২৭ বছর পর বিজেপির প্রত্যাবর্তন! কেন দিল্লিতে হারল কেজরিওয়ালের দল?

Delhi Assembly Election Result 2025: গত এক দশকে, আম আদমি পার্টির নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক বহিরাগতদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

মোদি নেহি তো অউর কৌন? বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে বরাবর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নীতিতে এই কায়দায় প্রচার চালায়। সত্যিই তো বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রীর মুখ কে? বিরোধীরাও যোগ্য উত্তর দিতে পারে না। এবার দিল্লিতে আম আদমি পার্টি এই ধাঁচের প্রচার চালিয়েছিল। "অরবিন্দ নেহি তো কৌন?” বিজেপি সেই উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এবার রাজধানীতেও বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার! খোদ দেশের রাজধানীতে আম আদমি পার্টিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করতে মরিয়া ছিল বিজেপি। ২৭ বছর পর গেরুয়া শিবির ক্ষমতায় ফিরে এল দিল্লিতে। মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পোরা, দুর্নীতির একাধিক মামলায় আপের একাধিক নেতাকে অভিযুক্ত করা লেগেইছিল। সেই সমস্ত কর্মকাণ্ডের ফল অবশেষে পেয়েছে বিজেপি। তবে শুধুই কি দুর্নীতি ইস্যুকে সামনে রেখেই বাজিমাত করে দিল মোদির বাহিনী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ— সবই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়েছে এবারের নির্বাচনে।

পরিকাঠামোর অভাব, নগরোন্নয়নে 'জিরো' 

স্পষ্টভাবে দেখা গেছে দিল্লির উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ভোটাররা আপকে নির্বাচিত করেনি। আপ-এর রাজনৈতিক মডেল নিয়ে এই বিশাল অংশের মানুষ হতাশ। রাস্তার বেহাল দশা, নিকাশী ব্যবস্থার তথৈবচ অবস্থা ভোটারদের বিক্ষুব্ধ করেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিজেপির কাছ থেকে এমসিডি অর্থাৎ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু তারপর থেকে উন্নতির বিশেষ কিছুই ঘটেনি বলে অভিযোগ। দিল্লির স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিকাঠামোতে আপ ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে বলে গর্ব করে। কিন্তু ভোটারদের অভিযোগ, শহরের নাগরিক পরিকাঠামোর স্বাস্থ্য একেবারে কোমায় চলে গিয়েছে। ২০২৪ সালের বর্ষায় দিল্লিতে বন্যা বা জল জমে থাকার ভয়াবহ স্মৃতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে।

আরও পড়ুন-অরবিন্দ কেজরিওয়াল: আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত না কি ষড়যন্ত্রের শিকার? 

দিল্লির উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভোটারদের মধ্যে আপ-এর 'ফ্রিবিজ' মডেলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। আপ বলেছিল, দিল্লির প্রতিটি শ্রমজীবী পরিবার তার ২২,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা সাশ্রয় করতে পারছে এই সরকারের কারণে। দিল্লির শ্রমিক শ্রেণির কিছু ভোটারদের মন পেলেও উচ্চবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই ভোট সরিয়ে নিয়েছে আপের থেকে। সম্ভবত, বিজেপি এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পেরেছে বলেই উচ্চবিত্ত ভোট টানতে পেরেছে।

যমুনা, দূষণ

আম আদমি প্রধান কেজরিওয়াল বিজেপি নেতৃত্বাধীন হরিয়ানা সরকারের বিরুদ্ধে যমুনার জলে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, দিল্লিতে 'গণহত্যা' চালাতে চলেছে বিজেপি। ভোটে জিতেই বিজয়ী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'যমুনা মাইয়া' শব্দটি উচ্চারণ করেন। ২০২০ সালে কেজরিওয়াল যমুনা নদীকে শুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যমুনা সংস্কার না হলে ভোটাররা পরের বার তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। শহরে পরিচ্ছন্নতার অভাব নিয়ে অধিকাংশজনই হতাশ এবং প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই দূষণ এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব নিয়ে বিরক্ত।

দূষণ নিয়ে দিল্লি জেরবার। শ্বাস নেওয়া দায় সেখানে। অথচ সরকারের কোনও সদর্থক ভূমিকা নেই। পানীয় জলের ঘাটতি নিয়ে কেজরিওয়াল মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করেন কিন্তু আপ সরকার নিজের দায়িত্ব পালন করেনি। সাধারণ মানুষ বলছেন, আম আদমি পার্টি জাতীয় রাজধানীতে উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়নি। সমস্ত দোষ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে ফেলে পিঠ বাঁচাতে চেয়েছে।

বাংলাদেশি হঠাও

বেশ কিছুকাল ধরেই সন্দেহভাজন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের শনাক্ত করার কাজ চলেছে বাংলাদেশে। বৈধ নথিপত্র ছাড়াই এই দেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত ও আটক করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে আউটার দিল্লিতে ১৭৫ জনকে সন্দেহভাজন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ডিসেম্বরে। দুই দশক আগেই দিল্লি পুলিশ বাংলা বলতে জানা পুলিশদের খোঁজ করেছিল। দিল্লিজুড়ে এই পুলিশরা নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ইদানীং বাংলাদেশিদের শনাক্ত করার কাজ আবার শুরু হয়। বস্তি, শ্রমিকদের থাকার জায়গা এবং অবৈধ কলোনি ঘুরে ঘুরে অবৈধ বাংলাদেশিদের আটক করা হয়। দিল্লি পুলিশ কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আওতায় কাজ করে, দিল্লি সরকারের নয়। বাংলাদেশিদের আটক করা আর নির্বাসন দেওয়ার এই পন্থাটি বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বেশ বাড়িয়েছে দিল্লিতে। বাংলাদেশিদের প্রতি ঘৃণা এবারের নির্বাচনে কাজ করেছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ভয় দেখানো

নির্বাচনী প্রচারে কেজরিওয়াল দিল্লির ভোটারদের এবং বিশেষ করে তাঁর নির্বাচনী এলাকা, নয়াদিল্লির জন্য কিছু ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, "ভোটের আগের রাতেই কাউকে আপনার আঙুলে কালি দিতে দেবেন না", "আপনি যদি আপনার ভোট বিক্রি করেন তবে আপনি জেলে যাবেন"। বিশ্লেষকরা বলছেন নির্বাচনী রাজনীতিতে, এই ধরনের ভীতি সৃষ্টিকারী কৌশল হামেশাই 'ব্যাকফায়ার' করে। যা আপের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

দুর্নীতি

আপ নিজে উঠে এসেছিল দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ হিসেবে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির বিকল্প হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। অথচ সেই দলেরই একের পর এক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে পারেনি। প্রতিশ্রুতি এবং কর্মক্ষমতার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে আপ-এর। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পরেও, আম আদমি পার্টির শক্তিশালী দলীয় কাঠামোর অভাব রয়েছে। পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স কমিটি (পিএসি) ছাড়া আর কেউই আপ-এর অন্য কার্যকরী দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন করতে বা সমালোচনা করতে পারে। দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর অভাবের প্রভাব পড়েছে নির্বাচনেও।

আরও পড়ুন-অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেফতার! বিজেপির দিল্লি দখলের মোক্ষম অস্ত্র এটিই?

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি নষ্ট করতে সফল হয়েছে বিজেপি। কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগ, দিল্লির আবগারি নীতি কেলেঙ্কারি অবশ্যই আপ-এর জন্য বড় ধাক্কা। বাইরে সরল জীবনযাপন দেখানো কেজরিওয়ালের সরকারি বাসভবনে অভাবনীয় খরচের অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক আরও গভীর হয়। কেজরিওয়াল এবং আম আদমি পার্টি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোট

এছাড়া ইন্ডিয়া জোটে ফাটল এবং কংগ্রেসের বারবার আক্রমণও কেজরি বিরোধিতার পথ প্রশস্ত করেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে জোটে যোগ দেওয়ার পরে, আপ এবং কংগ্রেস হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে আলাদা লড়ে। দিল্লিতেও আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দুই দলই ৭০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার ফলে বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আম আদমি পার্টির রাজনৈতিক নীতিতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট ছিল। প্রথমত আপ মনে করত, ভারতের রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক বেশিই রাজনীতি রয়েছে এবং সেই শাসনব্যবস্থা আবার এমন রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত যারা রাজনীতিরই বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, বদল ঘটতে গেলে ভারতীয় রাজনীতিতে বহিরাগতদের প্রয়োজন, যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। তৃতীয়ত, রাজনীতিবিদদের অবশ্যই তাঁদের জীবনযাপনে বিনয়ী হতে হবে যাতে তাঁরা প্রমাণ করতে পারেন যে আত্মসমৃদ্ধির পরিবর্তে জনগণের সেবার কাজেই রাজনীতিতে এসেছেন তাঁরা।

কিন্তু গত এক দশকে, দিল্লির পরিকাঠামোগত পরিবর্তনে বিশেষ বদল আসেনি, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি বলেই অভিযোগ। গত এক দশকে, আম আদমি পার্টির নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক বহিরাগতদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। খোদ নয়াদিল্লি আসনে অরবিন্দ কেজরিওয়াল হেরেছেন পেশাদার রাজনীতিবিদ পারভেশ ভার্মার কাছে। দিল্লি বিধানসভার সদস্য ছিলেন এবং দুইবারের সাংসদ ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা সাহেব সিং ভার্মা ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আড়াই বছর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ফলে নিজেদের নীতির কাছে নিজেরাই মুখ থুবড়ে পড়েছে আম আদমি পার্টি। 

২০১৫ সালে দিল্লিতে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন পেয়েছিল আম আদমি পার্টি। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২০ সালেও জেতে আপ। যদিও তখন থেকেই দূষণ, জলের ঘাটতি এবং দুর্বল পরিকাঠামোর সমস্যাগুলি জনসাধারণের মধ্যে প্রভাব ফেলতে থাকে। এক দশক ক্ষমতায় থাকার পর, যে দলটি একসময় পরিবর্তনের প্রতীক ছিল, সেই দলটির উপরেই আস্থা হারিয়ে ফেলে মানুষ। দিল্লির ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যায় অবশেষে।

More Articles