় ভোটারদের বাকি ৫৫ শতাংশ বিজেপি বা এনডিএ জোটকে ভোট দেয়নি বলেই দেখা যাচ্ছে। অথচ এই বিষয়টি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেন না। আর এটাই নরেন্দ্র মোদি সবথেকে ভালো বুঝেছেন।
আমাদের ভোট ব্যবস্থাটা ব্রিটিশদের থেকে ধার নেওয়া। যাকে বলে ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি। এই ব্যবস্থাটি মোদি অত্যন্ত ভালো বুঝেছেন। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের একজন বরিষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছেন, “পার্টি সিস্টেম খোকলা হো গয়া"। তিনি যেটা বলতে চাইছিলেন তা হলো, দলে আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং এখন সবটাই একজন ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। যদি বিজেপি জেতে, তাহলে সমস্ত কৃতিত্বটাই নরেন্দ্র মোদির। আবার কোনও কারণে বিজেপি দুর্বল হয়ে গেলেও সেই দায় নরেন্দ্র মোদিরই। এই ধরনের একজন ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী, তিনি নিজে বলছেন তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত দূত! আর মজার বিষয় হলো, ভারতীয় ভোটারদের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এমন মানুষ আছেন যারা সত্যিই বিশ্বাস করে নরেন্দ্র মোদি এগুলি সত্য বলছেন। তিনি সত্যিই ভগবানের অবতার, বিষ্ণুর অবতার।
আরও পড়ুন- RSS-এর কৌশল! যে ছকে বারবার মুসলিম ভোট ঘরে আনতে চেয়েছে বিজেপি
বাকি অংশের মধ্যে অনেকে এসব একেবারেই বিশ্বাস করে না। তারা ব্যাঙ্গ করে। এই মানুষরা এতদিন একসঙ্গে ছিল না। এখন ইন্ডিয়া নামে তারা জোট বেঁধেছে। তারা মোদি বা বিজেপিকে কতটা দুর্বল করতে পারবে সে তো ৪ তারিখেই জানা যাবে। কিন্তু মোদি সরকার ১০ বছরে কোন জায়গায় এল? যারা বিনামূল্যে চাল, ডাল, রেশন পাচ্ছেন সবটাই কি নরেন্দ্র মোদির জন্য? কিছুদিন আগেও পেট্রোল পাম্পগুলিতে মোদির ছবি দেখা যেত। যারা কম দামে রান্নার গ্যাস পাচ্ছেন, সবটাই কি নরেন্দ্র মোদির জন্য? উল্টোদিকে তাকাই। টানা প্রায় ১ বছর ধরে কৃষকরা আন্দোলন করলেন। আন্দোলনের জেরে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন ফেরত নিতে হলো বিজেপি সরকারকে। সেটাও কি নরেন্দ্র মোদির জন্য? ২০১৬ সালের নভেম্বরে ডিমনিটাইজেশন হলো। সেই কথা মোদি আর বলেন না, জিএসটির কথা আর বলেন না। ২০২০ সালের মার্চ মাসের সেই ভয়াবহ কোভিড মহামারীর কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন? ভারতের ইতিহাসে সেই প্রথম কোটি কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হলেন। মোদি বললেন করোনা তাড়াতে থাকা বাজান! খুব কি দরকার ছিল এর? এসব নিয়ে মোদি আজকাল কিচ্ছু বলেন না। এই মানুষটি কি আদৌ একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ? আমরাও প্রশ্ন করি না আর।
২০২৪ সালের লোকভা নির্বাচনের গোটা প্রচারে তিনি কেবল হিন্দু-মুসলিমই করে গেলেন। বললেন কংগ্রেসকে ভোট দিলে হিন্দুদের সম্পত্তি মুসলমানরা নিয়ে নেবে। হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়া হবে। মোদি বোঝাতে চাইলেন কংগ্রেসকে সমর্থন করলে তোমাকে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে, তুমি দেশদ্রোহী। এই ধরনের নির্বাচনী প্রচারের প্রভাব কি সাধারণ মানুষের উপর পড়েনি? ১৪০ কোটির এই দেশে একজন শক্তিশালী নেতা দরকার। তবে মোদিই একমাত্র সেই নেতা, এই ভুল ভাঙবে কারা? যারা বিশ্বাস করে না ৫৬ ইঞ্চি ছাতির নেতা ছাড়া জগৎ শূন্য, যারা বিশ্বাস করে না মোদি ভগবানের দূত তারা কি জোট বাঁধতে পারল সত্যিই? ইন্দিরার বিরুদ্ধে যেমন ১৯৭৭ সালে জোট বেঁধেছিলেন বাকিরা, তেমনটা কি এবার হবে? ২০০৪ সালে যেমন অটল বিহারী, লালকৃষ্ণ আডবানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সবাই, হবে এবার? যদি না হয়, কী হবে উত্তর জানা।
আরও পড়ুন- দেশেবিদেশে কতটা রয়েছেন গান্ধি? ভোটের বাজারে আদৌ কতটা সত্যি বলেন মোদি?
মোদি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন তিনি কী করবেন আর কী করবেন না বোঝা যায়। এককালে তিনি বলেছিলেন ভারতের বাইরে যে ভারতীয়দের কাছে কোটি কোটি 'কালাধন' আছে তা তিনি ফেরত আনবেন। সব গরিব পরিবার নাকি ১৫ লক্ষ টাকা পাবে। সেসব কিছুই হলো না। মোদি বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা'। তিনি জোর গলায় ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেন, তাতে কি দেশে ভ্রষ্টাচার কমে গেল? আমাদের দেশের বেকার যুবক-যুবতীরা কি চাকরি পেল? সবজি, ফল, তেল, দুধের যে হু হু করে দাম বাড়ল, তাতে লাগাম টানতে কি পারলেন মোদি? আমাদের দেশে গরিবের আয় আর আম্বানি-আদানির আয়ের যে বিপুল ফারাক, যা ব্রিটিশ আমলকেও হার মানায় মোদি তা নিয়ে কী করলেন? এগুলো কি নির্বাচনী ইস্যু নয়? কেবল হিন্দু-মুসলিম, শ্মশান-কবর, রামমন্দিরেই আটকে গেল দেশটা? এত ঘৃণা, এত হিংসা খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রচার করছেন, নির্বাচন কমিশন কিছুই করছে না।
এবার যদি মোদিই ফেরেন, ৮০ কোটি মানুষ আবারও বিনামূল্যে রেশন পাবেন কিনা জানা নেই। মোদির অসংখ্য গ্যারান্টির ভবিষ্যৎ জানা নেই। কংগ্রেসও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বলছে ক্ষমতায় এলে মহিলাদের ১ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা। এসবের ভবিষ্যৎ সত্যিই গণনা করে বলা যায় না। মোদি দুর্বল হয়ে ফিরলে কী হবে, ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে কী হবে এসবের মাঝে একটিই প্রশ্ন ভাবায়, দেশের একজন সত্যিকারের নেতা কে হবেন? কে আছেন আমাদের স্বপ্ন দেখানোর মতো আর!