এন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ! কেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর হাত ছাড়ল বিজেপি?
Manipur CM N Biren Singh resigns: রবিবার শাহ এবং নাড্ডার সঙ্গে দেখা করেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী। দু'ঘণ্টা আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বীরেন সিংকে পদত্যাগ করতে হবে।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে উত্তপ্ত মণিপুর। দুই জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, ধর্ষণ, অস্ত্রের লাগামহীন ব্যবহার, উদ্বাস্তু শিবিরে উপচে পড়া ভিড় আর ভয় এখন মণিপুরের সংজ্ঞা নির্ধারিত করে দেয়। বহুবার অভিযোগ উঠেছে, বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে হিংসায় সরাসরি মদত জুগিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। বহুকাল থেকেই রাজ্যের বিরোধীরা পদত্যাগ দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর। কুকি-জো নেতাদের টানা ২১ মাসের বিরোধিতার পরে, অবশেষে পদত্যাগ করেছেন এন বীরেন সিং। তিনি নিজে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ হলেও মেইতেই-সংখ্যাগরিষ্ঠ ইম্ফল উপত্যকায় বীরেন সিংয়ের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছিল ক্রমেই। সহকর্মীদের চাপে, অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকায় ৯ ফেব্রুয়ারি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এন বীরেন সিং পদত্যাগ করলেন।
কুকি-জো গোষ্ঠী এবং এই সম্প্রদায়ের ১০ জন বিধায়ক - এর মধ্যে সাতজন বিজেপি বিধায়ক, যাদের মধ্যে দু'জন আবার মন্ত্রী - ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে মণিপুরে শুরু হওয়া জাতিগত সংঘাতের জন্য বীরেন সিংকেই দায়ী করেছেন। গত বছর থেকেই চাপ বাড়তে থাকে বীরেন সিংয়ের উপর। এমনকী খোদ নিজের দলের মধ্যে থেকেই! উপত্যকার বিজেপি বিধায়করা মুখ্যমন্ত্রীর অপসারণ চেয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সহ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বারেবারে আর্জি জানিয়েছেন। বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য বীরেন সিংকে সমর্থন করা জারি রেখেছিল। অবশেষে মণিপুর বিধানসভার বাজেট অধিবেশনকে সামনে এনে চরম পদক্ষেপের পথে এগোন এই অসন্তুষ্ট বিধায়করা। মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর আবেদনে সাড়া না দেওয়াতে অসন্তুষ্ট বিধায়করা অধিবেশন চলাকালীন একটি অনাস্থা প্রস্তাব পেশের পথে হাঁটেন।
আরও পড়ুন-মণিপুরের দুর্দশার জন্য দায়ি মোদিই? যা বলছেন আরএসএসের মোহন ভাগবত…
মণিপুর বিধানসভার স্পিকার থকচম সত্যব্রত সিং নিজেই মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের অন্যতম সমালোচক। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লি গিয়ে বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার সঙ্গে দেখা করে আসেন তিনি। সূত্রের খবর, সত্যব্রত সিং নাড্ডাকে অনাস্থা প্রস্তাবের কথা জানান। নাড্ডা যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে অনাস্থা প্রস্তাব এড়ানো যায় কিনা, স্পিকার স্পষ্ট বলে দেন, তিনি তা করতে অপারগ।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি বীরেন সিংয়ের আরেক সমালোচক, মণিপুরের গ্রামীণ উন্নয়ন ও পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রী ইউমনাম খেমচাঁদ সিং নয়াদিল্লি যান। জানা গিয়েছে, তিনি বিজেপি নেতৃত্বকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রীকে না সরানো হলে সরকার পড়ে যেতে পারে। রাজ্যপাল এ কে ভাল্লা গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করেন, সমস্ত বিষয়টা জানান। ৫ ফেব্রুয়ারি, বীরেন সিং নয়াদিল্লিতে যান। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। এরপরে, তিনি এবং তাঁর অনুগত কিছু মন্ত্রী প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ মেলায় যান। বীরেন সিং শনিবার আবার নয়াদিল্লি যান। রবিবার শাহ এবং নাড্ডার সঙ্গে দেখা করেন। দু'ঘণ্টা আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বীরেন সিংকে পদত্যাগ করতে হবে।
“প্রত্যেক জিনিসেরই একটা স্থান, কাল এবং পরিস্থিতি থাকে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পদত্যাগের চাপ দিয়ে আসছিলাম ঠিকই কিন্তু বিধায়করা আর অপেক্ষা না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। বিজেপি, এনপিএফ (নাগা পিপলস ফ্রন্ট) এবং এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি) থেকে আমাদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়ক রয়েছেন,” বলেছেন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া বিজেপি বিধায়কদের একজন। এখানে উল্লেখ্য এনপিপি এবং এনপিএফ হচ্ছে বিজেপির শরিক।
বিজেপির হেড কোয়ার্টার বলছে, কেন্দ্র সম্প্রতি সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়াতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে একাধিক পদক্ষেপ শুরু করেছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এ কে ভাল্লাকে রাজ্যপাল হিসেবে মণিপুরে নিযুক্ত করা এবং আমলাতন্ত্রের সম্পূর্ণ সংশোধন সেই প্রচেষ্টারই অংশ ছিল। এমতাবস্থায় অনাস্থা প্রস্তাব আনলে এবং সরকারের পড়ে গেলে এই প্রচেষ্টাগুলি নষ্ট হবে। জাতীয় নেতৃত্বও চায়নি যে এই প্রচেষ্টাগুলি আবার থেমে যাক। বিশেষ করে দিল্লিতে আপ-কে হারিয়ে দুর্দান্ত জয়ের পর আর 'রিস্ক' নিতে চায়নি বিজেপি।
উল্লেখ্য, মণিপুরের হিংসা বিষয়ে একাধিক অডিও টেপ ভাইরাল হয়ে যায়। ওই অডিওগুলিতে বীরেন সিংয়ের গলা ছিল বলে দাবি করা হয়। সেই অডিওতে মণিপুরের হিংসা, অস্ত্র জোগানে বীরেন সিংয়ের সরাসরি মদত ধরা পড়ে যায়। সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে এই মণিপুর টেপ সংক্রান্ত রিপোর্ট চায় সুপ্রিম কোর্ট। এই অডিও টেপের উপর ভিত্তি করে পিটিশন দায়েরকারী, কুকি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস ট্রাস্ট, মণিপুরের হিংসায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যাওয়ার নেপথ্যে বীরেন সিংয়ের ভূমিকা বিষয়ে তদন্তও চেয়েছে।
বিজেপি নেতৃত্ব বীরেন সিংকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় রেখে দেওয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি প্রায় দু'বছর। চারদিক থেকে এত অভিযোগ, বিজেপির মধ্যে থেকে অভিযোগ, মামলা ইত্যাদির পরেও বীরেন সিং ছিলেন শাসকের নয়নের মণি। তবে বীরেন সিংকে বাঁচানোর এই প্রয়াসে মণিপুরে বিজেপি সরকারের প্রতি আস্থা ক্রমেই কমতে থাকে মানুষের। গত বছর লোকসভা নির্বাচনেই তার ছাপ পড়ে। এনডিএ মণিপুরের দু'টি আসনে হেরে যায়। ওই আসনে জেতে কংগ্রেস। গত নভেম্বরে অসন্তোষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে ছয়জন মেইতেই মহিলা ও শিশুকে অপহরণ এবং হত্যার ঘটনায়। সেই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা বীরেন সিং সহ বিধায়ক এবং মন্ত্রীদের বাড়িতে ভাংচুর চালায়।
আরও পড়ুন- মেইতেই-কুকি হিংসার আড়ালে খোদ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী? কী বলছে বিস্ফোরক অডিও ক্লিপ?
সেই সময়ে এনপিপি সভাপতি কনরাড সাংমা ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর দল বীরেন সিং সরকারকে আর সমর্থন করবে না। উল্লেখ্য, তখন সাতজন বিধায়ক ছিল এনপিপি-র। তারপর থেকে লাগাতার বিরোধীদের সরকার ফেলে দেওয়ার ভয় তাড়া করে বেড়ায় বিজেপিকে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি, মণিপুর কংগ্রেস ঘোষণা করে যে তারা ১০ ফেব্রুয়ারি বীরেন সিং সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করবে। ৮ ফেব্রুয়ারি, বীরেন সিং ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) বিধায়কদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন, যার মধ্যে ছিল নাগা পিপলস ফ্রন্ট এবং জনতা দল (ইউনাইটেড)। জোটের ৪৬ জন বিধায়কের মধ্যে মাত্র ২০ জন ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আগে, গত ১৭ নভেম্বর, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ৭ জন বিধায়ক বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী এবং এনপিপি জাতীয় সভাপতি কনরাড সাংমা সমর্থন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করে বিজেপির জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডাকে একটি চিঠি দেন। ২২ জানুয়ারি জনতা দলও (ইউনাইটেড) বিজেপি সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। এর আগে ২০২৩ সালের ৬ অগাস্ট কুকি পিপলস অ্যালায়েন্স (কেপিএ) বীরেন সিং সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। মুখরক্ষা করতেই প্রায় ২ বছর ধরে বীরেন সিংকে রক্ষা করেও, অবশেষে ২ ঘণ্টার বৈঠকে তাঁকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দেয় বিজেপি সরকার।
বীরেন সিংয়ের শাসনামলে মেইতেই এবং কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত হিংসায় ২০২৩ সালের মে মাস কমপক্ষে ২৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ৫৯,০০০-এরও বেশি মানুষ ভিটেমাটিহারা। নিখোঁজ ৩৯ জন। ১১ হাজার ১৩৩টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন থানায় ১১ হাজার ৮৯২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৫,৫৫৪ জন কৃষকের কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জীবিকা এখন সঙ্কটে।