কেন 'দেশদ্রোহী'র তকমা পরঞ্জয়, অভিসার, ভাষাদের? আসলে ঠিক কী লিখতেন এই সাংবাদিকরা?

NewsClick Journalist : মোদ্দা কথা, দেশের শাসকের স্বাস্থ্যের জন্য উপাদেয় ছিল না নিউজক্লিকের খবর।

ভোরবেলা সোজা বাড়িতে হানা। নিউজক্লিক ওয়েব পোর্টাল দলের কনিষ্ঠ সদস্য, সবে তিন বছর ধরে কাজ করছেন সংস্থায়। সেই কপি এডিটরের বাড়িতে ভোর ৬ টায় হানা দিল পুলিশ। পুলিশি অভিযান চলল তিন ঘণ্টা ধরে। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল যে ৫০ জনের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল তাঁদেরই একজন ছিলেন তিনি। অভিযোগ কী? বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের বিভিন্ন ধারা এবং ষড়যন্ত্র (ধারা ১২০ বি, আইপিসি), ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার করা এবং সম্প্রীতি নষ্টের জন্য ক্ষতিকর কাজ করার (১৫৩ এ) অভিযোগ রয়েছে এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। কেন এত ধরপাকড় স্বাধীন সাংবাদিকদের? কেন ইউএপিএ-র মতো কঠোর ধারা প্রয়োগ তাঁদের বিরুদ্ধে? কী এমন খবর করতেন তাঁরা?

নিউজক্লিকের এই সাংবাদিক জানিয়েছেন, তাঁর যাবতীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস মানে মোবাইল, ল্যাপটপ এবং পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ার সময় পুলিশ তাঁকে জানায় যে ৯৬ টি জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশ এই সাংবাদিককে এও জিজ্ঞাসা করে যে, কৃষকদের প্রতিবাদ এবং দিল্লির হিংসা নিয়ে তিনি যে প্রতিবেদনগুলি লিখেছিলেন তার জন্য তাঁকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়েছিল কিনা। এখানেই শেষ না, পুলিশ এও জানতে চায় যে কেন দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে কথা লিখেছেন তিনি? সবে তিন বছর হলো কাজ করছেন। এমন কিছুই তিনি করেননি যাতে পুলিশের এই প্রশ্ন করা সাজে, তাও কেন এমন আক্রমণ? এই সাংবাদিকরা এমন কী লিখেছেন যাতে পুলিশের মনে হয়েছে তারা সমাজের নানা গোষ্ঠীর মধ্যে 'শত্রুতা' বাড়িয়ে ফেলবেন?

অভিসার শর্মার কথাই ধরা যাক। X-এ তাঁর ফলোয়ার ১.৮ মিলিয়ন। প্রায় ৩ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে তাঁর ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে। তিনি এমন খবরই প্রকাশ্যে আনেন যা মূলধারার মিডিয়া উপেক্ষা করে। তাঁর শেষ শোয়ের বিষয় ছিল বিহারের কাস্ট সেন্সাস। কীভাবে এই কাস্ট সেন্সাস বিজেপির সব হিসেব নিকেশ গুলিয়ে দিচ্ছে তাই নিয়েই খবর করেছিলেন অভিসার। পুরনো পেনশন স্কিমের উপরও খবর করেছিলেন তিনি। পুরনো দিল্লির ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে পুরনো পেনশন স্কিম ফেরানোর দাবিতে সারা দেশ থেকে আসা বিক্ষোভকারীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। মূলধারার মিডিয়া এই খবর কোনওদিনও সামনে আনেনি।

 

আরও পড়ুন- প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাকে বারবার হেনস্থা, কীসের মাশুল?

নিউজক্লিকে ব্যবসা এবং রাজনীতি নিয়েই মূলত লেখেন পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা। X-এ তার ১২২.৫ হাজারের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে নিয়মিত কাজ করে গেছেন। হিন্ডেনবার্গের আদানি বিষয়ক বিস্ফোরক রিপোর্টে উল্লিখিত একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক পরঞ্জয়ই।

নিউজক্লিকের ফলোয়ার ৬৮,০০০-এরও বেশি। নিয়মিতভাবে সাম্প্রতিক বিষয়গুলি সম্পর্কে কাজ করে চলেছে নিউজক্লিক৷ এই ওয়েব পোর্টালের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থের শেষ কাজ প্রজেক্ট সাইবারসিন। ১৯৭০-এর দশকে চিলি সরকারের একটি প্রকল্প ছিল সাইবারসিন, অর্থনীতিতে বাস্তব সময় পরিকল্পনা এবং তা হাতে কলমে করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছিল ওই প্রকল্পে।

নিউজক্লিক ওয়েবসাইটের অন্যান্য প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী বন্ডের সমালোচনা। এই ইলেক্টোরাল বন্ডকে বিরোধীরা 'বৈধ ঘুষ' বলে মনে করে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের গুজরাতের রিপোর্ট নিয়েও কাজ করেছিল নিউজক্লিক। নানা উন্নয়ন প্রকল্পে সবুজ ছাড়পত্রের বিধি লঙ্ঘনের জন্য সরকারের নিন্দা করে নিউজক্লিক।

স্বচ্ছ ভারতের নামে যে অভিযান মোদি সরকার চালায়, আর যেভাবে গান্ধীজির ছবিকে তাতে ব্যবহার করা হয় এই নিয়েও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নিউজক্লিক হিন্দি ওয়েবসাইটে। লেখেন আরেক সাংবাদিক ভাষা সিং। 'খোঁজ খবর' নামে একটি অনুষ্ঠান তিনি এই ওয়েবসাইটের ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে সঞ্চালনা করেন। প্রায় ৪ মিলিয়ন ফলোয়ার রয়েছে ভাষার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টর সমালোচক ভাষা সিংয়ের বাড়িতেও তল্লাশি চালায় পুলিশ, কেড়ে নেয় মোবাইল-ল্যাপটপ।

লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সহমত-এর প্রতিষ্ঠাতা, সোহেল হাশমির সম্প্রতি লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নেন। তাঁর শো 'ইতিহাস কে পন্নে'-তে তাঁরা দু'জনে নরেন্দ্র মোদির 'ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা’, ভক্তি সুফি আন্দোলন এবং আমাদের সমন্বিত সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। ক্ষমতাসীন গেরুয়া দল এবং এর বিভিন্ন শাখার তীব্র সমালোচক সোহেল হাশমি।

আরও পড়ুন- গোদি মিডিয়ার সুধীর ভাই আর তাঁর সাংবাদিকতা

লেখক এবং সাংবাদিক উর্মিলেশও ক্ষমতায় থাকা বিজেপির নেতাদের কড়া সমালোচক। বিহারের কাস্ট সেন্সাস নিয়ে কেন অন্য সংবাদমাধ্যমগুলি চুপ, সওয়াল করেছিলেন উর্মিলেশ। উর্মিলেশ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিহারে নীতীশ সরকারের একটি মাস্টার স্ট্রোক এই কাস্ট সেন্সার বা জাতিসুমারি। নিউজক্লিকে তাঁর শো ‘মন্থন’-এ তিনি কেন্দ্রের সরকার, তাদের রাজনীতি, আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কথা বলেন। মূলধারার মিডিয়া যে বিরোধীদের কথা বলে না, তাঁদের কথা তুলে ধরেন উর্মিলেশ।

 

অনিন্দ্য চক্রবর্তী নিউজক্লিকে নিয়মিত রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের বিষয় ছিল কেন ডানপন্থীরা রোমিলা থাপার এবং ইরফান হাবিবকে ঘৃণা করে। এই প্রতিবেদনে অনিন্দ্য বলছেন, হিন্দুত্বের প্রবক্তারা এই ঐতিহাসিকদের অপছন্দ করেন কারণ তাঁরা জাতি এবং শ্রেণি বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। জুলাই মাসে একটি প্রতিবেদনে অনিন্দ্য বলেন, নিওলিবারেল সংস্কার না হলে দেশের দরিদ্রতম ৪০% মানুষ আজ ভালো থাকতেন। পুরনো অর্থনীতি অব্যাহত থাকলে মধ্যবিত্ত ৪০% মানুষও ভালো থাকতেন। ১৯৮২ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারে লাভ হয়েছে ২০% ভারতীয়র যারা উচ্চবিত্ত, এবং আরও বেশি উপকৃত হয়েছে ১% ধনকুবেররা।

সঞ্জয় রাজৌরার 'ভারত এক মৌজ' বলে একটি টক শো করতেন, কয়েক মাস আগে তা বন্ধ হয়ে গেছে। শোয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া গণপিটুনি, সাম্প্রদায়িক হিংসা বা মূল্যবৃদ্ধির কথাই বলা হতো। মোদ্দা কথা, দেশের শাসকের স্বাস্থ্যের জন্য উপাদেয় ছিল না নিউজক্লিকের খবর। আবার অন্যদিকে এই খবরগুলি এমন কিছুই না যার উপর ভিত্তি করে সাংবাদিকদের উপর ইউএপিএ-র খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। এতে সন্ত্রাসবাদই বা কোথায়, সাম্প্রদায়িক শত্রুতার উস্কানিই বা কোথায়? আসলে সমস্যা যে কোথায় তা শাসক জানে। গোদি মিডিয়া আর স্বাধীন মিডিয়ার সংঘাত মূল একটিই প্রশ্নে, তা সততা ও যুক্তি। সেটি গুলিয়ে দিতে পারলেই শাসকের সুবিধা।

 

More Articles