জিএসটি-র কোপে চড়ছে দাম, কতটা ক্ষতির সম্মুখীন সাধারণ মানুষ?

শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, সোমবার থেকে দামি হতে চলেছে চিকিৎসা-পরিষেবা, শিক্ষা-সংক্রান্ত পণ্য থেকে শুরু করে আরও অনেককিছুই। বাড়ি তৈরির ইট থেকে শুরু করে পেনসিল সূক্ষ্ম করার শার্পনার পর্যন্ত হতে চলেছে মহার্ঘ।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইতিমধ্যেই ত্রস্ত ভারতের সাধারণ মানুষ। সরকারি কর্মী ছাড়া বেসরকারি ক্ষেত্রে নিচুতলার কর্মীদের অবস্থা হয়ে উঠেছে আরও খারাপ। বেতন বৃদ্ধি না হলেও প্রতিদিন দাম বাড়ছে  নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট মোতাবেক, ইতিমধ্যেই ভারতের মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছে গিয়েছে প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতের মতো এরকম একটা বিপুল সংখ্যা দেশের জন্য এটা মোটেও খুব একটা ভালো সংকেত নয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য তো একেবারেই নয়। তবে তারই মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য রয়েছে আরও একটি খারাপ খবর। আজ, অর্থাৎ সোমবার, ১৮ জুলাই থেকেই সারা ভারতে বেশ কিছু পণ্যের ওপর থেকে কর ছাড়ের সুবিধে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তে চলেছে জিএসটি হার। ফলে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু জিনিসের।

শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, সোমবার থেকে দামি হতে চলেছে চিকিৎসা-পরিষেবা, শিক্ষা-সংক্রান্ত পণ্য থেকে শুরু করে আরও অনেককিছুই। বাড়ি তৈরির ইট থেকে শুরু করে পেনসিল সূক্ষ্ম করার শার্পনার পর্যন্ত হতে চলেছে মহার্ঘ। দামি হচ্ছে আটা, চাল, পনির এবং দইয়ের মতো বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। লেবেল লাগানো প্যাকেটজাতীয় খাবারের ওপরে বসছে পাঁচ শতাংশ পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি)। হাসপাতালে যে সমস্ত শয্যার ভাড়া ৫০০০ টাকা বা তার বেশি, সেগুলোর ওপরেও বসছে পাঁচ শতাংশ করে কর। জিএসটি কাউন্সিলের ৪৭তম বৈঠকে নেওয়া হলো এই সিদ্ধান্ত, যা সাধারণ মানুষের পকেটের ওপরে একটা জোর ধাক্কা দেবে বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

কারা মূল ক্ষতিগ্রস্ত? আর কারা হবে লাভবান?
জুন মাসের শেষের দিকে ভারতের উচ্চপদস্থ মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, "স্বীকৃত মেট্রোলজি আইন অনুযায়ী এবার থেকে প্যাকিং করা এবং লেবেল লাগানো হয়, এমন সমস্ত ধরনের প্রোডাক্টের উপরে বসবে জিএসটি। পাঁচ শতাংশ করে এই সমস্ত প্রোডাক্টের ওপরে ধার্য হবে পণ্য পরিষেবা কর। আপনি দই কিনুন, লস্যি কিনুন অথবা ঘোল কিনুন, যদি সেটা আগে থেকে প্যাকিং করা অবস্থায় থাকে, এবং তাতে কোনও কোম্পানির লেবেল লাগানো থাকে, তাহলেই সেই সমস্ত জিনিস হয়ে যাবে জিএসটি আওতাভুক্ত।"

আরও পড়ুন: অল্প লগ্নিতে আয় বাড়বে বহুগুণ, জেনে নিন এই স্টক শেয়ারের সুবিধেগুলি

জিএসটি হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ফিনটেক সংস্থা ক্লিয়ার ট্যাক্সের চিফ একজিকিউটিভ অফিসার অর্চিত গুপ্ত বলছেন, "ভারতের জিএসটি হার বৃদ্ধি মূলত তাদের জন্যই অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে চলেছে, যারা ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের বেনিফিট গ্রহণ করতে পারে না, অর্থাৎ ক্রেতারা। মধ্যবর্তী কোম্পানি এবং কোনও শপিং মলের জন্য এই শুল্কবৃদ্ধি খুব একটা সমস্যাজনক হওয়ার কথা নয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী যারা মহার্ঘ ভাতা পাবেন, তাদের জন্য এই জিএসটি খুব একটা বড় প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ভারতের নতুন পণ্য পরিষেবা কর নিয়ম তাদের জন্য হতে চলেছে অত্যন্ত ভয়ংকর, যারা কিনা এই দুই শ্রেণির একটিরও আওতাভুক্ত নন। যেভাবে প্রত্যেকদিন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি আবার কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এইভাবে জিএসটি বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য সংসার চালানো হয়ে পড়বে অত্যন্ত সমস্যার। এতদিন পর্যন্ত দই, ঘোল, লস্যি, পনিরের মতো দুগ্ধজাত জিনিসগুলি জিএসটির আওতাভুক্ত ছিল না। কিন্তু এখন থেকে যদি আপনি এই সমস্ত জিনিস কেনেন, তাহলে আপনাকে দিতে হবে অতিরিক্ত পণ্য-পরিষেবা কর। তার পাশাপাশি লেবেল লাগানো ব্র্যান্ডেড চাল থেকে শুরু করে আটা, ময়দা, ডাল- সমস্ত ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পাবে মূল্য। যার কারণে সাধারণ মানুষ পড়বেন আরও সমস্যায়।"

তিনি আরও বলছেন, "তবে জিএসটি বৃদ্ধির একটা অন্য দিকও রয়েছে। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে জিএসটি বৃদ্ধি করা হয়েছে ব্র্যান্ডের লেবেল দেওয়া যে কোনও জিনিসের ক্ষেত্রে। কিন্তু যদি সেই জিনিস হয় আনব্র্যান্ডেড, অর্থাৎ তার ওপর যদি কোনও বিশেষ কোম্পানির লেবেল না লাগানো থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে সেই সমস্ত জিনিসের ওপর পড়বে না কোনও অতিরিক্ত জিএসটি কর। অর্থাৎ যারা এই ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করে, তাদের জন্য কিন্তু এই করবৃদ্ধি হতে পারে একটা সুবর্ণসুযোগ।"

কোন কোন জিনিসের দাম বাড়ছে?
এতদিন পর্যন্ত যখন জিএসটি হার বৃদ্ধি করা হতো, তখন নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি হতো ট্যাক্স। তবে এবার একেবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পর্যন্ত আপনাকে কিনতে হবে জিএসটি দিয়েই। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বম্মাইয়ের নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রিসভার তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই মুহূর্তে ভারতে এমন কিছু জিনিস রয়েছে, যেখানে কর ছাড়ের যৌক্তিকতা নেই। সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর দাম, ক্যাসিনো, ঘোড়ার রেসিং এবং অনলাইন গেমিংয়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত তেমন একটা জিএসটির প্রভাব নেই। তাই এই সমস্ত জায়গায় জিএসটি বসানো যেতেই পারে। পাশাপাশি, এমন বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এই মুহূর্তে ভারতে রয়েছে, যেগুলোর ওপর জিএসটির পরিমাণ খুবই কম। তাই সেগুলোর ওপরেও বসানো যেতে পারে নতুন জিএসটির হার।

এই সমস্তকিছুর বিচার করে মন্ত্রিসভার তরফ থেকে একেবারে নতুন একটি জিএসটি চার্ট তৈরি করা হয়েছে। এই চার্ট অনুযায়ী ক্যাসিনো, হর্স রেসিং এবং লটারির ওপরে ২৮ শতাংশ জিএসটি দেওয়া হয়েছে। তবে এই ২৮ শতাংশ জিএসটি এখনই প্রবর্তিত হচ্ছে না। আগস্ট মাসে মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত হতে চলা পরবর্তী জিএসটি কাউন্সিল বৈঠকে এই তিনটি ক্যাটেগরির জিএসটি নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে।

এই তিনটি ক্যাটেগরির জিনিস সকলের জন্য প্রয়োজনীয় না হলেও এমন অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে, যেখানে ভারত সরকারের তরফ থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে করের বোঝা। এলইডি লাইট, লেখার, প্রিন্ট করার অথবা ড্রয়িং করার কালি, বিদ্যুৎচালিত পাম্প, টেট্রা প্যাক, ছুরি, ব্লেড, পেনসিল শার্পনার, চামচ, কাঁটা চামচ, হাতা, কেক কাটার ছুরি, মেটাল সার্কিট বোর্ড, রাস্তা, ব্রিজ, রেল, মেট্রো, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, চুল্লির কাজের জন্য চুক্তির ওপরে আছে ১৮ শতাংশ কর। এই করের পরিমাণ আগে ছিল ১২%। এছাড়াও পরিষ্কার করার মেশিন, বীজ, ডাল, বাছাই করার এবং পেষাই করার মেশিন, ডিম, ফল, অন্যান্য চাষ-উৎপাদিত জিনিস, ডেয়ারি মেশিনের ওপরেও ১৮% পণ্য পরিষেবা কর চালু করা হয়েছে ভারত সরকারের তরফ থেকে।

সোলার ওয়াটার হিটার ও সিস্টেম, চামড়ার যে কোনও জিনিস, জুতো, চামড়ার জুতো তৈরি করার সঙ্গে যুক্ত যে কোনও কাজ, কেন্দ্রীয় সরকার অথবা রাজ্য সরকারের যে কোনও ধরনের কাজের কন্ট্রাক্ট, পেট্রোলিয়াম অথবা কোল বেড মিথেনের ওপরে জিএসটি হয়েছে ১২ শতাংশ। এই জিএসটি আগে ছিল ৫ শতাংশ। এছাড়াও পালিশ করা হিরের ওপরে জিএসটি ০.২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১.৫ শতাংশ। কর ছাড়ের সুবিধে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্কের চেক পরিষেবার ওপর থেকে। এখন থেকে এই চেক পরিষেবা পেতে হলে আপনাকে ১৮ শতাংশ জিএসটি দিতে হবে। তার পাশাপাশি ম্যাপ, হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট, অ্যাটলাস, বিশ্বের ম্যাপ, টোপোগ্রাফিক্যাল প্ল্যান এবং গ্লোবের ওপরে জিএসটি বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ শতাংশ। এছাড়াও, দিনপিছু ১০০০ টাকার থেকেও কম ভাড়ার হোটেলের ওপরেও পড়বে ১২ শতাংশ করে পণ্য পরিষেবা কর।

তবে সব জিনিসের যে জিএসটি বৃদ্ধি পেয়েছে, তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু জিনিস এমন রয়েছে, যেখানে কর কমানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থোপেডিক সমস্ত ধরনের যন্ত্র, ভেঙে যাওয়া হাড় ঠিক করার সমস্ত যন্ত্র, অর্থোপেডিক প্লেট, চোখের কনট্যাক্ট লেন্স, এই সমস্ত জিনিসের ওপর করের পরিমাণ ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পণ্যের পরিবহন, রোপওয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের পরিবহনের ওপরে কর ১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে করে দেওয়া হয়েছে ৫ শতাংশ। এছাড়াও ট্রাক ভাড়ার ওপরে করের পরিমাণ ১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১২ শতাংশ।

কোন কোন পরিষেবা এবার থেকে হচ্ছে দামি?
যেহেতু আজ থেকে ভারতে বিক্রি হওয়া সমস্ত ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উপরে ৫ শতাংশ করে জিএসটি চালু হতে চলেছে, সেই কারণে এবার থেকে বৃদ্ধি পাবে খাবার জিনিসের দাম। আপনি মাছ কিনুন, দই কিনুন অথবা কিনুন সোয়াবিন, আপনাকে ৫ শতাংশ করে জিএসটি দিতেই হবে। এই সমস্ত জিনিস এতদিন জিএসটি-র আওতাভুক্ত ছিল না। হোটেলে থাকার দামও বৃদ্ধি পাবে অনেকটাই। এলইডি ল্যাম্প এবং লাইটের দাম বাড়বে, ব্যাঙ্কের চেক পরিষেবাও হয়ে উঠবে দামি।

একধাক্কায় অনেকটা বৃদ্ধি পাবে চাষের খরচ। এতদিন পর্যন্ত সাবমার্সিবল পাম্প, টারবাইন পাম্প এবং সাইকেল পাম্পের ওপর ১২ শতাংশ করে জিএসটি দিতে হতো। তবে এবার এই জিএসটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮%। সোলার হিটারের ওপর জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করায় তার দাম বৃদ্ধি পাবে। ব্যয়বহুল হবে স্বাস্থ্য পরিষেবা। সোমবার থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। ৫০০০ টাকার ঊর্ধ্বে হাসপাতালে কেবিনে ৫ শতাংশ করে জিএসটি ধার্য করা হয়েছে। বায়োমেডিক‍্যাল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ সুবিধের ওপর ধার্য করা হয়েছে বারো শতাংশ করে জিএসটি। এই সমস্ত দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ পড়বেন সমস্যায়। সর্বোপরি, দামি হতে চলেছে শিক্ষাব্যবস্থাও। বাচ্চাদের লেখাপড়ায় যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার হয়, সেই সমস্ত জিনিসের ওপরে জিএসটির পরিমাণ বাড়তে চলেছে। চামড়ার সামগ্রী, জুতো থেকে শুরু করে মানচিত্র, গ্লোব এবং চার্ট- সবকিছু হতে চলেছে মহার্ঘ।

কেন এমন সিদ্ধান্ত?
২০১৭ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের তরফ থেকে প্রবর্তন করা হয়েছিল জিএসটি। সেই সময় ভারত সরকার জানিয়েছিল, এটি ভারতীয় করব্যবস্থাকে আরও সুবিধেজনক করে তুলবে এবং ভারতীয় পণ্য পরিষেবা কর ভারতীয়দের জন্য হবে আরও সহজ। সারা দেশে একইরকম কর ব্যবস্থা নিয়ে আসার লক্ষ্যে এবং কর পরিষেবাকে আরও সুবিধেজনক করার উদ্দেশ্যে ভারত সরকারের তরফ থেকে এই জিএসটি নিয়ে আসা হলেও, আদতে এই জিএসটি ব্যবস্থাটি অত্যন্ত জটিল। এই জুলাই এই পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে জিএসটি ব্যবস্থার। কংগ্রেস নেতা তথা ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম একটি হিসেব পেশ করে দেখিয়েছেন, এই পাঁচ বছরে সরকার গড়ে প্রতি দুই দিনে একবার করে জিএসটি নিয়মে ছোটখাটো পরিবর্তন করেছে। বিরোধীদের হিসেব খানিকটা অতিরঞ্জিত হলেও পাঁচ বছরের ব্যবস্থাটি যে খুব একটা স্থিতিশীল নয়, সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মূলত এর কারণটি রাজনৈতিক। জিএসটি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল ভারতের অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ধর্ম অনেকাংশে বিসর্জন দিয়েই। 'এক দেশ এক কর' ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে, ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্যকে পরোক্ষ কর আদায়ের অধিকার ত্যাগ করতে হয়েছিল। ফলে, এক বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল প্রত্যেকটি রাজ্য।

বিগত পাঁচ বছরের জন্য জিএসটি কাউন্সিলের তরফ থেকে রাজ্যগুলিকে এই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হলেও এই ক্ষতিপূরণের সময়কাল আর খুব একটা দীর্ঘ করতে চাইছে না জিএসটি কাউন্সিল। এমনিতেই, ২০১৯-'২০ এবং ২০২০-'২১ অর্থবর্ষ ভারতের জন্য খুব একটা ভাল ছিল না। এই সময়কালে ভারতের একটা বিশাল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে। প্রথমে যখন জিএসটি নিয়ে আসা হয়েছিল, অনেকে মনে করেছিলেন জিএসটি পরিষদের মাধ্যমে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রের পন্থায় এই করব্যবস্থা পরিচালিত হতে চলেছে। কিন্তু এরকমটা কখনওই হয়নি। বারে বারে অভিযোগ উঠেছে, জিএসটি পরিষদে বিজেপির আধিপত্যের কারণে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। এমনকী, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর কথাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে, বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের সরকার তাদের রাজ্যের স্বার্থকেও বিসর্জন দিয়েছে।

এবার আসছে জিএসটি-র জটিলতার বিষয়টা। কোনও একটি জিনিস তৈরি করতে গেলে, তার আগে একাধিক কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। কিন্তু জিএসটি ব্যবস্থায় এই সমস্ত কাঁচামালগুলির একেকটির দাম এক একরকম। অন্যদিকে, অন্তিম পণ্যটির আবার জিএসটি অন্যরকম। এর ফলে তৈরি হয় একটা অসামঞ্জস্য। দুনিয়ায় যতগুলি দেশে জিএসটি ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার মধ্যে ভারতের জিএসটি সবথেকে জটিল। একই গোত্রের বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করের ফারাক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গুড অ্যান্ড সিম্পল ট্যাক্স হিসেবে জিএসটিকে বর্ণনা করলেও, জিএসটি যে অত্যন্ত জটিল, তা প্রত্যেক অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ একাধিকবার বলে এসেছেন।

কর ব্যবস্থার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইনপুট ক্রেডিট। এই আলোচনায় এর আগেও ইনপুট ক্রেডিটের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টা সহজ করে বলতে গেলে, অন্তর্বর্তী পণ্যের ওপর প্রদেয় করের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা হলো এই ইনপুট ক্রেডিট। বিভিন্ন কারণে এই প্রক্রিয়াটি খুব একটা ভালোভাবে সম্পন্ন করা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। তার ওপর পেট্রোল এবং ডিজেল জিএসটির আওতায় না থাকার কারণে, তার পিছনে যে টাকা খরচ হয় তার ইনপুট ক্রেডিট পাওয়া যায় না। এই কারণে উৎপাদনের ব্যয় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কর আদায়ের পরিমাণ প্রত্যাশিত হারের তুলনায় অনেকটাই কম বিগত কয়েকটি আর্থিক বছরে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের আয় কমেছে, তেমনই পাঁচ বছরে পূরণ হয়নি রেভিনিউ নিউট্রালিটির শর্ত।

কাউন্সিলের তরফ থেকে শেয়ার করা একটি রেভিনিউ চার্ট থেকে পরিষ্কার হয়েছে, কেন্দ্রীয় জিএসটি বাদ দিলে রাজ্যের জিএসটি-ও গত আর্থিক বছরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০-'২১ আর্থিক বছরে যেখানে ৩৭.৯ শতাংশ ছিল রাজ্য জিএসটি রেভিনিউর পরিমাণ, সেখানে এই আর্থিক বছরে রাজ্য জিএসটির রেভিনিউ মাত্র ২৭.২ শতাংশ ভারতের ৩১টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে মাত্র পাঁচটি রাজ্য এমন রয়েছে যেখানে, এই আর্থিক বছরে রাজ্য জিএসটি রেভিনিউ ছিল ভালো। এই ৫টি রাজ্য হল অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ও সিকিম। অন্যদিকে, যে-সমস্ত রাজ্যের ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জিএসটি রেভিনিউ সবথেকে খারাপ, তাদের মধ্যে রয়েছে পণ্ডিচেরি, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ এবং ছত্রিশগড়। বাকি ভারতের বড় রাজ্যগুলিও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এপ্রিল মাসের তুলনায় জুন মাসে ভারতের সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ কিছুটা নিম্নমুখী হয়ে ৭.০১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরবিআই-নির্ধারিত ৬ শতাংশের সহনসীমার থেকেও কিছুটা বেশি। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে এই মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের এই জিএসটি বৃদ্ধি করাটা ছিল পূর্বনির্ধারিতই।

কতটা প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর?
১৮ জুলাই থেকে যেভাবে ভারতের অর্থনীতির ওপরে একটি নতুন করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটাই পরিবর্তিত হবে একধাক্কায়। বিশ্বজুড়েই মূল্যবৃদ্ধি মাথা চড়া দিলেও ভারতে যেরকম ভাবে করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা মাত্রাতিরিক্ত। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, ঋণের ওপরে চড়া সুদ, পড়তি টাকা, দামি তেল, সবকিছুর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি একেবারে বিপর্যস্ত। ফলে শেয়ার বাজার অস্থির। আকর্ষণ অনেকটাই কমেছে ইকুইটি ফান্ডের। গত কয়েক মাসে কিছু নামমাত্র ফান্ড রিটার্ন দিতে পেরেছে। অধিকাংশ ফান্ড এই মুহূর্তে চলছে লোকসানে। এসআইপি একাউন্ট খোলার হার অনেকটাই কমেছে জুন মাসে, বেড়েছে বন্ধর সংখ্যা।

লগ্নিকারীদের পোর্টফোলিওর গড় মূল্য অনেকটাই নিম্নমুখী। আগের ১২ মাসে বাজারে মোট শেয়ার দরের নিরিখে বড় মাপের সংস্থানির্ভর এসআইপি রিটার্ন তলিয়েছে শূন্যের ১০ শতাংশ নিচে। ব্যাঙ্কের সুদ ফান্ডে লগ্নির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হলেও এপ্রিল থেকে জুন মাসের ফলে তেমন একটা কিছু মনে হচ্ছে না। তার মধ্যে আবার ব্যাপক জিএসটি বৃদ্ধি সমস্যায় ফেলবে সাধারণ মানুষকে। কেন্দ্র দাবি করে, আয়করের জাল সম্প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু আদতে সিংহভাগ মানুষই কিন্তু কর প্রদান করেন না। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে জিএসটি বাড়িয়ে। অযৌক্তিকভাবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে করের বোঝা। সরকার যদি সাধারণ মানুষের কথা ভাবতোই, তাহলে কর্পোরেট করের হার কমিয়ে মুড়ির মতো জিনিসের কর বৃদ্ধি করা হতো না। জিএসটির হার বৃদ্ধি এই মূল্যবৃদ্ধিকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে। সাধারণ মানুষ হয়তো নিজের শখের জিনিস কেনা থেকে এবার বিরত থাকবেন। ফলে কমবে ক্রেতার সংখ্যা, সমস্যায় পড়বেন বিক্রেতারা। তাদের ব্যবসাতেও শুরু হবে ভাটার টান। এর জেরে ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ বেশ ক্ষুব্ধ। ব্যবসায়ী সংগঠন সভাপতি সুশীল কুমার পোদ্দার বলছেন, "যখন জিএসটি চালু করা হয়েছিল, তখন পণ্যের দাম কমবে বলে জানিয়েছিল মোদি সরকার। বাস্তবে কিন্তু বাড়ছে। ১০০০টি সংশোধন নিয়ে এসে এই ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে দেওয়া হচ্ছে।"

তার পাশাপাশি আবার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, ভরতুকির অঙ্ক নাকি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরও কমতে চলেছে। চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্য ছুঁতে একেবারে বদ্ধপরিকর ভারত সরকার। তাই যদি এভাবেই জিএসটি হার বৃদ্ধি পায় এবং ভর্তুকি আরও কমে, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ যে আরও সমস্যার হতে চলেছে, এটাতে আর কোনও সংশয়ের অবকাশ থাকে না।

More Articles