মেঘ পাতলা করা, সূর্যরশ্মি আটকে দেওয়ার নামে যে বিপুল ক্ষতি করছেন জিও-ইঞ্জিনিয়াররা

জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ থেকে কৃত্রিমভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা এবং পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসা সূর্যরশ্মিকে কৃত্রিমভাবে প্রতিফলিত করে আবার মহাকাশে পাঠিয়ে দেওয়া।

ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশনের মতে, ২০২৪ সাল ইতিমধ্যেই উষ্ণতম বছর হিসেবে গণ্য হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। কোপারনিকাস অ্যান্ড দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট ঘোষণা করেছে, ২০২৪ সালে এই প্রথমবার পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে। অথচ বিগত দশকে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা বারেবারে সাবধানতা অবলম্বনের আর্জি জানিয়েছেন, যাতে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা আরও ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস না ছাড়িয়ে যায়। এই বছরই ভারতসহ বিশ্বের প্রতিটি জায়গায় এক-একদিনের গড় তাপমাত্রা পুরনো সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে এবং প্রতিটি নতুন দিনকে সেই বছরের উষ্ণতম দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে পৃথিবীর নানা কোণে একইসঙ্গে একাধিক বড়সড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরও আমরা পেয়েছি চলতি বছরে।

জিওইঞ্জিনিয়ারিং কী?

বিশ্বের বিভিন্ন কোণে যখন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাড়বাড়ন্ত, তারই মধ্যে একাধিক সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের। যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ থেকে কৃত্রিমভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা এবং পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসা সূর্যরশ্মিকে কৃত্রিমভাবে প্রতিফলিত করে আবার মহাকাশে পাঠিয়ে দেওয়া। সোজা কথায় পরিবেশে সূর্যের আলোর স্বাভাবিক চলাচল কমিয়ে দেওয়া। যাতে কৃত্রিমভাবে পরিবেশের তাপমাত্রা কমানো যায়। এদিকে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিলেও, পরিবেশে তা কোনও না কোনও ভাবে রয়েই যাবে।

বিশ্বউষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে জিওইঞ্জিনিয়ারিং-ই কি সমাধান?

প্রকৃতিতে কার্বন নিষ্ক্রমণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার মূলে কিন্তু রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির লাগামহীন ব্যবহার, একরের পর একর গাছ কাটা, ক্ষতিকর প্রক্রিয়া অবলম্বন করে কৃষিকাজ করার মতো গুরুতর বিষয়। পাশাপাশি রয়েছে জনবিস্ফোরণের মতো ঘটনা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে সমস্যা খুব সাধারণ হলেও, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বজুড়ে বিলুপ্ত হচ্ছে অসংখ্য জীব। যারা আবার প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব থেকেও বাঁচায়। ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস বা জলবায়ু পরিবর্তনের মূল পরিবর্তনের যা যা কারণ, সেই গুরুতর বিষয়গুলিকে নির্মূল করে না। বরং এই ধরনের প্রযুক্তি প্রকৃতির উপর খোদগারি করে, কৃত্রিমভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। গত সপ্তাহে সমাপ্ত কনফারেন্স অফ পার্টিস-১৬ বা কপ-১৬ সমাবেশে ইটিসি গ্রুপের ল্যাটিন আমেরিকার ডিরেক্টর সিলভিয়া রেবেরিয়ার মতে, ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং ‘টেকনিক্যাল ফিক্স’ মাত্র”। ঠিক যেন বন্যা রোধের জন্য, বাঁধের ফাটলে একটা ব্যান্ড-এডের প্রলেপ দেওয়া।

আরও পড়ুন- Climate Change: আগামী দিনে খেয়ে-পরে বাঁচবে তো মানুষ? যে আশঙ্কার কথা জানালেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা

একই সমাবেশে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল-এর জিওইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পেন ম্যানেজার মেরি চার্চ জানিয়েছেন, “ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং আদ্যোপান্ত ক্ষতিকর এক পদক্ষেপ, যার উদ্দেশ্যই যেন পরিবেশের মূল সমস্যাগুলো থেকে আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করে রাখা।" ইউনিভার্সিটি অফ রিচমন্ডের ভূগোলের গবেষক ও অধ্যাপক ডেভিড কিচেন ‘দ্য কনভার্সেশন’-এর একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং-এর কোনও পদক্ষেপই এ যাবৎ বাস্তবায়িত করা যায়নি। উলটে এর প্রয়োগ তাত্ত্বিক স্তরেই রয়ে গেছে। বড়জোর পাইলট প্রজেক্ট অবধি গড়িয়েছে। মেরি চার্চ জানাচ্ছেন, “এই প্রজেক্টগুলির প্রত্যেকটি কেবল বেআইনিই নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে পরিবেশ সংরক্ষণের নামে মুনাফা লুটছে এই প্রকল্পগুলির কর্মকর্তারা।"

এই সমস্ত দিক খতিয়ে দেখেই, কপ-১০ ও ১১ অধিবেশনে ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’-এর তরফে নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। যে নির্দেশিকায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, যেন পৃথিবীর কোন প্রান্তেই জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রয়োগ না করা হয়। আর যদি করাও হয়ে কখনও, তার আগে অবশ্যই জিওইঞ্জিনিয়ারিং-এর কুফলগুলিকে যেন তলিয়ে দেখা হয়। সেই ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি নিয়ে যেন জনসাধারণের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাস যেমন দেশের সীমারেখা মানে না, ঠিক তেমনই দেশের গণ্ডি মানবে না জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কুপ্রভাবও। কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি-র মতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পৃথিবীর সামান্য কিছু অংশে সাময়িক লাভ হলেও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তে।

কীভাবে আটকানো হবে সূর্যরশ্মি? কিন্তু তার ফলাফল?

মেঘের সঙ্গে সালফার ডাই-অক্সাইড মিশিয়ে যে পরিমাণ সূর্যের আলো পৃথিবীর দিকে আসে, তার বেশিরভাগটাই আটকে ফেলা হবে। যে সালফার ডাই-অক্সাইডের পুরোটাই জীবজন্তু ও মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর, বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের পক্ষে, যে সালফার ডাই-অক্সাইড বায়ুদূষণের জন্য দায়ী মূল রাসায়নিকগুলির একটি, তা আবার বৃষ্টির সঙ্গে ধেয়ে আসবে পৃথিবীর মাটিতেই। এতে আরও বাড়বে অ্যাসিড বৃষ্টির মাত্রা। ক্ষতি হবে পশুপাখি এবং চাষবাসেরও।

এর পাশাপাশি লক্ষ কোটি কৃত্রিম এরোসল মেশানো হবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে। ২০২২ সালে ‘নেচার জার্নালে’ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই পদক্ষেপের ফলে সারা পৃথিবীজুড়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও বরফপাত ব্যহত হবে। ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও চাষবাসে চরম ক্ষতি দেখা দেবে।

এ ছাড়াও ক্লাইমেট-জিওইঞ্জিনিয়ারিং-এর উদ্দেশ্য আকাশের সাইরাস মেঘ, যা মূলত বেশি উচ্চতায় তৈরি হয়, তা কৃত্রিমভাবে পাতলা করে দেওয়া। পাশাপাশি লক্ষ্য আকাশের মেঘকে কৃত্রিমভাবে আরও বেশি উজ্জল করে তোলা, যাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে যায় উলটো পথে। আর সেটা সম্ভব করে তুলতে জিও-ইঞ্জিনিয়াররা বাতাসে সমুদ্রের নোনা জল স্প্রে করার কথা ভাবছেন। বেশ কিছু জিও-ইঞ্জিনিয়ায়ার আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে ভাবছেন। তাঁরা চাইছেন মহাকাশে আয়না বসাতে, যাতে সূর্যের আলো আবার প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশেই ফিরে যায়। মহাকাশে আয়না বসালে, তাত্ত্বিকভাবে সূর্যরশ্মির ২ শতাংশ আটকে ফেলা যাবে, আর তাতেই নাকি কমানো যাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। ডেভিড কিচেনের মতে এই প্রযুক্তি অন্তত আগামী বিশ বছরের আগে কার্যকরী করা অসম্ভব। শুধু তাই নয় মহাকাশে এক-একটি আয়না বসাতেই খরচ হবে কয়েক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আরও পড়ুন- শহুরে পরিবেশবিদের ডায়েরি : অরিন্দম রায়

কিন্তু যে জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ খনিজ তেল, কয়লার লাগামহীন ব্যবহার, যার ফলে মূলত কার্বনের পরিমাণ হু-হু করে বাড়ে প্রকৃতিতে, সেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার তো কমছেই না, বরং প্রতি বছর বাড়ছে। ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির খরচ সমস্ত পুরনো রেকর্ড ভেঙে প্রতি ঘণ্টায় ১৪০,২৩১ টেরাওয়াটে পৌঁছেছে। সেই বছরেই প্রথম প্রতি দিনে ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল খনিজ তেল খরচ হয়েছে সারা বিশ্বে। ২০২৩ সালেই সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ৪০ গিগাটনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশেছে। এই সংখ্যাটিও পুরনো যাবতীয় সমস্ত রেকর্ড ভেঙেছে।

ডেভিড কিচেন লিখছেন, তাত্ত্বিকভাবে – আবারও পড়ুন, তাত্ত্বিকভাবে এই পদক্ষেপগুলি পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কমালেও প্রকৃতি ও মানুষের উপর এর প্রভাব হবে চরম। যেখানে ইতিমধ্যেই আমরা আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা এবং চরম দিকগুলি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে দাঁড়িয়ে আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রক যে বিষয়গুলি তাদের উপর খোদগারি করলে, হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন ডঃ কিচেন।
কপ-১৬ সমাবেশে ‘ইন্ডিজিনাস এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক’-এর সদস্য অ্যাড্রিয়েন অ্যাকালুক টিটাস ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে মতপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, “ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প ভূমি, জল কিংবা বাতাস, যেখানেই প্রয়োগ করে দেখা হোক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে বা পরিবেশকে সুস্থ করে তোলার সমাধান কিন্তু এই প্রযুক্তি কখনই নয়।"

বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ

ডেভিড কিচেনের মতে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণের প্রযুক্তিতে প্রকৃতি ও জীবজগতের ক্ষতির সম্ভাবনা তুলনামূলক ভাবে কম। বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এবং কারখানাগুলি থেকে তৈরি কার্বনকে সংগ্রহ করে তা সাধারণত মাটির নীচে কোনও রিজার্ভারে জমিয়ে রাখা হয়। বাতাসকে এই পদ্ধতিতে কার্বনমুক্ত করলে, তা পরিবেশের পক্ষে লাভজনক হলেও, সেই রিজার্ভার ভেঙে গেলে চূড়ান্ত ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতির প্রকোপ কেবল ভূস্তরের বাতাসেই নয়, ভূস্তরের নীচে জলভান্ডারেও পড়বে। তবে এই ধরনের প্রযুক্তি শুধু যে খরচসাপেক্ষ তা নয়, এর বাস্তবিক প্রয়োগও খুব সীমিত।

ডঃ কিচেন-সহ পৃথিবীর বহু বিশেষজ্ঞের মতে, বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কিন্তু জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং নয়। তাঁদের মতে গাছ লাগানো এবং গাছকাটা বন্ধ করা একটি অত্যন্ত দরকারি বিষয়। তবে তা-ও যথেষ্ট নয়। পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ কমাতে গেলে গাছ লাগানো ও গাছকাটা বন্ধ করার পাশাপাশি অত্যাবশ্যক একটি পদক্ষেপ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো।

কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি-র নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই বেড়ে চলেছে বেআইনি জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং। হেনরিক বোল ফাউন্ডেশন এবং এটিসি গ্রুপের যৌথভাবে তৈরি জিওইঞ্জিনিয়ারিং মনিটর ম্যাপ থেকে জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে পৃথিবীজুড়ে মোট ৫,০৯০ টি ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট সক্রিয় রয়েছে। এই তালিকায় বাদ নেই ভারত, মায় কলকাতার একটি সংস্থার প্রজেক্টও।
এই জাতীয় প্রজেক্টের প্রস্তাব এবং বাস্তবায়ন চলছে ১৯৭১ সাল থেকেই। যার ৯০% প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ২০০৪ সাল থেকেই। হেনরিক বোল ফাউন্ডেশন এবং এটিসি গ্রুপের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। ঠিক এই সময়ের মধ্যেই সোলার ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপেরিমেন্ট (উল্লেখ্য, এখানে সূর্যরশ্মিকে কাজে লাগিয়ে তাপবিদ্যুৎ তৈরির কথা বলা হচ্ছে না) তিনগুণ বেড়েছে সারা পৃথিবীজুড়ে।

কানাডার সংস্থা প্ল্যানেটারি টেকনোলজি প্রথমে মহাসাগরের মান উন্নত করার লক্ষ্যে একটি ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট শুরু করে ইংল্যান্ডে। স্থানীয় বাসিন্দাদের না জানিয়ে এবং তাদের অনুমতি না নিয়েই। সাম্প্রতিক কালে একটি এনভায়রনমেন্ট ইমার্জেন্সি এজেন্সির অডিট এই প্রজেক্টের কিছু গুরুতর কারচুপি এবং খুঁত প্রকাশ্যে আনে। যেখানে দেখা যায়, এই সংস্থা ইংল্যান্ডেকে ঘিরে রাখা মহাসাগরের সামান্য অংশের মান উন্নত করতে এবং জলদূষণ কমাতে পৃথিবীর ১০০০ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম হাইড্রক্সাইডের জোগান ধ্বংস করে ফেলেছে। আর এই বিপুল পরিমাণ ম্যাগনেশিয়াম হাইড্রক্সাইড খরচ করার পরেও ইংল্যান্ডের ‘ক্লাইমেট টার্গেট’-এর মাত্র ২০ শতাংশ লক্ষ্যপূরণ করতে পেরেছে।

আরও পড়ুন- শুকোচ্ছে আমাজন, চিরতরে বন্ধ হতে চলেছে চকলেটের জোগান?

এদিকে ‘মেক সানসেট’ ও ‘স্টারডাস্ট প্রজেক্ট’ ‘কুলিং ক্রেডিট’ বিক্রি করে মুনাফা লোটা শুরু করেছে। ‘কুলিং ক্রেডিট’ হলো সেই এরোসল, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে প্রয়োগ করে নাকি সূর্যের আলোকে উলটো পথে মহাকাশে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। পাশাপাশি নানা সংস্থা এখন সামুদ্রিক মেঘকে উজ্জ্বল করার কাজ শুরু করেছে। একে আবার ‘ক্লাউড সিডিং’ প্রজেক্টও বলে। যার সাহায্যে মেঘের মধ্যে রাসায়নিক প্রয়োগ করে বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মেরি চার্চের মতে, “কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি-র নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই বেআইনি ভাবে আগাছার মতো বেড়ে চলেছে এই ধরনের ক্লাইমেট জিওইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট।"

ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মানবিক অধিকার

ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং পৃথিবীর সামান্য কিছু অংশের সাময়িক ও সামান্য উপকার করলেও, এর ক্ষতির বোঝা বইতে হয় পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষদের, জানাচ্ছেন ডঃ কিচেন। ‘অ্যালায়েন্স অফ নন-গভর্নমেন্ট র‍্যাডিকাল ইউথ’ বা ‘অ্যাংগ্রি’-র সদস্য আলেয়ান্দ্রো জেইমেস কপ-১৬ অধিবেশনে জানিয়েছেন,

“জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো প্রযুক্তি প্রান্তিক মানুষদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এই তালিকায় রয়েছে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী। জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির ধারক ও বাহকরা আদতে পরিবেশের ভালো চান না। মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি করে বিপুল বাজার তৈরি করে মুনাফা লোটাই এদের উদ্দ্যশ্য।"

এখানে উল্লেখ্য, পৃথিবীজুড়ে যে সমস্ত ক্লাইমেট জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাইলট প্রজেক্ট এই মুহূর্তে জারি রয়েছে, সেই প্রজেক্টগুলির মালিকানা যাঁদের হাতে, তাঁদের সিংহভাগের হাতেই কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনকারী সংস্থা, অটোমোবাইল বা এভিয়েশন সংস্থার মালিকানা রয়েছে। আলেয়ান্দ্রোর মতে, জলবায়ু পরিবর্তন রোখার সমাধান রয়েছে আদিবাসী ও প্রকৃতি-কেন্দ্রিক গোষ্ঠীর মধ্যেই। “ল্যাবরেটরিতে তৈরি কৃত্রিম প্রযুক্তি নয়, প্রকৃতি থেকে হাজার-হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় আহরণ করা জ্ঞানই পরিবেশ রক্ষার উপায়”, কপ-১৬ সমাবেশে জানিয়েছেন তিনি।

More Articles