এলইডি-তে বহুল ব্যবহার, যে প্রযুক্তির আবিষ্কার বিজ্ঞানী-ত্রয়কে এনে দিল রসায়নে নোবেল

Nobel Prize 2023 in Chemistry: যে কোয়ান্টাম ডট বিপুলভাবে ব্যবহার করা হয় অত্যাধুনিক এলইডি টিভিস্ক্রিন ও মনিটরে, সেই কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার ও নির্মাণের জন্যে ২০২৩ সালে রসায়নে যৌথভাবে নোবেল পাচ্ছেন তিন বিজ্ঞানী।

বৃহদাকৃতির পদার্থকে ‘মিনিয়েচারাইজ’ বা ক্ষুদ্রায়ন করার প্রসঙ্গে পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, "দেয়ার’স প্লেন্টি অফ রুম অ্যাট দি বটম।" সেটা ১৯৫৯ সাল। ন্যানোপার্টিকল এবং ন্যানোটেকনোলজি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের যে তখন খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল, এমনটা নয়। তাই ফাইনম্যান ন্যানোটেকনোলজি শব্দটির বদলে ব্যবহার করেছিলেন ‘মিনিয়েচারাইজ’ শব্দটি। ফাইনম্যানের সেই ভাবনা ধীরে ধীরে সফল হতে দেখেছি আমরা। বিপুল ভাবে ব্যবহার হতে দেখছি ন্যানোটেকনোলজি। ন্যানোপার্টিকল এবং ন্যানোটেকনোলজির আকছার ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত কোয়ান্টাম ডট। যে কোয়ান্টাম ডট বিপুলভাবে ব্যবহার করা হয় অত্যাধুনিক এলইডি টিভিস্ক্রিন ও মনিটরে। সেই কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার ও নির্মাণের জন্যে ২০২৩ সালে রসায়নে যৌথভাবে নোবেল পাচ্ছেন তিন বিজ্ঞানী। দ্য রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানীয় এই পুরস্কার তুলে দিচ্ছে ডঃ মনজি বাওয়েন্দি, ডঃ লুইস ব্রুস, এবং অ্যালেক্সি একিমভের হাতে।

ডঃ বাওয়েন্দি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) রসায়নবিদ ও অধাপক ও গবেষক। দ্য রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স তাঁকে রীতিমতো গভীর ঘুম থেকে তুলে খবর দেন তিনি নোবেল পাচ্ছেন। তিনি তো অবাক। ঘুম তখনও তাঁর চোখে জড়িয়ে রয়েছে। ডঃ বাওয়েন্দির জন্ম ফ্রান্সে হলেও, তিনি আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোক। এমআইটি-তে তিনি ন্যানোক্রিস্টালের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেন। তবে বরাবরই তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোক্রিস্টাল অর্থাৎ কোয়ান্টাম ডটসের প্রয়োগের উপর।

আরও পড়ুন: বিতাড়িত হয়েছিলেন কর্মক্ষেত্র থেকে, যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল এই বিজ্ঞানীকে

ডঃ লুই ব্রুস বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। এক্সপেরিমেন্টাল কেমিক্যাল ফিজিক্স এবং ন্যানোসায়েন্সই পছন্দের জায়গা আশি ছুঁই-ছুঁই এই রসায়নবিদের।

Nobel Prize 2023 in Chemistry awarded to Moungi Bawendi, Louis Brus and Alexei Ekimov for the discovery and synthesis of quantum dots

ডঃ একিমভ ‘ন্যানোক্রিস্টাল টেকনোলজি’ নামের এক মার্কিন সংস্থার গবেষক। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৪৫ সালে জন্ম তাঁর। কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই। তবে কেরিয়ারের শুরুতে রঙিন কাচ নিয়ে গবেষণা করেন একিমভ। ঠিক রেনেসাঁর সময়ে তৈরি স্থাপত্য কিংবা ইওরোপীয় গির্জায় যেমন কাচ চোখে পড়ে। আলেক্সেই দেখলেন কাচের গায়ে কপার এবং ক্লোরাইন মেশালে তৈরি হয়ে যাচ্ছে কপারক্লোরাইডের ন্যানোক্রিস্টাল। এই ন্যানোক্রিস্টালের আকার বদলালে, কাচের গায়ে তাদের রঙ বদলে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে চোখ জুড়ানো রঙিন কাচ। এ যেন ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট’! আর সায়েন্স বলুন বা আর্ট, সেখান থেকেই সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোক্রিস্টালের ভাবনা শুরু।

ন্যানোপার্টিকল ক্রিস্টালগুলোরই যখন সেমিকন্ডাক্টারের বিশেষত্ব থাকে তাদের সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোক্রিস্টাল অর্থাৎ কোয়ান্টাম ডট বলা হয়। আর সেমিন্ডাক্টার ভীষণ ভালো তড়িৎপরিবহণ করতে পারে। কিন্তু এ-সবের আগে জানতে হবে ন্যানোপার্টিকল কী? ন্যানোপার্টিকল খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ০.০০০০০০০০১ অংশ। আরও সাধারণ ভাবে বললে, নিজের হাতটা গাল বা থুতনি অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে, দাড়ি যতটা বেড়ে ওঠে, সেই দৈর্ঘ্য এক ন্যানোমিটারের সমান।

কোয়ান্টাম ডটসে থাকা ন্যানো-ক্রিস্টাল আকারে এতই ছোটো, তাতে মাত্র কয়েক হাজার পরমাণু থাকতে পারে। এবার, এই পার্টিকলের আকার সামান্য বাড়ালে-কমালেই তাদের রঙ যেন জাদুর মতো বদলে যায়। আকৃতিতে ছোটো কণাগুলি নীল। কণার আকৃতি যতই বাড়ছে, ততই যেন হলুদ থেকে লালের দিকে এগোচ্ছে তাদের রঙ। অথচ পদার্থটা কিন্তু একই থাকছে। আর সামান্য আকৃতি বদলালেই, একই পদার্থের তাপীয়, তড়িৎ, এমনকি চৌম্বকীয় ধর্মও বদলে যাচ্ছে। এবং সেই কারণেই, এই ন্যানোপার্টিকলের ক্রিস্টালগুলিকে যদি সত্যিই ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হয়, তাহলে তাদের নির্দিষ্ট আকার না বজায় রাখলেই নয়। আর সেই অসাধ্যসাধন করে ফেলেছিলেন ডঃ মনজি বাওয়েন্দি।

Nobel Prize 2023 in Chemistry awarded to Moungi Bawendi, Louis Brus and Alexei Ekimov for the discovery and synthesis of quantum dots

ন্যানোক্রিস্টালের নির্দিষ্ট আকার বজার রাখার ‘টোটকা’ আর কিছু নয়। ন্যানোক্রিস্টাল যখন তৈরি হতে শুরু হবে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘নিউক্লিয়েশন’ সেই মুহূর্তটাকে বুঝে, রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময়টাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার সার্বিক সময়ের উপর বিক্রিয়াজাত পদার্থ বা ফাইনাল রিয়েজেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম নির্ভর করে। আর এই সময় নিয়ন্ত্রণের খেলাটা একবার বুঝে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে!

Nobel Prize 2023 in Chemistry awarded to Moungi Bawendi, Louis Brus and Alexei Ekimov for the discovery and synthesis of quantum dots

এই তিন বিজ্ঞানী তখন দেখলেন, একই পদার্থের কেবল আকৃতি বদলেই, তাকে নানান কাজে লাগানো যাচ্ছে। এক-এক কাজের জন্যে আলাদা-আলাদা পদার্থের উপর আর নির্ভর করতে হচ্ছে না। আর তারপরেই শুরু হল, এর বাণিজ্যিক প্রয়োগ। এলইডি টিভি স্ক্রিন, ল্যাপটপ, মনিটর যেগুলোতে লাল, নীল, সবুজ রঙ তৈরি হয়, যাকে আমরা পিক্সেল বলি, সেগুলো তৈরি হয় কোয়ান্টাম ডটস দিয়েই। এখানেই শেষ নয়, চিকিৎসা পদ্ধতিতেও বিপুল ব্যবহার রয়েছে কোয়ান্টাম ডটসের। পাশাপাশি এর সাহায্যে সুলভ সোলার প্যানেল তৈরিও সম্ভব। কোয়ান্টাম ডটস ব্যবহার করা হতে পারে নানান আধুনিক প্রযুক্তিতেও।

ছন্দে ছন্দে রঙ বদলায় যে অণু:

কিন্তু আকার বাড়াতেই ন্যানোপার্টিকলগুলোর যে ভাবে রঙ বদলাচ্ছে, সেই অবাক করা ঘটনাটা ঘটছে কী ভাবে! বলা যাক সেই গল্প। এই রঙ বদলের ঘটনাকে বলে ‘কোয়ান্টাল মেকানিক্যাল এফেক্ট’। ন্যানোপার্টিকল বা তাদের এই ক্রিস্টালগুলো এতই ছোটো, এই কম জায়গায় তাদের ভেতরে থাকা ইলেকট্রনগুলি গাদাগাদি করে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, আপনি যদি একটি ইলেকট্রন নেন এবং তাকে খুব ছোট্ট জায়গায় রাখেন, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ‘ওয়েভ ফাংশন’ বাধা পায়। তবে সেই যায়গা যত ছোটো হয়, ইলেকট্রনের শক্তিও তত বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে এই ন্যানোপার্টিকলগুলোই ইলেকট্রনগুলিকে ধরে রাখার জায়গা। তাই ন্যানোপার্টিকলের আকৃতি যত ছোটো, তার ভেতরে আটকে থাকা ইলেকট্রনের শক্তিও যেন তত বেশি।

Nobel Prize 2023 in Chemistry awarded to Moungi Bawendi, Louis Brus and Alexei Ekimov for the discovery and synthesis of quantum dots

এবার ভাবা যাক,রামধনুর সাতটি রঙের কথা। কেন রামধনুর প্রসঙ্গ হঠাৎ এল, তা বোঝা যাবে কিছুক্ষণেই। রামধনুতে যে সাতটি রঙ আমরা দেখি, সেগুলিই ‘ভিজিবল ওয়েভলেংথ’-এর মধ্যে পড়ে। ‘ভিজিবল ওয়েভলেংথ’-এর আলোকবর্ণালীর ব্যপ্তি ৭৪০ থেকে ৩৮০ ন্যানোমিটার রেঞ্জের মধ্যে। তাই সেই রেঞ্জে থাকা রঙ এবং আলোই মানুষের চোখে ধরা পড়ে। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৭৪০ ন্যানোমিটার। ‘ভিজিবল ওয়েভলেংথ’-এর আলোকবর্ণালীর একদম শেষ প্রান্তে রয়েছে লাল আলো। এদিকে এই আলোকবর্ণালীর আরেক প্রান্তের শেষে রয়েছে বেগুনী রঙ। ৩৮০ ন্যানোমিটার যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি, তার শক্তি তত কম। এবং সে জন্যেই লাল আলোকরশ্মির শক্তি সবথেকে কম, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতই বেশি হোক না কেন। ঠিক উল্টোটা দেখা যায় বেগুনি আলোকরশ্মির ক্ষেত্রে।

Nobel Prize 2023 in Chemistry awarded to Moungi Bawendi, Louis Brus and Alexei Ekimov for the discovery and synthesis of quantum dots

বেগুনি আলোকরশ্মির প্রতিবেশী নীল আলোকরশ্মি। তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫০০ থেকে ৪৩৫ ন্যানোমিটারের মধ্যে - বেগুনির চাইতে সামান্য বেশি। নীল আলোকরশ্মির শক্তি বেশ প্রখর। এবার ভাবা যাক, সেই ক্ষুদ্রতম ন্যানো-ক্রিস্টালের কথা, যার থেকে নীল রঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। সে এতই ক্ষুদ্র, তার ভেতরে হয়তো তখন স্থানাভাবে ইলেকট্রনের রায়ট চলছে। এত ক্ষুদ্র জায়গায়, আবদ্ধ থাকায় ‘ক্রোধে’ যেন সেই ইলেকট্রন প্রচুর শক্তি তৈরি করছে। আর ওই যে বলা হল, যার যত বেশি শক্তি, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কম। আর সেই কারণেই সেখান থেকে নীল আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলেও শক্তি বেশি। অন্যদিকে সবথেকে বড় যে ন্যানোপার্টিকল,যার রঙ লাল, তার স্থানাভাব একটু কম। ফলে ইলেকট্রনের ‘ওয়েভ ফাংশন’ একটু কম বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সেখান থেকে বিচ্ছুরিত আলোর শক্তিও কম।

আরও পড়ুন: পরমাণুর অন্তরে কখন কী করছে ইলেকট্রন? কল্পনাকে বাস্তব করে নোবেলজয়ী ত্রয়ী

আর এই নিয়ে নিরন্তর গবেষণাই শেষপর্যন্ত এনে দিয়েছে স্বীকৃতি। ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য যৌথভাবে মনোনীত হয়েছেন এই তিন বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে লুইস ব্রুস জীবনের একটা বড় অংশই কাটিয়ে ফেলেছেন এই বিজ্ঞানসাধনার পিছনে। প্রায় শেষবয়সে এসে মিলল স্বীকৃতি। যে সে শিরোপা নয়, একেবারে নোবেল পুরস্কার। আর তাঁদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমকে কুর্নিশ জানাচ্ছে দ্য রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব।

More Articles