বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিতে নয়, কুম্ভ আয়োজনে বেশি টাকা দেওয়াই বিজেপির লক্ষ্য

Maha Kumbh 2025: কেন্দ্রের তরফে এবারের মহাকুম্ভ আয়োজন করতে ২১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারও ৫৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে মহাকুম্ভ আয়োজনের উদ্দেশ্যে।

"চারিদিকে শুধু মৃতদেহের স্তূপ। তাকে ঘিরে রয়েছে পুলিশবাহিনী। অপরিচিত নারী ও পুরুষ কণ্ঠলগ্ন হয়ে পিষে মরেছে। ...যে দেহ ও রূপ ঘিরে অনেক লজ্জা, অনেক সজ্জা, তা আজ ঠান্ডা, স্পন্দনহীন স্তূপীকৃত..."

লিখেছিলেন কালকূট, 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে'-র পাতায়। ১৯৫৪ সালের এলাহাবাদের অর্থাৎ আজকের প্রয়াগরাজের কুম্ভমেলায়, মৌনী অমাবস্যার পুণ্যলগ্নে স্নান করতে এসে প্রাণ হারিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। দেশের প্রথমসারির সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় শিরোনাম হয়েছিল সেই দুর্ঘটনার খবর। কয়েকবছর আগে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক নির্বাচনী ভাষণে ১৯৫৪ সালের ওই দুর্ঘটনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে আক্রমণ করেন। বলেন, কংগ্রেস সরকার নাকি সেই ঘটনা লুকনোর চেষ্টা করেছে। আজ, এত বছর পরে কালকূটের সেই একই কথাগুলি যেন একই রকম তীব্রতায় আছড়ে পড়ছে সেই প্রয়াগরাজেই, আরেক মহা পুণ্যলগ্নে।

জানা যাচ্ছে না মৃত মানুষের সংখ্যা ঠিক কত! সরকারি বয়ান বলছে, কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন তিরিশ জন। অথচ সমাজ মাধ্যমের বিভিন্ন তথ্য বলছে মৃতের সংখ্যা ঢের বেশি। রোজই দেখা যাচ্ছে, নিখোঁজ মানুষের খোঁজে তাঁদের আত্মীয় পরিজনরা ভিড় জমাচ্ছেন সরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে মর্গে। মৃত মানুষের, হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ নিতে আসা মানুষের স্বজনদের পুলিশি হয়রানিরও শিকার হতে হচ্ছে।  ১৯৫৪ সালের ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, আজকের দুর্ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা যে হচ্ছে তাও স্বীকার করে নিতেই হয়।

১৯৫৪ সালের দুর্ঘটনা

আরও পড়ুন-এআই ক্যামেরা, বিশেষ বাহিনী দিয়েও কেন মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হওয়া আটকানো গেল না?

বড় বড় রথী মহারথীকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ আদৌ চিন্তিত নয়। মৃত মানুষদের ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া, কোনও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়াই দেহ পাঠানো হচ্ছে তাঁদের আত্মীয়দের হাতে। সবটাই সকলে জানেন, গাফিলতি কার। তাহলে কে আঙুল তুলবে যোগী-মোদির ব্যর্থ প্রশাসনের দিকে? আমাদের দেশের বর্তমান শাসকেরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানোর কাজটি খুব সুচতুরভাবেই বেশ কিছুদিন ধরে করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের কুম্ভমেলাকেও দেখা জরুরি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখ, অযোধ্যায় রামমন্দির স্থাপনের মধ্যে দিয়ে যা করা যায়নি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবার সেই কাজটিই আরও ভালোভাবে করতে চেয়েছেন। 

বিশ্বাসীরা বলেন, নরেন্দ্র মোদি হলেন ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ এবং তাঁর উত্তরসূরি হচ্ছেন যোগী আদিত্যনাথ। এই দু’জনের ছবি দিয়েই মহাকুম্ভেরও প্রচার করা হয়েছিল। প্রচার হয়েছিল, ১৪৪ বছর পরে এমন এক পুণ্যতিথি আসছে, যে তিথিতে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমস্থল বা ত্রিবেণীতে স্নান করলে পুণ্যলাভ অবশ্যম্ভাবী, এযাবৎকালের সমস্ত কৃত পাপস্খলন সম্ভব। আহ্বান জানানো হয়েছিল সকল ভক্তকে। দেশের নানা প্রান্তে, সমস্ত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সমাজমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল, এই ‘শাহী স্নান’ সম্পর্কে। যাঁরা এই কুম্ভমেলায় যাবেন না, তাঁরা দেশদ্রোহী— এমন প্রচারও ইতিউতি চলেছে। দেশের ২০ শতাংশ মুসলমান মানুষকে এই কুম্ভমেলা থেকে দূরে থাকারও নিদান দেওয়া হয়েছিল।

কুম্ভমেলায় যে মৃত্যুমিছিল ঘটল এবং তা লুকিয়ে ফেলার যে কপট খেলা শুরু হলো, তা কি কখনও বিশুদ্ধ ধর্মাচরণ হতে পারে? বিকশিত ভারতের এমন বিকাশের শিকড় কোন প্রত্যয়ে, কেমন ভাবনায়, কী ধরনের শিক্ষা-দীক্ষায় প্রসারিত— সেই প্রশ্ন ক্রমশ জরুরি হয়ে উঠছে। বলা হয়েছিল এবার কুম্ভমেলা ডিজিটাল হবে, অথচ সেই মেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃতদেহের সংখ্যা কত, তা সরকার জানাচ্ছে না। কোভিডের সময়েও আমরা এই রকম দৃশ্য দেখেছি। গঙ্গার ধারে সারি সারি মৃতদেহ। তখনও নির্দিষ্ট কোনও সংখ্যা জানায়নি সরকার, এখনও জানাচ্ছে না। উল্টে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করছে। যে ধর্মস্থানের আবেগে ছুটে এল এই নিয়তি ও মৃত্যুপ্লাবন, তার পিছনে কি সত্যিই বিশুদ্ধ ধর্ম আছে না কি বাণিজ্য, রাজনীতি, ক্ষমতা বজায় রাখার কপট পদ্ধতিই আছে মূলে?

আরও পড়ুন-পায়ের চাপে পিষ্ট শিশু-বৃদ্ধ! মহাকুম্ভে মৃতের সংখ্যা চাপতে কেন মরিয়া যোগী সরকার?

প্রশ্ন হলো, কুম্ভমেলার পশ্চাৎপটে যে সংস্কারাচ্ছন্ন আবেগ কাজ করে এবং নানা স্বার্থের তাগিদে যে আবেগকে আমরা বছরের পর বছর ধর্ম ও সংস্কৃতির নামে জড়িয়ে রাখছি, তা কি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত বিকাশের পরিপন্থী? ধর্মের আবেগে লক্ষ-লক্ষ মানুষের এইরকম উন্মত্ততা এদেশে নতুন নয়। ধর্মের অন্ধ আবেগে হাজার-হাজার মানুষের ঠেলাঠেলি, ধর্মীয় পাগলামির পায়ের তলায় ধর্মপ্রাণ মানুষেরই প্রাণ হারানো নতুন নয় এদেশে। ১৯৫৪ সালেই শুধু নয়, তারপরেও নানা সময়ে এই ধরনের ঘটেছে, অথচ প্রশাসন সতর্ক হয়নি। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তবু ধর্মের এই অন্ধ তাড়না, এই সংস্কারাচ্ছন্ন আকর্ষণে আমাদের ভেসে যাওয়ার পিছনে কখনও প্রকট, কখনও প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত থাকছে রাজনীতি।

কিছুদিন আগে উত্তরপ্রদেশেরই হাথরাসে এক স্বঘোষিত বাবার সমাবেশে একশোর উপর মানুষের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর পরেও প্রশ্ন উঠেছিল এই নিয়ে। স্তিমিত হয়েছে সেই আলোচনা। কুম্ভের দুর্ঘটনার কথাও বেশিরভাগই ভুলে যাবেন। মানুষকে মাতিয়ে দেওয়া হবে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে। মানুষও ভুলে যাবে যে প্রশাসনিক গাফিলতির কারণ খুঁজতে।

এই ত্রিবেণী সঙ্গম সম্ভবত আমাদের দেশে সবথেকে বিপজ্জনক আচ্ছন্নতা ও আকর্ষণ তৈরি করেছে। ধর্মের সঙ্গে, পুজোপাঠের সঙ্গে, আরাধনা ও ধ্যানের সঙ্গে, আত্মোপলব্ধির প্রচেষ্টার সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে কোলাহলবিহীন মগ্ন নিভৃতি, এ কথাটি আমরা ভুলে গিয়েছি। নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সংস্কারের টানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুণ্যার্জনের দেশব্যাপী উন্মাদনা। উন্মাদনার পিছনে যতটা আছে সাধারণ মানুষের আবেগ, ততটাই আছে রাজনীতির খেলা এবং বাণিজ্যিক মতলব। যাঁরা নিবিড় সাধনারও বাণিজ্যিকীকরণ করেন, তাঁদের দিকে আঙুল তুলবে কে?

আরও পড়ুন- পদপিষ্ট গরিবরাই! উচ্চবিত্তদের জন্য মহাকুম্ভে কী আয়োজন? চমকে দেবে বিলাসের বহর

প্রধানমন্ত্রী নিজেই সচেতনভাবে দিল্লি বিধানসভার দিনটিকেই বেছে নেন, কুম্ভমেলায় স্নান করার দিন হিসেবে। নিঃসঙ্গ ধ্যান বা ঈশ্বরলাভ নয় প্রচারসর্বস্ব আরাধনাই যে আসলে মোক্ষম এক ব্যবসা তা প্রতিপন্ন করে দেন রাষ্ট্রনেতারাই। সে কন্যাকুমারীতে গিয়ে ধ্যানে বসা হোক বা কুম্ভে ডুব ঈশ্বরপ্রাপ্তি রাগে আসে খ্যাতিপ্রাপ্তি হয়? যে তথাকথিত সাধু বলেছেন, কুম্ভমেলার মৃত মানুষদের মোক্ষ লাভ হয়েছে, তাঁকে কে প্রশ্ন করতে পারবেন যে এইরকম মোক্ষলাভে তিনি কেন আগ্রহী নন?এই ধরনের ভণ্ড সাধুরাও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। সাম্প্রতিককালে এই তথাকথিত ‘বাবা’-দের বাড়বাড়ন্ত তাই চোখে পড়ার মতোই। ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ উপন্যাসে শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মায়ের উপস্থিতি আমরা দেখেছি। পাশাপাশি যুক্তিবাদের প্রসারের কথাও সরকার তখন থেকেই ভেবেছে। বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারের তরফ থেকে এই খাতে টাকা বরাদ্দ বন্ধ হয়েছে।

দেশে বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদের প্রসারের জন্য প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস’-কে কেন্দ্রীয় সরকার যে ৫ কোটি টাকা দিত তা গত ২০২৪ সাল থেকে না দেওয়ার কারণে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি কেন্দ্রের তরফে এবারের মহাকুম্ভ আয়োজন করতে ২১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারও ৫৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে মহাকুম্ভ আয়োজনের উদ্দেশ্যে। সংবিধানের ৫১-এ ধারায় যেখানে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে একটি মহাকুম্ভ আয়োজনের উদ্দেশ্যে যা খরচের বহর তা স্পষ্ট করে দেয়, আসলে দেশের বিকাশ কোন পথে হওয়াতে চাইছে শাসক।

More Articles