আকাশের বুকে বয়ে যাচ্ছে নদী, আর তাতেই হু হু করে বাড়ছে তাপমাত্রা?
সাহারা মরুভূমিতে তুষারপাতের ঘটনা কয়েকবছর আগেই শোনা গেছে। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের (Atmosphere) মধ্য দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে, একথা কেউ কোনওদিন শুনেছে? হ্যাঁ, বিশ্ব উষ্ণায়ণের কল্যাণে সেও সম্ভব হয়েছে বটে।
মেরু অঞ্চলে বরফ গলে, সেই বরফ থেকে তৈরি আর্দ্রতা (Moisture) আকাশের বুকে এই ধরনের 'নদী' ('River in the sky') তৈরি করে। আর সেই নদী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গরম বাতাস আর জলীয় বাষ্প বয়ে নিয়ে যায়। আর তার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে আরও বাড়ে তাপমাত্রা। আর উষ্ণায়নের ফলে দাবানলের শিকার হয়েছে বিভিন্ন প্রান্তের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। বাদ যায়নি আমাজনের জঙ্গলও।
আকাশের বুকে নদী, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি দাবানল, কিংবা ধরুন হিমবাহের নিরন্তর গলনের ঘটনাকে নজরে রাখার জন্য নীল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে একাধিক স্যাটেলাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে।বহুদিন ধরেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস, দাবানল, হিমবাহের গলন, প্রভৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জার্মানিতে তৈরি সাম্প্রতিক 'নেক্সট জেনারেশন' স্যাটেলাইট- দ্য এনভায়রনমেন্ট ম্যাপিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস প্রোগ্রাম (The Environmental Mapping And Analysis Program) বা এনম্যাপ (EnMap) জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের নজরদারির সংজ্ঞা বদলে দিতে চলেছে। কিন্তু কীভাবে? কেনই বা সে আলাদা, বাকি স্যাটেলাইটের থেকে?
আরও পড়ুন: কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল ডাইনোসর? এতদিনে জানতে পারলেন বিজ্ঞানীরা
এই 'নেক্সট জেনারেশন' স্যাটেলাইটের ক্ষমতা রয়েছে ২৫০টি আলাদা আলাদা রং ব্যবহার করে আবহাওয়ার পরিবর্তন, বায়ু, জল ও মৃত্তিকা দূষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র তুলে ধরার। আর সেই স্যাটেলাইট চিত্রে এতগুলি রঙের ব্যবহার কেবল দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যই তুলে ধরবে না। এসবের পাশাপাশি হাই রেজোলিউশন ইমেজ তৈরির ক্ষমতাও রাখে এই স্যাটেলাইট। তাই সেই চিত্রের গুণগত মান বেশিই হবে সচরাচর ব্যবহৃত স্যাটেলাইটের থেকে। স্বাভাবিকভাবেই এই স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনেক বেশি নির্ভুল ও পুঙ্খানুপুঙ্খ হবে।
বৈজ্ঞানিকদের মতে, আমরা যত দ্রুত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে বলে ভেবেছিলাম, তার থেকেও অনেক দ্রুত বাড়ছে সেই তাপমাত্রা। আমরা আবহাওয়া এবং পরিবেশ-সংক্রান্ত পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছি হাড়েহাড়ে। পৃথিবীকে বাঁচাতে এখনই বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের আশু প্রয়োজন, যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। আর তার জন্য প্রয়োজন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পরিবেশের ঠিক কী কী পরিবর্তন হচ্ছে তা নজরে রাখা।
এনম্যাপের সাহায্যে পৃথিবীতে কী হারে জল, বাতাস এবং মাটি দূষণ হচ্ছে, তা মাপা যাবে, কেবল এই স্যাটেলাইটের চোখে ধরা পড়া চিত্র থেকেই। পাশাপাশি মাপা যাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে (Real-time) মানুষের কারণে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ। এই নেক্সট জেনারেশন স্যাটেলাইট নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থাৎ অরণ্য, ভূমি, জল, এবং বায়ুকে রক্ষা এবং সংরক্ষণে সাহায্য করা। এমন নয় যে, এযাবৎ ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলি এই কাজ করেনি। কিন্তু এত নিঁখুতভাবে এই তথ্যগুলিকে তুলে ধরার ক্ষমতা এযাবৎ ব্যবহৃত কোনও স্যাটেলাইটের ছিল না, এমনটাই দাবি বিজ্ঞানীদের।
এনম্যাপ সাহায্য করবে রিয়েল টাইমে, অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা নজরে রাখতে। এমনকী, এর থেকে পাওয়া খুঁটিনাটি তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যাবে, প্রকৃতির যে পরিবর্তনগুলি হচ্ছে, সেগুলি আদৌ স্বাভাবিক, না কি তার নেপথ্যে আদতে মানুষের হাত রয়েছে।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের মতে, এনম্যাপের মতো নেক্সট জেনারেশন স্যাটেলাইটের সাহায্যে পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-সংক্রান্ত আরও ভরসাযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে। যে তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে আগামীতে জলবায়ুর পূর্বাভাস-সংক্রান্ত গাণিতিক মডেল বানানো সম্ভব হবে। সম্ভব হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ধারণা দেওয়াও।
এরোস্পেস-এর ফেডেরাল গভর্নমেন্ট কমিশনার (Federal Government Commissioner of Aerospace) অ্যানা ক্রাইস্টম্যানের (Anna Christman) মতে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তুলে ধরা পরিবেশ-সংক্রান্ত নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য না পেলে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন কী হারে হবে বা তার প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, তা নির্ভুলভাবে ধারণা করা প্রায় অসম্ভব।
চলতি মাসের শুরুতেই স্পেস এক্স ফ্যালকন নাইনের (SpaceX Falcon 9) সাহায্যে এই স্যাটেলাইটির উৎক্ষেপণ (Launch) সম্ভব হয়েছে ফ্লোরিডা থেকে। এবার শুধু তথ্য পাওয়ার অপেক্ষায় বিজ্ঞানীরা।