কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সাড়া জাগানো এই আবিষ্কারই নোবেল এনে দিল তিন পদার্থবিজ্ঞানীকে
Nobel Prize in Physics 2022: অ্যালেন অ্যাসপেক্ট, জন ক্লজা়র, এবং অ্যান্টন জে়ইলিংগার তিনজনেই এনট্যাঙ্গেলড কোয়ান্টাম স্টেটসের উপর সাড়াজাগানো গবেষণা করেছেন।
২০২২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন ফ্রান্সের অ্যালেন অ্যাসপেক্ট (Alan Aspect), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন ক্লজা়র (John F. Clauser), এবং অস্ট্রিয়ার অ্যান্টন জে়ইলিংগার (Anton Zeilinger)। ৪ অক্টোবর ভারতীয় সময় বিকেল তিনটে পনেরোয় পদার্থবিদ্যায় এই তিন নোবেলজয়ীদের নাম প্রকাশ করল দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স। এনট্যাঙ্গেলড ফোটোন, ‘বেল অসাম্য’ লঙ্ঘন প্রমাণ করা (Establishing the violation of Bell inequalities) এবং কোয়ান্টাম তথ্য বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য নোবেল পেলেন এই তিন বিজ্ঞানী। দ্য নোবেল প্রাইজ অর্গানাইজে়শনের সূত্রে জানা যাচ্ছে, অ্যালেন অ্যাসপেক্ট, জন ক্লজা়র, এবং অ্যান্টন জে়ইলিংগার তিনজনেই এনট্যাঙ্গেলড কোয়ান্টাম স্টেটসের উপর সাড়াজাগানো গবেষণা করেছেন। এনট্যাঙ্গেলড কোয়ান্টাম স্টেটসকে সহজ ভাষায় বললে বলতে হয়, যখন দু’টি কণা আলাদা আলাদা ভাবে থাকার পরেও তারা এক এবং অভিন্নভাবে আচরণ করে।
আটচল্লিশ বছর বয়সী অ্যালেন অ্যাসপেক্ট ১৯৮৩ সালে পিএইচডি শেষ করেন ফ্রান্সের Paris-Sud University থেকে। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সের Université Paris-Saclay and École Polytechnique-এর অধ্যাপক। বছর পঞ্চাশের অ্যান্টন জেইলিংগার বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার অধ্যাপক। নিজের পিএইচডি-জীবন তিনি কাটিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। ১৯৭১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা থেকেই তিনি পিএইচডি করেন। তিপান্ন বছর বয়সী জন ক্লজা়র ১৯৬৯ সালে নিউ ইয়র্কের কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জে. এফ ক্লজা়র অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তিন পদার্থবিদের গবেষণা যেন কোয়ান্টাম তথ্যভিত্তিক নতুন প্রযুক্তির উন্নতির পথ আরও প্রশস্ত করে তুলল। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কেবল তাত্ত্বিক গবেষণায় আর সীমাবদ্ধ নেই। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ফলিত ক্ষেত্রে সে পা বাড়িয়েছে। এবং সেই জন্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক এবং সুরক্ষিত কোয়ান্টাম এনক্রিপ্টেড কমিউনিকেশনেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিস্তর প্রয়োগ দেখা যায়। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণার সম্ভাবনাও যে রয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন- স্বৈরতন্ত্র বাধ্য করেছিল নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে, নোবেলের যে ইতিহাস আজও অজানা
এখানে আবারও ফিরে আসবো কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলড স্টেটের প্রসঙ্গে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি প্রধান উপপাদ্যই হলো, দুই বা ততোধিক কণার একে অপরের থেকে অনেক দূরে থেকেও একই সঙ্গে আবদ্ধ থাকা, একইরকম ভাবে আচরণ করা- কণাগুলির ঠিক এই অবস্থায় থাকাকেই বলে এনট্যাঙ্গেল্ড স্টেট। আর সেখানেই প্রশ্ন আসে, তাহলে তাদের মধ্যে একটি কণা যদি ভিন্ন ভাবে আচরণ করতে শুরু করে, তাহলে কি বাকি কণার আচরণও বদলে যাবে? কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখানেই আবারও জানান দেয়, একটি কণা কীভাবে আচরণ করবে, তার উপর নির্ভর করে বাকি কণাগুলির আচরণ। বহু বছর ধরে এই প্রশ্ন অনেকের মাথাতেও আনাগোনা করেছে, তাহলে এই যে এনট্যাঙ্গেলড থাকা কণাসমূহ, তাদের মধ্যে কি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বৈচিত্র্য (Hidden variable) লুকিয়ে রয়েছে? আর তাদের ভিন্ন ভিন্ন আচরণের ফল কি তাদের বৈচিত্র্যের সঙ্গে সমানুপাতিক?
১৯৬০-এর দশকে জন স্টিউয়ার্ট বেল একটি গাণিতিক অসমতা (বা ম্যাথেমেটিক্যাল ইনইক্যুয়ালিটি) প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি জন স্টিউয়ার্ট বেলের নামেই ‘বেল ইনইক্যুয়ালিটি’ নাম রাখা হয়েছিল। বেল ইনইক্যুয়ালিটি বলছে, এই কণাগুলিতে ‘হিডেন ভ্যারিয়েবল’ বা লুক্কায়িত বৈচিত্র্য রয়েছে। যা ঠিক করে দেয় কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট অবস্থায় থাকাকালীন কণাগুলি কীভাবে আচরণ করবে। কোয়েন্টাম এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায় থাকাকালীন দু’টি কণাকে একটি মেশিনের সঙ্গে তুলনা করা যাক, যেটি দু’টি বিপরীত রঙের বল, বিপরীত দিকে ছুঁড়বে। এই মেশিন থেকে বেরনো একটি কালো বলকে যদি পাঠক খুঁজে পান, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাবেন লেখক একটি সাদা বল খুঁজে পেয়েছেন। এই যে ‘হিডেন ভ্যারিয়েবল’-এর কথা আমরা আলোচনা করলাম, সেটা এই বলগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বলগুলির রঙ কী হবে সেই তথ্য বলগুলির মধ্যে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, বলগুলোর রঙ ছিল ধূসর, যতক্ষণ না অবধি তাদেরকে কেউ চাক্ষুষ করেছে। ‘বেল ইনইক্যুয়ালিটি’ কিন্তু এই ধরনের ঘটনাকে সহজেই আলাদা করে চিনতে পারে। সোজা কথায় বেল ইক্যুয়েশন দিয়ে হিডেন ভ্যারিয়েবলগুলিকে চেনা যায়। এবং এখান থেকেই স্পষ্ট হয় এই ‘হিডেন ভ্যারিয়েবল’ যদি থেকে থাকে সেক্ষেত্রে কো-রিলেশন (বা পারস্পরিক সম্পর্ক) একটি নির্দিষ্ট মানের বেশি কখনওই হবে না। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হিসেব অন্য কথা বলছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতে, বিশেষ রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেলস ইনইক্যুয়ালিটিকে অমান্য করাই যায়। এবং তখনই একটি দৃঢ় কো-রিলেশন (বা পারস্পরিক সম্পর্ক) তৈরি হবে। আর সেখানেই জন ক্লজা়র করলেন বাজিমাত! তিনি এমনই কিছু পরীক্ষা করে দেখালেন যেখানে তিনি সহজেই বেলস ইনইক্যুয়ালিটিকে অমান্য করে ফেললেন। তবে ‘দ্য নোবেল প্রাইজ় অর্গ্যানাইজে়শন’-এর তরফে জানা যাচ্ছে ক্লজা়রের গবেষণায় বেশ কিছু খামতি রয়েছে। আর সেখানে বড় ভূমিকা পালন করলেন অ্যালেন অ্যাসপেক্ট। সেই খামতিকে তাঁর করা নতুন পরীক্ষা দিয়ে তিনি পূরণ করলেন। অন্যদিকে অ্যান্টন জে়ইলিংগার আবিষ্কার করলেন ‘কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন’। যেখানে একটি কোয়ান্টাম দশাকে অনেক দূর থেকেই পরিবর্তন করা যায়।
আরও পড়ুন- আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের দেহ! কাবুলে এত রক্ত কেন?
আরও বিস্তারিতভাবে বললে, ধরা যাক দু’টি মানুষ আলাদা আলাদা জায়গায় রয়েছে কিন্তু তারা কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায় রয়েছে। এমন অবস্থায় তারা যদি একে অপরের বিপরীতে হাঁটতে শুরু করে, এবং তাদের মধ্যে কোনও একজন ধরা যাক তৃতীয় এক ব্যক্তির দেখা পেলেন। আর দেখা হওয়ার পরেই তৃতীয় ব্যক্তি ও বাকি দুই ব্যক্তির মধ্যে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলড দশা তৈরি হলো। অর্থাৎ এখন কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলড দশায় মোট তিন জন রয়েছেন। এই অবস্থায় তৃতীয় ব্যক্তি প্রথম দুই ব্যক্তির মতো আচরণ করবেন। তৃতীয় ব্যক্তি এই অবস্থায় নিজের প্রাথমিক পরিচয় হারিয়ে ফেলল। কিন্তু তার (তৃতীয় ব্যক্তির) প্রাথমিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিলো, সেগুলো এখন প্রথমের দুই ব্যক্তির একজনের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই যে অজানা একটি কোয়ান্টাম দশা অন্য একটি মানুষে (পড়ুন কণা) স্থানান্তরিত হলো, তাকেই বলা হচ্ছে টেলিপোর্টেশন।
পদার্থবিজ্ঞানে সাড়াজাগানো গবেষণার জন্যে তিনজন একত্রে পাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার, যার আর্থিক মূল্য দশ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার এবং তাঁরা এই অর্থ নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ীদের নাম প্রকাশের পর, নির্ধারিত দিন ৫ অক্টোবর রসায়নে নোবেল পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।