ষড়যন্ত্র, হিংসায় উসকানি- অভিযোগ একাধিক! কী পরিণতি হবে রোদ্দুর রায়ের?
সংগীতশিল্পী কেকে-র মৃত্যু প্রসঙ্গে গায়ক রপঙ্কর বাগচী এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রোদ্দুর রায়ের অশালীন মন্তব্যের অভিযোগ রয়েছে। বুধবার রোদ্দুর রায়কে গোয়া থেকে নিয়ে আসা হবে কলকাতায়।
রোদ্দুর রায়ের অশালীন ভাষা ও কুরুচিকর শব্দের প্রয়োগ নিয়ে আগেও অনেক বিতর্ক হয়েছে। এবার লালবাজার সাইবার ক্রাইম, গুন্ডাদমন শাখা তাঁকে গোয়া থেকে গ্রেফতার করল। একাধিক থানায় এই ইউটিউবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। এছাড়া সংগীতশিল্পী কেকে-র মৃত্যু প্রসঙ্গে গায়ক রপঙ্কর বাগচী এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রোদ্দুর রায়ের অশালীন মন্তব্যের অভিযোগ রয়েছে। বুধবার রোদ্দুর রায়কে গোয়া থেকে নিয়ে আসা হবে কলকাতায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে জানা গেছে যে, হেয়ার স্ট্রিট থানা, চিৎপুর থানা, লালবাজারের সাইবার ক্রাইম থানা-সহ কলকাতা পুলিশের একাধিক থানায় ইউটিউবার রোদ্দুর রায়ের নামে সাম্প্রতিকে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের গানের এবং কবিতার প্যারডি গেয়ে নেটিজেনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন রোদ্দুর রায়। নেট নাগরিকদের একাংশ বেজায় চটে গিয়েছিলেন তাঁর এই কার্যকলাপে। সম্প্রতি বিখ্যাত গায়ক কেকে-র মৃত্যুর পর রোদ্দুরের একটি লাইভ ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। লাইভে এসে কেকে প্রসঙ্গে রূপঙ্করের মন্তব্যর জন্য একহাত নেন তাঁকেও। তার সঙ্গেই নজরুল মঞ্চের সেদিনের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি নিয়ে যে নানা মন্তব্য শোনা যাচ্ছে, তা নিয়েও সরব হন রোদ্দুর রায়। তুলে আনেন এই প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গও, আর এই প্রসঙ্গেই কুরুচিকর মন্তব্য করে বসেন মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে। আর তারপর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে উদ্যত হয় কলকাতা পুলিশ। অভিযোগকারী তৃণমূল নেতা ঋজু দত্ত তাঁর অভিযোগপত্রে লিখেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করেছেন রোদ্দুর রায়। পাশাপাশি সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও রোদ্দুর রায়ের মন্তব্যের কথাও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন ঋজু দত্ত। তবেই এই প্রথম নয়। কয়েক মাস আগেও রোদ্দুর রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল পাটুলি থানায়। অরিত্র সাহা নামে এক তৃণমূল কর্মী দায়ের করেছিলেন সেই অভিযোগ।
আরও পড়ুন: মুসলিম বিশ্বের চাপে বেকায়দায় ভারত, সামাল দিতে কী অস্ত্র মোদি-শাহর?
জানা গেছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির মোট এগারোটি ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলি হল ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০(বি), ১৫৩, ১৫৩(এ), ৪১৭, ৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৬৯, ৫০১, ৫০৪ এবং ৫০৯ ধারায়।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক তাঁর বিরুদ্ধে রুজু হওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি:
১. ১২০বি ধারা: অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। এক্ষেত্রে ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত হলে দুই বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড হয় অভিযুক্ত ব্যক্তির। এমনকী, মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তবে কী ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে অনধিক ছয় মাসের জন্য কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।
২. ১৫৩ ধারা: ইচ্ছাকৃতভাবে উসকানি দেওয়া। এক্ষেত্রে হিংসা ছড়ানো বা না ছড়ানো- উভয় ক্ষেত্রই এই ধারার মধ্যে পড়ে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনও ব্যক্তি অসৎ উপায়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে বেআইনি এমন কিছু করে বা জেনেবুঝে এমন কোনও কিছুতে উসকানি দেয় যা হিংসা ছড়াতে পারে, সেক্ষেত্রে যে কোনও একটি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। যদি এক্ষেত্রে কোনও হিংসা না ছড়ায়, তবে সর্বোচ্চ ছ'মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। এতে জামিন পাওয়া যায়।
৩. ১৫৩এ ধারা: ধর্ম, জাতি, জন্মস্থান, বাসস্থান, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষের পরিস্থিতি তৈরি করা এবং সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করে এমন কোনও কাজ করা জামিন-অযোগ্য এই ধারার আওতায় পড়বে। এক্ষেত্রে লিখিত বা মৌখিকভাবে বা কোনও আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে, কিংবা উপস্থাপন করা বা অন্য যে কোনও উপায়ে এমন কিছু করলেই তা এই ধারার আওতায় পড়বে। এমন কোনও কাজ, যা বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষা বা আঞ্চলিক গোষ্ঠী কিংবা বর্ণ বা সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর কিংবা জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত করে বা বিঘ্নিত করতে পারে বলে মনে হয়, তাহলে তা এই ধারার আওতায় পড়বে।
৪. ৪৬৭ ধারা: মূল্যবান কোনও সম্পত্তি, নথি, ইত্যাদির জালিয়াতি করা। এক্ষেত্রে কোনও নথির জালিয়াতি যা একটি মূল্যবান সম্পত্তি বা উইল, বা কাউকে দত্তক নেওয়ার ক্ষমতা, অথবা কোনও মূল্যবান সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য কোনও ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব দেওয়ার অভিপ্রায়ে বা অন্য কোনও কারণে হতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। এটি একটি জামিন-অযোগ্য ধারা।
৫. ৪৬৮ ধারা: প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি। যদি কোনও ব্যক্তি প্রতারণার জন্য ব্যবহার করতে কোনও নথি জাল করে, সেক্ষেত্রে দোষী প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। এটিও জামিন-অযোগ্য ধারা।
৬. ৫০৯ ধারা: কোনও মহিলার শালীনতার পক্ষে অবমাননাকর কোনও শব্দ, অঙ্গভঙ্গি বা সমতুল কোনও কাজ। এক্ষেত্রে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। এটি জামিন-যোগ্য ধারা।
তবে রোদ্দুর রায়ের গ্রেফতার প্রসঙ্গে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন বক্তব্য উঠে আসছে। অভিনেতা রুদ্রনীল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, সরকারের আরও সহনশীল হওয়া উচিত ছিল। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া নেতা অনুপম হাজরার আবার মত, রবীন্দ্রনাথকে অপমান করার সময় রাজ্য সরকারের এই তৎপরতা দেখা যায়নি কেন? তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, "অনেক আগেই রোদ্দুর রায়ের গ্রেফতার হওয়া উচিত ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবারই স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু কখনও রোদ্দুর রায় রবীন্দ্রনাথের গানকে বিকৃত করে গেয়েছেন, কখনও আবার তিনি যাঁদের পছন্দ করেন না, তাঁদের নামে অকথ্য গালিগালাজ করেছেন। তাই রোদ্দুর রায়কে কেন গ্রেফতার করা হল এমন বিকৃত মানসিকতার কথা আশা করি উঠবে না।'' বিরোধীরা অনেকে বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতেই তৃণমূল সরকার রোদ্দুর রায়কে গ্রেফতার করেছে।