সৃজনশীল মানুষ আর বুদ্ধিমান মেশিনের লড়াই! ঠিক কতটা এগিয়ে ChatGPT?
ChatGPT4: GPT-4-এর এই ব্যতিক্রমী ক্ষমতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং ব্যবসার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগণিত সম্ভাবনা তৈরি করে ফেলেছে।
যদি আপনি গত কয়েক মাস স্মার্টফোনের দুনিয়া থেকে নিজেকে ব্রাত্য না করে থাকেন, তবে নিশ্চয় AI (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) বা ChatGPT শব্দগুলো কানে বা চোখে ঢুকেছে। কিছু ভিডিও দেখেছেন, কিছু লেখা পড়েছেন কিন্তু ঠিক এখনও ঠাহর করতে পারছেন না ব্যাপারটা খায়, না মাথায় দেয়! আর পাঁচটা ছাপোষা বাঙালি মধ্যবিত্তের মতো নিজের মেয়ে বা নাতিকে শুধিয়েছেন; ওরা ঠিক কী একটা বলেছে, ঠিক হজমও করতে পারেননি। তাহলে এই মুহূর্তে আপনি সঠিক লিঙ্কেই ক্লিক করেছেন, অন্তত আমি তো তাই বিশ্বাস করি! তাই লেখাটার বেশ ভারিক্কি একটা নামও দিয়ে ফেলেছি। যদিও নামের অনুপ্রেরণা টিউরিং অ্যাওয়ার্ড জয়ী (যাকে গোদা বাংলায় কম্পিউটার সায়েন্সের নোবেল প্রাইজ বলা হয়ে থাকে) জিওফ্রে হিন্টনের একটি টুইট। সেই টুইটের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: "শুঁয়োপোকা ধীরে ধীরে ফুলের মধু খেয়ে যে পুষ্টি আহরণ করে, সেটাই পরে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়। মানুষও হাজার হাজার বছর ধরে যে কোটি কোটি জ্ঞানবিন্দু আহরণ করে চলেছে, তার সম্মিলিত জ্ঞানের প্রজাপতি হলো এই GPT-4"। GPT-4 হলো একটি বৃহৎ ভাষা মডেল যা আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরের OpenAI নামক একটি কোম্পানির তৈরি। এই বস্তুটিই ChatGPT নামক এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়ার মস্তিষ্ক, যা আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর, সে যতই ঘোরালো হোক, যতই উদ্ভট হোক, একেবারে চটজলদি গরম চাউমিনের মতো স্ক্রিনের পাতে বানিয়ে দেবে। তাই বোধহয়, ChatGPT মানবজাতির ইতিহাসে যত প্রোডাক্ট এসেছে তার মধ্যে সবচাইতে দ্রুত ১০ কোটি গ্রাহক ধরতে পেরেছে (মাত্র ১ মাসের মধ্যে)। এবং ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে, এক স্ক্রিন থেকে আর এক স্ক্রিনে, অত্যন্ত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক বেচে খাওয়া কুলীন কর্মী পর্যন্ত। আক্ষরিক অর্থে আজ পর্যন্ত, মানুষের তৈরি জনপ্রিয়তম বস্তু হলো ChatGPT। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এটি একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যা আমরা মানে মানুষেরা যেভাবে মেশিনের সঙ্গে ভাবনা এবং তথ্য আদান প্রদান করে থাকি, তার পুরো সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে, দিতে থাকবেও। তবে এ শুধু ভবিষ্যতের আশু মহাবিপ্লবের হিমশৈলের উঁকি মাত্র। কেন? ভাবুন দেখি, যদি মানবজাতির হাজার বছরের জ্ঞান ও গবেষণা, ২৪ ঘণ্টা আপনার মোবাইল স্ক্রিনের একটা আইকন হিসেবে জ্বলজ্বল করে, তাহলে?
ইতিহাসের দিকে সামান্য ঘুরে তাকালেই বোঝা যায়, মানুষ নিজেদের জীবনকে উন্নত করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রের উপর নির্ভর করেছে। প্রতিটি উদ্ভাবন, তা আগুন হোক, চাকা হোক, বই হোক বা কম্পিউটার, আমাদের জীবনকে গভীর ও সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। চারপাশের জগতের সঙ্গে আদান প্রদানকেও পালটে ফেলেছে। আমরা নিজেদের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর তাগিদে নানা রকম অটোমেশনকেও জীবনের অংশ করে নিয়েছি। চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে স্টিম ইঞ্জিন, ইলেকট্রিসিটি এবং সফটওয়্যারের বিকাশ পর্যন্ত, প্রতিটি মাইলফলক আমাদের কাজগুলিকে অটোম্যাট করার এবং আমাদের জীবনকে নতুন আকার দেওয়ার একটা চেষ্টা মাত্র। এ এক নিরলস আরও ভালো করার ও ভালো থাকার বেলাগাম দৌড়। GPT-4-এর অসাধারণ ভাষা বোঝার এবং তৈরির ক্ষমতা, অটোমেশনের এই মানব ইতিহাস চলন্তিকায় এক অধ্যায় মাত্র। GPT-4-এর এই ব্যতিক্রমী ক্ষমতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং ব্যবসার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগণিত সম্ভাবনা তৈরি করে ফেলেছে।
আর একটু তলিয়ে বোঝা যাক। GPT-4 (Generative Pre-trained Transformer 4) এর মতো বৃহৎ ভাষা মডেলগুলি প্রচুর পরিমাণ ডেটার (মানে কোটি কোটি ডিজিটাল বই আর ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটগুলির অসংখ্য লেখা) থেকে শিখে নেয় নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নিউরাল নেটওয়ার্ক নামক এক ধরনের গাণিতিক পদ্ধতির আদলে, যাতে মূলত বইয়ের শব্দগুলো গাণিতিক সংখ্যায় পরিণত করে, বারবার গুণ করে নির্যাস বের করা হয়। এই পদ্ধতিটি আবার ট্রান্সফর্মার নামক এক আর্কিটেকচারের উপর নির্ভর করে যাতে সহজে ওই বৃহৎ সংখ্যারাশির গুণগুলো খুবই দ্রুত সারা যায়। এইভাবেই বৃহৎ ভাষা মডেলগুলি শব্দবিন্যাসের মূল কাঠামোটা জেনে নেয়, খানিকটা প্রত্নতাত্ত্বিক যেমন কোনও পুরনো যুগের রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রাচীন লিপিগুলির পাঠোদ্ধার করেন, তেমনই।
আরও পড়ুন- ‘মানুষ হয়ে সবকিছু ভেঙে দেব’, মাইক্রোসফটের চ্যাটবটের যে ‘মন কি বাত’ আতঙ্ক ছড়িয়েছে বিশ্বে
তবে এই ভাষা মডেলটিকে ঘিরে আজকের উন্মাদনাকে ভালো করে বুঝতে, আসুন GPT-2 এর দিনগুলিতে ফিরে যাই। GPT-2, GPT-4-এর পূর্বসূরি। এই ভাষা মডেলটিতে ছিল ১৫০ কোটি প্যারামিটার এবং এটি WebText নামক একটি ডেটাসেটে প্রশিক্ষিত ছিল, যার পরিমাণ ছিল ৪৫ টেরাবাইট। তারপরে আসে GPT-3, ভাষা মডেলের জগতে এক বিপ্লব, তাতে প্যারামিটারের সংখ্যা ১৭,৫০০ কোটি! যেন এক আনকোরা হাই স্কুলের ছাত্র হঠাৎ করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে ফেলল। তারপর আসে GPT-4, যে প্রায় ২৫০০০ শব্দের উত্তরও ক্ষণিকে দিয়ে দেয় (GPT-3 এর প্রায় ৮ গুণ) এবং লেখার সঙ্গে ছবিও সহজে বুঝে ফেলতে পারে। ভবিষ্যতের উত্তরসূরি বোধহয় অডিও ও ভিডিওর জগতও শিখে নেবে। আমাদের এক লাইনের ভাবনা থেকে GPT-4 বোধহয় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমার জন্ম দেবে! শুধু ভাষাগত দক্ষতায় নয়, ভিজ্যুয়াল আর্ট, সঙ্গীত এবং অন্যান্য সৃজনশীল বিষয়েও যেকোনও শিল্পীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে।
GPT-2 থেকে GPT-4 পর্যন্ত অবিশ্বাস্য যাত্রার আরও গভীরে গেলে বোঝা যায়, এই মডেলগুলির ক্ষমতার আসল কারণ : হিউম্যান ফিডব্যাক থেকে রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং (RLHF)। গোদা বাংলায় বুঝতে গেলে ধরুন, একজন হাইস্কুলের পড়ুয়া, যে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক থেকে নয় বরং শিক্ষকদের দেওয়া ফিডব্যাক থেকেও শেখে। এই ফিডব্যাক তাদের বোঝার পরিমার্জন করতে, ভুলগুলি সংশোধন করতে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করে। একইভাবে, RLHF ভাষা মডেলগুলিও মানুষের ফিডব্যাক থেকে শেখে, নিজেদেরকে সূক্ষ্মটিউনিং করে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে চলে যায়।
GPT-4-এর মতো বৃহৎ ভাষা মডেলগুলির ক্ষমতাকে নোয়াম চমস্কির পদ্ধতিগত ব্যাকরণচালিত ভাষা মডেলের সঙ্গে তুলনা করলে, এর গভীরতা সঠিকভাবে বোঝা যায়। চমস্কির ভাষার তত্ত্ব, যা জেনারেটিভ ব্যাকরণ নামে পরিচিত, দাবি করে যে মানব মনের সর্বজনীন ব্যাকরণগত নীতিগুলির একটি সেটের মাধ্যমে ভাষা বোঝার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। এই পদ্ধতিটি ভাষার কাঠামোগত এবং নিয়ম-ভিত্তিক প্রকৃতির উপর জোর দেয়। তার মানে, ভাষা ভালো করে শিখতে গেলে একটি কঠোর ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করতেই হবে। অন্যদিকে, GPT-4-এর মতো বৃহৎ ভাষা মডেলগুলি ডেটা-চালিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, প্রচুর পরিমাণে পাঠ্য এবং তাদের মধ্যে থাকা পরিসংখ্যানগত নিদর্শনগুলি থেকে শেখে। পূর্ব-নির্ধারিত নিয়মগুলি মেনে চলার পরিবর্তে, এই মডেলগুলি ডেটাতে প্যাটার্ন, সম্পর্ক এবং কাঠামো চিহ্নিত করে ভাষা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধারণা তৈরি করে। মানে, এ যেন হাইস্কুলের সেই পড়ুয়া যে শুধু একটি ব্যাকরণ বই থেকে নয়, অগণিত উপন্যাস, নিবন্ধ পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে, সিনেমা দেখে, গান শুনে, ভাষাকে শেখে। ভাষার বিভিন্ন দিক এবং শৈলীর সূক্ষ্মতাকে অনুভব করে ভাষার সঙ্গে মিশে, ভাষার নিয়ম পড়ে নয়। আমরা সবাই তো এইভাবে শিখি? তাই না?
GPT-4 এর মতো মডেলগুলির যেসব ক্ষমতা আমরা দেখছি, নিঃসন্দেহে বিভিন্ন ডোমেনে তাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে৷ শিক্ষায়, এই মডেলগুলি বুদ্ধিমান টিউটর হিসাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত মতামত, ব্যাখ্যা এবং সহায়তা প্রদান করে তাদের আরও কার্যকরীভাবে শিখতে সহায়তা করবে। স্বাস্থ্যসেবায়, GPT-4-এর মতো মডেলগুলি ডায়াগনস্টিক পরামর্শ এবং রোগীর সঙ্গে কথাবার্তা আরও সহজ করে চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতদের সাহায্য করতে পারে। তারা ওষুধ আবিষ্কার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এবং সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাস দিয়ে নতুন ওষুধের বিকাশে সহায়তা করতে পারে। ব্যবসায়, এই মডেলগুলি গ্রাহক সহায়তা, নতুন পণ্য তৈরি এবং বিক্রির প্রক্রিয়াকে নিপুণ করতে পারে। তারা বিপণন উপকরণ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং পণ্যের বিবরণ পদ্ধতিকে স্বয়ংক্রিয় করতে পারে। বিনোদনের ক্ষেত্রে, GPT-4 গল্প, স্ক্রিপ্ট এবং সংলাপ তৈরিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে, লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নতুন ধারণা জোগাতে পারে। এগুলি ব্যবহারকারীদের জন্য ব্যক্তিগত বিষয়বস্তু তৈরি করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন কাস্টম নিউজ ফিড, চলচ্চিত্রের সুপারিশ, এমনকী ইন্টার্যাক্টিভ গল্প বলার অভিজ্ঞতাও মিলতে পারে GPT-4 থেকে।
কিন্তু GPT-4-এর মতো বৃহৎ ভাষা মডেলগুলি কি নির্ভুল? মোটেও নয়। নানা সমস্যা আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলির মধ্যে একটি হলো, এই মডেলগুলির হ্যালুসিনেশনের প্রবণতা। অর্থাৎ এই GPT-4 এমন আউটপুট তৈরি করতে পারে যা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে কিন্তু বাস্তবে ভুল বা অযৌক্তিক। উদাহরণস্বরূপ, GPT-4 মডেল একটি বিবৃতি তৈরি করতে পারে যাতে বলা হচ্ছে, "রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতার একটি লাইন হলো: 'আজি এ পূর্ণিমা রাতে শশীর কর কেমনে পশিল আমার ঘরে'।" এটি ব্যাকরণগতভাবে সঠিক বা রবীন্দ্রনাথের লেখার শৈলীর সঙ্গে মিল খেলেও, অসত্য। এই সমস্যাটি দেখা দেয় কারণ এই মডেলগুলি তাদের প্রশিক্ষণের ডেটাতে পরিসংখ্যানগত নিদর্শনগুলির উপর খুব বেশি নির্ভর করে এবং কখনও কখনও তারা এই প্যাটার্নগুলিকে ভুল ব্যাখ্যা করে ফেলে, যার ফলে ভুল আউটপুট হয়। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, প্রশিক্ষণের তথ্যে উপস্থিত পক্ষপাত ভাষার মডেলটিকেও দূষিত করে ফেলে। যেহেতু এই মডেলগুলি প্রচুর পরিমাণ তথ্য থেকে শেখে, তাই তারা অসাবধানতাবশত লিঙ্গ, জাতিগত, বা সাংস্কৃতিক স্টিরিওটাইপগুলির মতো পক্ষপাতগুলিকেও আপন করে নেয়। নিন্দুকরা অনেকেই তাই এই বৃহৎ ভাষার মডেলগুলোকে ‘পরিসংখ্যানের তোতাপাখি’ বলে ব্যঙ্গ করেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি পক্ষপাতমূলক মডেল কিছু পেশা বা বৈশিষ্ট্যগুলিকে প্রধানত একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ বা বর্ণের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। সমাজের ক্ষতিকারক স্টিরিওটাইপগুলিকে শক্তিশালী করে। যেমন ধরুন, ভারতীয় ঝাড়ুদারের ছবি দেখাতে বললে সে শুধু গরিব নিম্নবর্ণের মানুষদের ছবিই দেখাবে। আর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো, GPT-4-এর মতো মডেলেরা কপিরাইট আইন একেবারেই মেনে চলে না। কারণ এই মডেলগুলি সফটওয়্যার কোড, প্রবন্ধ, ছবি এবং ভিডিও সহ বিপুল পরিমাণে সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ ডেটাতে প্রশিক্ষিত। কপিরাইটযুক্ত সামগ্রীর অপব্যবহার বা ভুল বণ্টনের সম্ভাবনা তাই সত্যিই ভয়ের কারণ। একটি উদ্বেগ হলো যে, অনুমতি বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই শিল্পী বা লেখক বা কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের মেধাসম্পদ ব্যবহার করে এই মডেলগুলি উপার্জন করবে এবং ভবিষ্যতে হয়তো শিল্পী বা লেখকদের জীবিকাও এই মডেলগুলি কেড়ে নেবে। হয়তো এই শিল্পী বা লেখকরা ভবিষ্যতে প্রকাশ্যে আর কিছুই শেয়ার করবেন না। এই আশঙ্কা ভবিষ্যতের ভাষার মডেলের প্রশিক্ষণের জন্য উচ্চ-মানের ডেটা পাওয়ার সম্ভাবনাও কমিয়ে দেবে।
আরও পড়ুন- এবার ছবিতেও চলবে কথা, হুবহু মানুষের মতোই হয়ে উঠছে চ্যাটজিপিটির নতুন মডেল?
এই ভাষা মডেলের আর একটি মজার দিক হলো, ডিজিটাল জ্ঞানমুখী কাজকর্ম সস্তা হয়ে যাবে। কারণ GPT-4-এর মতো মডেলেরা অনেক কিছুই স্বয়ংক্রিয় করে দেবে, যেমন GPT-4 কাগজে আঁকা ছবি থেকেই একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতে পারে! অন্যদিকে, শারীরিক কাজ আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে কারণ রোবট মেশিনগুলি এখনও কায়িক শ্রমের বিকল্প আনতে পারেনি। এই পরিবর্তনের জন্য হয়তো সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার সংজ্ঞা ও পারিশ্রমিকও বদলে যাবে। যে বেতনের ফারাক দেখা যায় একজন সফটওয়্যার প্রোগ্রামার ও একজন কাঠমিস্ত্রির মধ্যে তা হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না। তাদের পেশা নয়, স্রেফ নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতাই তাদের মূল্য ঠিক করে দেবে। এইভাবেই হয়তো ব্লু ও হোয়াইট কলার জীবিকার উলটপুরাণ দেখা যাবে! পেশাগত অহংকারের চেয়ে দক্ষতাই বাজারে প্রকৃত দাম পাবে।
তবে, মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে অর্থনৈতিকভাবে উৎসাহিত করতে এবং মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য নানা রকম নতুন নীতি তৈরি অপরিহার্য। একটি পন্থা হতে পারে, হাইব্রিড মডেলের বিকাশকে উৎসাহিত করা; যেখানে AI প্রযুক্তিগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি এবং উন্নত করতে ব্যবহৃত হবে। আরেকটি কৌশল হচ্ছে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের মতো উচ্চকোটির দক্ষতা গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া। যা অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় মডেল দিয়ে বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কম। নানা দেশের সরকারকে সৃজনশীল মানুষ আর বুদ্ধিমান মেশিনের মধ্যে স্থায়ী বাস্তুতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে নতুন নীতি, আইন ও তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই বিষয়ে কৌতূহল আরও কিছুটা বাড়ানো যাক, কারণ আপনার কৌতূহলই ঠিক করে দেবে আপনার ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে এই বৃহৎ ভাষা মডেলদের যুগে। শুধু OpenAI নয়, এই ধরনের বৃহৎ ভাষার মডেল ও ChatGPT-এর মতো সর্বজ্ঞ chatbot অন্য কোম্পানিও তৈরি করছে। যেমন Google তৈরি করছে বার্ড (Bard), যেটি প্রায় সকলের হাতে এই এল বলে! অন্থ্রোপিক এআই (Anthropic AI) বলে একটি স্টার্টআপ বানিয়েছে ক্লদে (Claude), চিনের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন বাইদু (Baidu) গত শুক্রবার বাজারে এনেছে Ernie এবং মেটা (ফেসবুকের মূল সংস্থা) কয়েকদিন আগে গালাক্টিকা (Galactica) বলে একটি এই ধরনের সার্ভিস এনেছিল বাজারে। বাজার এখন নানা রকম ভাষা মডেলে গরম! শুধু ভাষা নয়, একই ধরনের কাঠামোর উপর দাঁড়িয়েই এসেছে ডালি-২ (DallE-2, ওপেন এআই-এর তৈরি), যেটি খুব সহজে লেখা থেকে ছবি তৈরি করে, স্ট্যাবল ডিফিউশন (StabilityAI-এর তৈরি) নানা ছবির স্টাইল বদলে দেয় কিংবা ভিডিও থেকে অ্যানিমেশন তৈরি করে। আবার Respeecher নামে একটি ইউক্রেনিয়ান স্টার্টআপ যেকোনও মানুষের কথাকে অন্য মানুষের কথার আদলে তৈরি করে দিতে পারে, নিমেষে! সব মিলিয়ে এ এক আশ্চর্য সময়! সৃষ্টিশীলতার এমন এক উল্লাস যা চিরাচরিত সৃষ্টিশীলতার ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। প্রজাপতির নানা অদ্ভুত রং দেখে আনন্দ হওয়ার চেয়ে অস্বস্তিই যেন বেশি! এই অস্বস্তি ভালো, অস্বস্তির সন্ধিক্ষণেই যুগবদল হয়। প্রশ্ন হলো আপনি কি এই যুগবদলের পক্ষেই?
লেখক Cisco Meraki (সিসকো মেরাকি) নামক একটি এন্টারপ্রাইজ নেটওয়ার্কিং কোম্পানিতে মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। থাকেন আমেরিকার টেক্সাসে, অস্টিন শহরে। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিন থেকে পিএচডি, আই আই টি খড়গপুর থেকে মাস্টার্স, এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক করেছেন। বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স। এর বাইরেও তিনি শোননা (একটি বাংলা পডকাস্ট মিডিয়া) এবং স্বাধীন দল (একটি বাংলা র্যাপ গানের চ্যানেল) এর সঙ্গে আদ্যোপান্ত জড়িত।