বাধা নয় হিজাব, নাসার হাত ধরে মহাকাশের পথে প্রথম আরব-নারী

Nora Al Matrooshi, First Arab woman: নীল ফ্লাইট স্যুটে আজ নোরার নাম তো জ্বলজ্বল করছে নোরার নাম, আর তার সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির পতাকা। তবে শুনতে সহজ মনে হলেও, মোটেও সহজ ছিল না এই মহাকাশ ছোঁয়ার পথ।

মহাকাশে মেয়েরা পাড়ি দিয়েছেন আগেই। তবু নোরা আলমাতরুশির জন্য এই সাফল্য কিছু কম নয়। কারণ যেখান থেকে উঠে এসেছেন নোরা, সেখানে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোতে গেলেও বাধার পাহাড় টপকাতে হয়। তাই কল্পনা চাওলা বা সুনিতা উইলিয়ামস হওয়ার পথটা সহজ ছিল না বছর তিরিশের নোরার জন্য।

তবু স্বপ্ন কী না পারে! ছোট থেকেই আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত বাচ্চা মেয়েরা। ধরাছোঁয়ার পৃথিবীর বাইরে ওই তারা ভরা আকাশে যে অপার, অসীম রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, তার পর্দা ছিঁড়ে সত্যটিকে ছিনিয়ে আনতে ভারী ইচ্ছা হত তাঁর। তারা ভরা রাতে এক থালা চাঁদ দেখে ইচ্ছে হত ছুঁয়ে দেখতে ওই আশ্চর্যকে। স্কুলে শিক্ষিকাদের থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা আর সেই স্বপ্নের টানই একদিন সেই ছোট্টো মেয়েকে পৌঁছে দিল নাসায়।

আরব-বিশ্বের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী নোরা আলমাতরুশি। আর এই সাফল্য সম্ভবত বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী নারীর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। নোরাই প্রথম আরব মহিলা, যিনি নাসার ট্রেনিং প্রোগ্রামে স্নাতক হয়েছেন। সামনেই খুব বড় মিশন। নাসার নয়া মিশনে 'দ্য ফ্লাইজ' টিমের সঙ্গে এবার মঙ্গলে পাড়ি জমাতে চলেছেন নোরাও। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে শুরু হবে তাঁদের যাত্রা।

আরও পড়ুন: ৩৭১ দিন কক্ষপথে ঘুরপাক! অবশেষে বাড়ি ফিরলেন ৩ মহাকাশচারী

নোরা তখন এলিমেন্টরি স্কুলে। একদিন ক্লাস চলাকালীন স্কুলের এক শিক্ষিকা তাবু খাটিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাসের মধ্যে। ধূসর কাপড়ে ঢেকে দিয়েছিলেন সব কিছু। বিভিন্ন জিনিসপত্র কেটে পড়ুয়াদের জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন স্পেসস্যুটের মতো পোশাকও। আর ক্লাসে পা রাখতে না রাখতেই ছাত্রীদের তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন চন্দ্রপৃষ্ঠে। আর সেইদিনই বোধহয় নোরার ভিতরে চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্নের বীজটি পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি সস্নেহে। সেই থেকেই চাঁদ ছোঁয়ার ইচ্ছা বুকে করে এগিয়ে গিয়েছেন নোরা। আর শেষপর্যন্ত সেই স্বপ্ন পূরণের দোরগোরাতেও পৌঁছে গিয়েছেন সেদিনের সেই খুদে মেয়ে।

নীল ফ্লাইট স্যুটে আজ নোরার নাম তো জ্বলজ্বল করছে নোরার নাম, আর তার সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির পতাকা। তবে শুনতে সহজ মনে হলেও, মোটেও সহজ ছিল না এই মহাকাশ ছোঁয়ার পথ। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় এমনিতেই নানা ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে হয় মেয়েদের। সেই সমস্ত বাধা সরিয়েই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা শেষ করেছিলেন নোরা। তার পর তিনি কাজ পান তেলের কারখানায়। ২০২১ সালে হঠাৎ করেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহির স্পেস এজেন্সি (ইউএইএসএ) দু'জন ক্যান্ডিডেটকে বেছে নেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেস নাসা-র ট্রেনিং প্রোগ্রামের জন্য। সেই দু'জনের মধ্যে একজন ছিলেন নোরা। দু’বছর ধরে চলেছিল কড়া প্রশিক্ষণ ও স্পেসওয়াক অনুশীলন। নোরার সঙ্গেই নাসা-র ট্রেনিং প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিক হয়েছিলেন মহম্মদ আলমুল্লা নামে আর এক আরবের যুবক। তিনি এবং আরও দশ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তকে নিয়ে নাসা তৈরি করেছে একটি টিম, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'দ্য ফ্লাইজ'।

শুধু মঙ্গলেই নয়, চাঁদের পাড়ি দেওয়ার কথা রয়েছে নতুন এই দলের। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে সেই প্রস্তুতি। তবে কবে নাগাদ যাত্রা শুরু করবে তাঁরা, এ বিষয়ে এখনও কিছু স্পষ্ট করে জানানো হয়নি নাসার তরফে। চলতি বছরের শুরুর দিকে আমেরিকার তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, চাঁদের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করার জন্য স্পেস স্টেশন গেটওয়ের জন্য এয়ারলক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। আর্টেমিস-সহ একাধিক মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি তো হতে চলেছে চলতি বছরেই।

নাসার মিশনে জায়গা করে নেওয়া প্রথম আরব নারী নোরা। তবে এর আগে ব্যক্তিগত মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন সৌদি বায়োমেডিক্যাল গবেষক রাইয়ানাহ বার্নাওয়ি। গত বছর অ্যাক্সিওম স্পেসের সাথে আইএসএস-এ উড়ে গিয়েছিলেন রাইয়ানাহ। ২০২২ সালের ব্লু অরিজিন সাবঅরবিটাল ফ্লাইটের ক্রু হিসেবে মহাকাশে যান তিনি। তবে এর আগে আরব বিশ্বের আর কোনও নারী নাসার মহাকাশ প্রোগ্রামে সুযোগ পাননি। সেই নিরিখে নোরাই প্রথম।

মহাকাশে যাওয়ার এ হেন দুর্দান্ত সুযোগ পেয়ে আপ্লুত নোরা। তিনি জানান, সমগ্র মানবজাতিকে বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। শুধু মঙ্গলে বা চাঁদে নয়, তার বাইরের গ্রহদের জয় করুক মানুষ। আর সেই স্বপ্ন নিয়েই নতুন উড়ানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এই আরব-কন্যা। তবে মহাকাশযাত্রার জন্য নিজের দেশের রীতিনীতি বা বিশ্বাসকে কিন্তু ঝেরে ফেলতে নারাজ তিনি। মুসলিম বিশ্বাসের অংশ হিসেবে তার দেশে হিজাব পরা রীতি। মহাকাশচারীর পোশাক-আশাকেও কিন্তু সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা হতে দেননি তিনি। বরং নাসার আইকনিক সাদা স্পেস স্যুট এবং হেলমেট পরার সময় যাতে তিনি চুল ঢেকে রাখতে পারেন, তার জন্য একটি বিশেষ কৌশল তৈরি করা হয়, যা আনুষ্ঠানিকভাবে এক্সট্রাভেহিকুলার মোবিলিটি ইউনিট বা ইএমইউ নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন: হিজাব নয়! কর্নাটক থেকে ইরান, আন্দোলনের মূল মন্ত্র নারীস্বাধীনতা

নাসায় তাঁর জন্য তৈরি হয়েছিল কাস্টমাইজড মহাকাশ স্যুট। স্যুট ইঞ্জিনিয়াররা তাঁর জন্য একটি অস্থায়ী হিজাব সেলাই করে পাঠিয়েছিলেন, যাতে সেটি পরে তিনি স্পেস স্যুট ও কমন ক্যাপ পরতে পারেন। নোরা জানিয়েছেন, এটা তাঁর জন্য পরম প্রাপ্তি যে তাঁর বিশ্বাস রক্ষা করার ব্যাপারে নাসা এতটা গুরুত্ব দিয়েছে এবং স্যুট ইঞ্জিনিয়ারদের এমন একটি পোশাক বানিয়ে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আরব-বিশ্বে জন্মানোর জন্য তাঁর লড়াইটা বেশি কঠিন ছিল, এমনটা কিন্তু মনে করেন না নোরা। বরং তিনি বিশ্বাস করেন, এর আগে যে মুসলিম বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতরা এসেছেন, যাঁদের মহাকাশ এবং নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা আমাদের ঋদ্ধ করেছে, তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবেই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান নোরা।

More Articles