টিপু সুলতানের বংশধর পূজিত খোদ ব্রিটেনে! অবিশ্বাস্য কাহিনিতে মোড়া নূর ইনায়াত খান

Noor Inayat Khan: ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঘাড়ের পিছনে গুলি করে হত্যা করা হয় নূর ইনায়াত খানকে। শোনা যায় মৃত্যুর সময় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত শেষ শব্দটি ছিল ‘Liberté’ যার অর্থ ‘স্বাধীনতা’।

সালটা ১৯৪০, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী গোটা ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একের পর এক দেশে ঢুকে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে হিটলারের সেনা। ব্যতিক্রম ছিল না ফ্রান্সও। ৬ সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হিটলারের সেনার কাছে মাথা নত করে ফ্রেঞ্চ আর্মি। অবশেষে ১৯৪০ সালের ২২ জুন একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই পক্ষের মধ্যে। প্যারিস শহর নিজের সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৌন্দর্যের শহর, প্রেমের শহর প্যারিস ভরে গেল নৃশংস নাৎসি বাহিনীতে। প্যারিসের বাসিন্দাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে শুরু করল হিটলারের কুখ্যাত গেস্টাপো বাহিনী। এই অত্যাচারের সরাসরি প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়েছিল এক মুসলিম পরিবারের উপর। কয়েক বছর আগেই তাঁরা লন্ডন থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন। পরিবারের সদস্য বলতে এক মহিলা এবং তাঁর চার সন্তান। সুফি ভাবধারায় বিশ্বাসী এই পরিবারের কর্তা লন্ডনে থাকাকালীনই দেহ রেখেছেন। এই সময় গেস্টাপোর সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার দেখে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন পরিবারের বড় মেয়ে নূর ইনায়াত খান। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন যে কোনও মূল্যেই হোক না কেন হিটলারের এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেনই। হিটলারের এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে পরিবারকে নিয়ে ফের লন্ডন ফিরে যান নূর।

গিয়ে যা দেখলেন তা বলার মতো নয়। এই ক’বছরে লন্ডনের চেহারা একেবারেই বদলে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েই তিনি জানতে পারলেন টানা ৭৬ রাত ধরে বোমারু বিমান হানা দিয়েছে লন্ডন শহরের উপর। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে শহরটি। অধিকাংশ মানুষই নিজেদের দিন কাটাচ্ছেন আন্ডারগ্রাউন্ড রেল স্টেশনে। এই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে নূরের। সেখানে লেখা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য লোক চাই। বিজ্ঞাপন চোখে পড়া মাত্র তিনি আবেদন করে দেন সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য। নূরের অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠে আধিকারিকদের। নূর ইনায়াত খানের পিতা ছিলেন ইনায়াত খান, যিনি টিপু সুলতানের প্রপৌত্র! যে টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শ্রীরঙ্গপত্তমে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাঁর বংশধর নাকি কাজ করবেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে। হতেই পারে না! সঙ্গে সঙ্গে নূরকে পত্র মারফত জানিয়ে দেওয়া হয় টিপু সুলতানের বংশধর হওয়ায় তাঁকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে দেওয়া যাবে না। তাহলে উপায়? এর পরেও কীভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন নূর ইনায়াত খান? কীভাবে হয়ে উঠলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর? কেনই বা মৃত্যুর এত বছর পরেও ইংল্যান্ডে এত সমাদৃত তিনি?

লন্ডনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে নাৎসি বোমারু বিমান

অমন পত্র পেলে অন্য কেউ হয়তো দমে যেত। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী নূর ইনায়াত খান নন। তাঁর শরীরে বইছে টিপু সুলতানের রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সকে তিনি আরেকটি পত্র লিখলেন। সেখানে তিনি সাফ জানালেন তাঁর মা একজন ব্রিটিশ এবং তিনি ইংল্যান্ডে রয়েছেন ব্রিটিশ প্রোটেক্টিভ পাসপোর্ট দেখিয়ে। সুতরাং তিনিও একজন ব্রিটিশ এবং তাঁর সম্পূর্ণ অধিকার আছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করার। যে কারণেই হোক, এবার ইন্টারভিউয়ের জন্য আধিকারিকরা ডেকে পাঠালেন নূর ইনায়াত খানকে। ইন্টারভিউতে সব প্রশ্ন ঠিকঠাক থাকলেও শেষ প্রশ্নটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। নূরকে জিজ্ঞেস করা হয়, ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, তিনি কি তাঁদের এই লড়াইকে সমর্থন করেন? জবাবে নূর বলেছিলেন, “বর্তমানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্রিটেন লড়াই করছে, তাই আমি ব্রিটেনকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করছি। কিন্তু এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আমি, আমার সমর্থন এবং নিষ্ঠা সম্পূর্ণরূপে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি থাকবে।” এমন চটজলদি উত্তরে দারুণ প্রভাবিত হন ব্রিটিশ আধিকারিকরা।

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

নূর ইনায়াত খান

১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন নূর ইনায়েত খান। দেড় বছরের মাথায় নূরের কর্মদক্ষতায় প্রভাবিত হয় তাঁকে SOE-তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। SOE (স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ) ছিল মূলত ব্রিটিশ সরকারের অত্যন্ত গোপনীয় একটি গুপ্তচরদের সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠন থেকে বিভিন্ন জার্মান অধিকৃত দেশে পাঠানো হচ্ছিল সিক্রেট এজেন্টদের। SOE-তে যোগদান করার সময় নূরকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শত্রুর হাতে ধরা পড়লে তাঁর কোনও দায়িত্ব ব্রিটেন নেবে না। SOE-তে সিক্রেট এজেন্ট বা গুপ্তচরকে সব রকমের শিক্ষা দেওয়া হয়- গুপ্তচরবৃত্তি, কোডেড মেসেজ ডিকোড করা, সামনের জনকে বিন্দুমাত্র বুঝতে না দিয়ে সুচারুরূপে মিথ্যে কথা বলা, অস্ত্র চালনা করা, খালি হাতে আত্মরক্ষা করা, প্যারা মিলিটারি ট্রেনিং ইত্যাদি। এই SOE-তে এসে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল নূরকে। তাঁর মধ্যে সুফি ভাবধারার প্রভাব বরাবরই ছিল। এহেন একজন মেয়ের পক্ষে কাউকে হত্যা করা একপ্রকার অসম্ভব। বাধ্য হয়ে তাঁর প্রশিক্ষকরা লিখে দিয়েছিলেন এই মেয়ের পক্ষে সিক্রেট এজেন্ট হওয়া অসম্ভব। যে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে পারে না, মারতে পারে না সে কীভাবে সিক্রেট এজেন্ট হবে! কিন্তু তাও নূরকে SOE-তে রেখে দেওয়া হয়, যেহেতু তিনি সাবলীলভাবে ফ্রেঞ্চ বলতে পারতেন এবং তাঁর সরল মুখমণ্ডল দেখে মনে হওয়া কঠিন যে তিনি একজন এজেন্ট। অবশেষে SOE-তে প্রশিক্ষণ নিয়ে, যতটা সম্ভব মনকে শক্ত করে ১৯৪৩ সালের মে মাসে আন্ডারকভার এজেন্ট নূর ইনায়াত খানকে একজন নার্স বানিয়ে প্যারিসে পাঠানো হয়। আন্ডারকভার থাকাকালীন তাঁর নতুন নাম হয় মেডেলিন।

বাবা এবং মায়ের সঙ্গে নূর ইনায়াত খান

১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে মস্কোতে ইনায়াত খান এবং আমিনা বিবির ঘরে জন্ম নেন নূর। তিনি ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠকন্যা। সেই মেয়েই এবার চলল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পরিবারকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নূরের কাছে সবথেকে কঠিন কাজ ছিল তাঁর মাকে জানানো। মাকে বলেছিলেন আফ্রিকা যাচ্ছেন। পাশাপাশি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁর অবস্থান ও কাজ যেন মাকে কোনওভাবেই জানানো না হয়। একমাত্র তাঁর মৃত্যুর পরই মাকে খবর দেওয়া হয়।

১৯৪৩ সালের মে মাসে নূরের প্যারিসে আসার দিন দশেকের মধ্যে ফ্রান্সে কর্মরত ব্রিটেনের সব গুপ্তচর ধরা পড়ে যায়। সেই সময় নূরের কাছে গোপন মেসেজ আসে লন্ডনে ফিরে আসার জন্য। জানা যায়, গেস্টাপো বাহিনী খবর পেয়েছে যে, মেডেলিন নামে এক ব্রিটিশ আন্ডারকভার এজেন্ট এসেছেন প্যারিসে। তাঁকে ধরিয়ে দিলে ১,০০,০০০ ফ্রাঁ পুরস্কার ঘোষণা করা হয় গেস্টাপোর তরফে। এসব জানা সত্ত্বেও লন্ডন ফিরতে অস্বীকার করেন নূর ইনায়াত খান এবং নিজের কাজ চালিয়ে যান। দেখা যেত, প্রতি এক দেড় মাসের মধ্যেই SOE-র কোনও না কোনও রেডিও অপারেটর ধরা পড়ছেন। এত কিছু জেনেও SOE-র প্রথম নারী রেডিও অপারেটর হিসেবে নাৎসি এবং গেস্টাপো বাহিনীর মাঝে গিয়ে কাজের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন নূর ইনায়াত খান। জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে নিয়মিতই স্থান বদলাতে হতো নূরকে। সেজন্য নিজের রেডিও ট্রান্সমিশনের যন্ত্রপাতিগুলো একটি ব্যাগে নিয়ে ঘুরতেন তিনি।

গর্ডন স্কয়ার গার্ডেন্সে নূর ইনায়াত খানের আবক্ষ মূর্তি

আরও পড়ুন-৩ বার তাজমহল, ২ বার লালকেল্লা বিক্রি করে দিয়েছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় ঠগ নটওয়ারলাল!

প্যারিসে তিনি আশ্রয় নেন দুই ফ্রেঞ্চ ভাইবোন গ্যারি এবং রেনের বাড়িতে। এই ভাই বোনের জুটি প্যারিসে সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে গেস্টাপো এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন এবং প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করত। যথারীতি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেও এদের যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই এদের বাড়িতে আশ্রয় পান নূর ইনায়াত খান। ক্রমে এই পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন নূর। এই সময়ে আরেক ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট ফ্রান্স এন্টেম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন তিনি। ঘটনাচক্রে এই ফ্রান্স এন্টেম্প ছিলেন রেনের প্রেমিক। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্স এবং নূরের এই ঘনিষ্ঠতা ভালো চোখে দেখেননি রেনে। শোনা যায়, রেনেই গেস্টাপোর সদস্যদের নূরের অবস্থান সম্পর্কে খবর দিয়েছিলেন। নূর জানতে পেরে পালানোরও চেষ্টা করেন, কিন্তু সব বৃথা হয়। রেনের বিশ্বাসঘাতকতার জেরে ১৩ অক্টোবর গেস্টাপো বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন সিক্রেট এজেন্ট মেডেলিন ওরফে নূর ইনায়াত খান।

এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারিসে গেস্টাপোর সদর দপ্তরে। নূরের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় গেস্টাপো অফিসাররা। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মুখ থেকে কোনও তথ্য বার করতে পারেনি তারা। এমনকী মেডেলিনের আসল নামটুকুও জেরায় বার করতে পারেনি তারা। বন্দি থাকাকালীন কয়েকজন ফ্রেঞ্চ সিক্রেট এজেন্টের সঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা করেন নূর। ২৬ নভেম্বর রাতে প্রথমবার পালাতে গিয়ে গেস্টাপো বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান তাঁরা। এরপর নূরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর নূর-সহ বেশ কয়েকজন সিক্রেট এজেন্টকে দক্ষিণ জার্মানির ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঘাড়ের পিছনে গুলি করে হত্যা করা হয় নূর ইনায়াত খানকে। শোনা যায় মৃত্যুর সময় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত শেষ শব্দটি ছিল ‘Liberté’ যার অর্থ ‘স্বাধীনতা’।

‘আ কল টু স্পাই’ সিনেমায় নূর ইনায়াত খানের ভূমিকায় রাধিকা আপ্তে

ভারতের ক’জন এই বন্দিত বীরাঙ্গনাকে মনে রেখেছেন সন্দেহ আছে, তবে ব্রিটিশ সরকার ভোলেনি তাদের মেডেলিনকে। ১৯৪৯ সালে ব্রিটেনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক মরণোত্তর সম্মান জর্জ ক্রস প্রদান করা হয় নূর ইনায়াত খানকে। ফ্রান্সের তরফে ভূষিত করা হয় ‘ক্রোয়া দ্য গ্যের’ সম্মানে। ২০১২ সালে লন্ডনের গর্ডন স্কোয়ার গার্ডেন্সে তাঁর একটি ব্রোঞ্জ-নির্মিত আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। ২০২০ সালের অগাস্টে নূরকে সম্মানিত করা হয় ব্রিটেনের ‘ব্লু প্লেক’ সম্মানে। প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি এই সম্মান লাভ করেন। এছাড়াও নূরের জীবন বারবার বই এবং সিনেমার উপজীব্য হয়েছে। শ্রাবণী বসুর লেখা নূরের জীবনী ‘স্পাই প্রিন্সেস’ মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। এই বইয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় তাঁর বায়োপিক ‘আ কল টু স্পাই’। ছবিটিতে নূরের ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে।

More Articles