একশো বছরের বিতর্কিত অতীত! শতবর্ষ পেরিয়েও কেন উদযাপনে নেই আরএসএস?
RSS centenary: সেই দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে আসা সঙ্ঘের একশো বছরে পা। তবে সরসঙ্ঘচালক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন— না, শতবর্ষ পালনে মাতছে না আরএসএস।
আগামী বছর শতবর্ষে পা দিতে চলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তথা আরএসএস। এক শতাব্দী পেরিয়ে আসা সঙ্ঘের শতবর্ষ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বহু জল্পনা-কল্পনা ছিল। কিন্তু সেই সমস্ত জল্পনায় ডল ঢাললেন সরসঙ্ঘপ্রধান। জানিয়ে দিলেন, শতবর্ষ পালন করবে না আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত।
১৯২৫ সাল ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ব্রিটিশ ভারতের নাগপুর শহরে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার নামে এক ডাক্তারের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। হেডগেওয়ারের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব যায় মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর এবং পরে মধুকর দত্তাত্রয় দেওরসের কাছে। গোড়া থেকেই রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয়,নিজেদের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে তুলে ধরেছিল আরএসএস। হিন্দু যুবকদের মধ্যে শক্তি, বীরত্ব ও সাহস পুনরুদ্ধারের জন্য সমস্ত বর্ণ ও শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে মানসিক ও শারীরিক শৃঙ্খলাবোধের উপর জোর দিত এই সঙ্ঘ। আধাসামরিক প্রশিক্ষণ, দৈনন্দিন ব্যায়াম ও মহড়া ছিল সেই শৃঙ্খলার অংশ।
সেই আজ দেখতে দেখতে পার করেছে একশো বছর। সঙ্ঘের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতার কথাও কারও অজানা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, আরএসএস বা সঙ্ঘের সঙ্গে বহু বিষয়েই মনোমালিন্য হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির। বিজেপির বহু সিদ্ধান্তের সঙ্গেই অনৈক্য প্রকাশ করেছে সঙ্ঘ। এই সব কিছুর মধ্যেই আরএসএসের শতবর্ষ। সম্প্রতি এই বই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সঙ্ঘ প্রধান জানিয়ে দিলেন, একশো বছরে প্রবেশের মুহূর্তে তেমন কোনও উদযাপনের পথে যাবে না আরএসএস।
আরও পড়ুন: RSS-র থেকে কতটা বিপদ দেশের? কেন তুলে নেওয়া হল এত বছরের নিষেধাজ্ঞা?
তবে উদযাপন না থাকলেও এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরএসএসের নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতির রোড ম্যাপ। ইতিমধ্যেই অখিল ভারতীয় কর্মী মণ্ডল (ABKM) আরএসএসের বিভিন্ন সাংগঠবিক দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে এ নিয়ে একটি সভারও আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে প্রায় সাড়ে তিনশো জন শীর্ষ আরএসএস কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
গত এক দশকে আরএসএস তাদের সাংগঠনিক উপস্থিতি প্রায় দ্বিগুণ করেছে। একাধিক নতুন ভৌগোলিক অঞ্চলেও প্রবেশ করেছে তারা। তবে তাকে যথেষ্ট বলে মনে করে না সঙ্ঘ। সাধারণ ভাবে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর সংগঠন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা তৈরি করে আরএসএস। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দেশের ৬,৪৮৩টি ব্লকের মধ্যে ৫,৬৮৩টিতে দৈনিক শাখা রয়েছে আরএসএসের। তেমনটাই জানান আরএসএসের সরকার্যবাহ (সাধারণ সম্পাদক) দত্তাত্রেয় হোসাবলে। দেশের ৯১০টি জেলার মধ্যে ৯০০টি জেলায় সঙ্ঘ কাজ করছে। আগামী তিন বছরে দেশের সমস্ত মণ্ডলে সঙ্ঘকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে সেই সম্মেলনে। একই সঙ্গে পূর্ণকালীন কর্মী নিয়োগের উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।
সঙ্ঘ তৈরি হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী ছিল তারা। এমনকী ব্রিটিশবিরোধী বলে চিহ্নিত হতে পারে এমন কোনও কাজকর্মও করত না সঙ্ঘ। হেডগেওয়ার অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে মহাত্মা গান্ধির ১৯৩০ সালের 'সত্যাগ্রহে' অংশ নিয়েছিলেন। তবে তাতে সঙ্ঘকে যুক্ত করেননি। পরবর্তীকালেও একাধিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সঙ্ঘ। দেশভাগ পরবর্তী সময় একাধিক সময় হিন্দু-মুসলিম হিংসায় ইন্ধন জোগানো,সহিংসতায় সক্রিয় ভূমিকা পালনের অভিযোগ ওঠে আরএসএসের বিরুদ্ধে। কার্যত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধি ও প্যাটেলকেই দেশভাগের জন্য সে সময় দোষারোপ করেছিল আরএসএস।
এখনও পর্যন্ত আরএসএসের উপর আরোপ হয়েছে তিন-তিন বার নিষেধাজ্ঞা। প্রথম বার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধিকে হত্যার পরে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অনেক নেতাকে কারারুদ্ধ করেছিলেন সে সময়। ১৯৪৯-এর জুলাই পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিলেন বল্লভভাই। এ বিষয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চিঠির জবাবে বল্লভভাই লিখেছিলেন, ‘আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, হিন্দু মহাসভার একটি কট্টরপন্থী অংশ ষড়যন্ত্রে (গান্ধীহত্যা) জড়িত। আরএসএস সরকার এবং দেশের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক।’
গান্ধিহত্যার আগে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় কংগ্রেস, মহাত্মা গান্ধির পাশাপাশি জাতীয় পতাকাকেও আক্রমণ করে বিতর্কে জড়িয়েছিল আরএসএস। পাশাপাশি ভারতের সংবিধান নিয়েও আপত্তি ছিল তাদের। তাদের যুক্তি ছিল, তারা ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী কারণে ভারতীয় সংবিধানে "মনুর আইন"-এর কোনো উল্লেখ নেই। আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজ়ার’-এ সঙ্ঘের তৎকালীন কর্ণধার এমএস গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, ‘হিন্দুরা কোনও দিনই তিন রঙের পতাকা মানবেন না, কারণ তাঁরা তিনকে অশুভ মনে করেন!’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য সঙ্ঘ পরিবার মুচলেকা দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার পরে নরম হয়েছিলেন বল্লভভাই। ধৃতেরাও মুক্তি পেয়েছিলেন। যদিও এখনও নিয়মিত ভাবেই সঙ্ঘের নেতা-কর্মীদের একাংশের নামে গান্ধি-ঘাতক নাথুরাম গডসের নামে জয়ধ্বনির অভিযোগ ওঠে।
দ্বিতীয় বার ১৯৭৫-৭৭ জরুরি অবস্থার সময় নিষেধাজ্ঞার কোপ পড়েছিল আরএসএসের উপর। ইন্দিরা গান্ধি সরকার ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর খর্ব হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সে সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ জনগণকে আইন অমান্য শুরু করার আহ্বান জানালে জরুরি অবস্থা জারি হয়। নারায়ণ সেনাবাহিনী ও পুলিশকেও সরকারের অবাধ্য হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নারায়ণ-সহ বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সেসময় আরএসএসকে বিরোধী নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসাবে দেখা হত এবং এর বিশাল সাংগঠনিক ভিত্তি থাকায় তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারত। সেই ভয়েই আরএসএসকে দ্বিতীয় বার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ভারতে।
আরএসএসের বিরুদ্ধে তৃতীয় তথা শেষ বার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। উন্মত্ত করসেবকদের হামলায় অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের সরকারের ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসবি চহ্বান আরএসএসের পাশাপাশি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল এবং কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠন ‘জামাত-ই-ইসলামি হিন্দ’ ও ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিমি)-কেও নিষিদ্ধ করেছিলেন সে সময়। যদিও ট্রাইব্যুনালের সামনে নিষেধাজ্ঞা জারির যুক্তিগুলি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। গত কয়েক দশক ধরে সরকারি কর্মীদের আরএসএস সংগঠনের কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। ১৯৬৬ সালে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর কেটে গিয়েছে ৫৮ বছর। সদ্য কেন্দ্রের মোদী সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে সরকারি কর্মীরা এখন আরএসএস-র কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারবেন।
সেই দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে আসা সঙ্ঘের একশো বছরে পা। তবে সরসঙ্ঘচালক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন— না, শতবর্ষ পালনে মাতছে না আরএসএস। এভাবে সংগঠনের অহংবোধ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছেন তিনি। নিজেদের কৃতিত্ব নিয়ে এভাবে গর্বপ্রকাশ করতে চায় না তারা। সঙ্ঘপ্রধান জানান, সমাজ পরিবর্তনই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এখানেই শেষ না করে তিনি জানান, সামাজিক জয়কে কেবল মাত্র সম্পদ সৃষ্টির ভিত্তিতে মান্যতা না দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতেও বিচার করা প্রয়োজন বলেও তাঁর বিশ্বাস। আরএসএস তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে একশো বছর সময় নিয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে মোহন ভাগবত জানান, এই রূপান্তরের ধীর গতির কারণ দু'হাজার বছরের সামাজিক পতনের বিরুদ্ধে লড়াই। তাঁর কথায়, আরএসএস এমন মানুষ তৈরি করতে চায়, যাঁরা সমাজ পাল্টাবে। একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, একটা সময় বহু সমস্যায় পড়লেও এখন পরিস্থিতি সংগঠনের পক্ষে অনুকূল। তবে পরিস্থিতি নির্বিশেষে সঙ্ঘকর্মীদের নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়ার দিকেই জোর দিতে চেয়েছেন সরসঙ্ঘচালক।
আরও পড়ুন: আরএসএসের তৈরি জমিতে ব্যাট করে এখন সঙ্ঘকেই লাথি! BJP-RSS সম্পর্কে ইতি?
সূত্রের খবর, একই সঙ্গে সঙ্ঘের ভিতরে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়েও শতবর্ষে এসে মন দিতে চাইছে আরএসএস। গত দু’তিন বছরে মহিলাদের নজর টানার মতো একাধিক পদক্ষেপ আরএসএস করেছে বলেও দাবি একাংশদের। তার মধ্যে যেমন রয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠক দ্রৌপদী মুর্মুকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষেক, রয়েছে ১৯৩৪ সালের পর প্রথম বার ২০২২ সালে কোনও মহিলা অতিথিকে সঙ্ঘের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির মর্যাদা দেওয়া। সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, তাঁরা ঘরে ও বাইরে মহিলাদের বৃহত্তর যোগদান দেখতে চান। মূল আরএসএস সংগঠনে মহিলাদের কোনও স্থান নেই। কিন্তু তাদের একটি মহিলা শাখা আছে— রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি। এ ছাড়া বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, সংস্কার ভারতী, সেবা ভারতী, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের কিছু অংশগ্রহণ থাকে। দুর্গা বাহিনীর মতো একটি তরুণীদের সংগঠনও আছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেন, “আমরা তাঁদের মা বলে ডাকি। আমরা তাঁদের জগজ্জননী বলে মনে করি। আমি জানি না কেন আমরা (হিন্দু সমাজ) তাঁদের কার্যকলাপের ক্ষেত্রকে সীমিত করেছিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে বিদেশি হানাদাররা এলে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো বৈধতা পায়।" শতবর্ষে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে নারীদেরকে তাদের পথের শরিক করতে চাইছে সঙ্ঘ, এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।