অপরের জন্য লিখে সাহিত্যে নোবেল, কে এই জন ফসে?

Nobel Prize in Literature 2023: ফসে তাঁর ভাষার জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। উপন্যাস, কবিতা থেকে নাটক, প্রায় সব শাখাতেই তুখোড় তাঁর কলম।

তিনি যা লিখছেন, তা আগে কোথাও না কোথাও লেখা হয়ে গিয়েছে। সেই বিশ্বাস থেকেই কলম তুলে নেন তিনি। আর সেই বিশ্বাসই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায় ভালো লেখা, আরও ভালো লেখার দিকে। আর সেই অবিরাম সাহিত্যসাধনাই তাঁকে এনে দিল স্বীকৃতি। ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতে নিলেন নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক জন ফসে। না-বলা কথা, অব্যক্ত যা কিছু, বরাবর ভাষা পেয়েছে তাঁর কলমের কাছে এসে। সমাজে পিছিয়ে পড়া, কন্ঠহীন যে, সে পেয়েছে বলিষ্ঠ স্বর। আর সেখানেই সতন্ত্র তিনি। এক বৃদ্ধ চিত্রশিল্পী, আর এক সঙ্গীহীন মহিলা, বৈধব্য যাকে গ্রাস করেছে জীবনের অধ্যায়ে। তাঁদের একাকী জীবন এবং যাপনের প্রতি পদে পদে কীভাবে ফুটে ওঠে ধর্ম থেকে শিল্প, পারিবারিক জীবনের বাস্তবতা- সেই নিয়েই গল্প বোনেন লেখক। লেখেন সেই তরুণী মায়ের কথা, যে বাধ্য হয় সন্তানকে বদ্ধ ঘরে একলাটি ছেড়ে যেতে। যা প্রতিনিয়ত ঘটে, ঘটারই কথা, তার ভিতর থেকে শিল্পবোধ খুঁজে আনেন যিনি, তিনিই ফসে। যে 'ম্যাগনাম ওপাস' উপন্যাসের জন্য ফসে এই বিরল সম্মান পেলেন, তা লেখা হয়েছে নরওয়ের সংখ্যালঘু নিনর্স্কে ভাষায়। আর সেই সংখ্যালঘু ভাষার রূপকথাই জিতে নিয়েছে ২০২৩ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।

অক্টোবর মানেই যেন নোবেলের মাস। ইতিমধ্যেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা-সহ একাধিক বিষয়ে নোবেল পুরস্কার। তবে বিজ্ঞানের থেকেও প্রতিবছর যে বিভাগটি নিয়ে উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে, তা হল সাহিত্য। গতবার এই খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক অ্যানি আর্নো। এবার সেই শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছেন নরওয়ের সাহিত্যিক জন ফসে। জানা গিয়েছে, সলমন রুশদি, মাস পিনখনের মতো সাহিত্যিক ছিলেন ফসের সঙ্গে নোবেলের লড়াইয়ে। কঠিন লড়াই ছিল চিনের লেখক ক্যান ঝিউ এবং কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গের সঙ্গেও। তবে শেষপর্যন্ত শেষ হাসিটি হেসেছেন নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক ফসেই। তাঁর 'ম্যাগনাম ওপাস' ছিনিয়ে নিয়েছে সাহিত্যে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

আরও পড়ুন: পরমাণুর অন্তরে কখন কী করছে ইলেকট্রন? কল্পনাকে বাস্তব করে নোবেলজয়ী ত্রয়ী

ফসে তাঁর ভাষার জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। উপন্যাস, কবিতা থেকে নাটক, প্রায় সব শাখাতেই তুখোড় তাঁর কলম। এবার সেই জনপ্রিয়তার মুকুটে যুক্ত হল নয়া স্বীকৃতির পালক। বৃহস্পতিবার স্টকহোমে সুইডিশ অ্যাকাডেমির তরফে ঘোষণা করা হয়েছে এই পুরস্কার। জানানো হয়েছে, ২০২৩ সালের সাহিত্যে নোবেলটি ফসে পেয়েছেন তাঁর উপন্যাস 'ম্যাগনাম ওপাস'-এর জন্য। যেখানে মানুষের না বলা কথা, অব্যক্ত স্বরগুলিকে ঋজুভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি, পেরেছেন শিল্পে উন্নীত করতে।

Norwegian author Jon Fosse wins Nobel Prize in Literature for 2023

ফসে যে শৈলিতে উপন্যাসগুলি লেখেন, তা 'ফস মিনিমালিজম' নামে পরিচিত। একেবারে নিজস্ব একটি আঙ্গিক, সাহিত্যের ধারায় নিজস্ব একটি চেতনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। যা ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এ বছরের সাহিত্যে নোবেলটি তাঁর নামে জানার পর ফসে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সাহিত্যে পুরস্কার পাওয়াটা সম্মানের পাশাপাশি দারুণ ভীতিরও বটে। ফলে তিনি যতটা অভিভূত, ততটাই নাকি শঙ্কিতও। তবে ফসে মনে করেন, এ পুরস্কার সাহিত্যের জন্য বিরাট মর্যাদার তো বটেই। কার্যত একে শুধুমাত্র সাহিত্যেরই পুরস্কার বলা চলে।

Norwegian author Jon Fosse wins Nobel Prize in Literature for 2023

ফসের জন্ম ১৯৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। নরওয়েকে বলা হয় নিশিথ সূর্যের দেশ। সেই দেশের পশ্চিম উপকূলে জন্মগ্রহণ করেন ফসে। ৬৪ বছর বয়সে তিনি লিখে ফেলেছেন ৪০টির কাছাকাছি নাটক, অসংখ্য উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ। শুধু বড়দের জন্য নয়, শিশুদের জন্য লেখাতেও সমান সিদ্ধহস্ত তিনি। করেছেন একাধিক বইয়ের অনুবাদও। হেনরিক ইবসনের পর জনপ্রিয়তম নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম মনে করা হয় ফসেকে। ইবসনের পর বোধহয় ফসেই এমন এক নাট্যকার, যার নাটক সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চায়িত হয়েছে। এ জন্য অনেকেই তাঁকে ডাকেন 'নিউ ইবসন'।

Norwegian author Jon Fosse wins Nobel Prize in Literature for 2023

সাহিত্যের মূল কথাই কল্পনা। আর সেই কল্পনার কাঁধে ভর করেই সাহিত্যকে এই অন্যস্তরে নিয়ে যেতে পেরেছেন ফসে। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাউথ, স্বার্ত (লাল,কালো) প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৯৯ সালে প্যারিসে মঞ্চস্থ হয় তাঁর নাটক 'নকন জে তিল আ কোমে'। তাঁর জনপ্রিয়তম সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম তাঁর লেখা 'আ নিউ নেম: সেপ্টোলজি VI-VII'। যা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কণ্ঠস্বর, তাঁদের কথা বারবার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর কলমে। কণ্ঠস্বরহীনদের বলিষ্ঠকণ্ঠ হয়ে উঠতে চেয়েছে তাঁর কলম। ম্যাগনাম ওপাসের জন্য নোবেল পেলেও ফসের দ্বিতীয় উপন্যাস 'স্টেংড গিটার' থেকেই ডালপালা ছড়াতে থাকে তাঁর নিজস্ব শৈলি। যাকে ফস মিনিমালিজিম বলা হয়। রোজের জীবনে যা ঘটছে, ঘটে থাকে তাকে নান্দনিকতার মোড়কে মুড়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন ফসে। তাতে প্রতিদিনের আবিল জীবন যেমন থাকে, থাকে অনাবিলতার দিকে যাত্রাও।

আরও পড়ুন: এলইডি-তে বহুল ব্যবহার, যে প্রযুক্তির আবিষ্কার বিজ্ঞানী-ত্রয়কে এনে দিল রসায়নে নোবেল

যে ভাষায় তিনি এই 'ম্যাগনাম ওপাস' উপন্যাসটি লিখেছেন, সেই নিনর্স্কে নাকি আদতে নরওয়ের সংখ্যালঘুদের ভাষা। নরওয়ের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। উনিশ শতকে যেসব গ্রামীণ উপভাষা বিকশিত হয়েছিল নরওয়েতে, তার সমান্তরালে বেড়ে উঠেছিল এই সংখ্যালঘু ভাষা। যা ড্যানিশ প্রভাবের বিকল্পশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে একসময়ে সেখানে। ৪০০ বছরের ডেনমার্কের ঔপনিবেশিকতা ভেঙে উঠে আসার ভাষা হয়ে উঠেছিল সেটি। আর সেই ভাষাটিকে স্বীকৃতি দিতে, সেই আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই সেই ভাষাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন ফসে। যা শেষপর্যন্ত তাঁকে এনে দিল সর্বোচ্চ নোবেল-সম্মান। যে সম্মানে অভিভূত গোটা বিশ্বের আপামর সাহিত্যজগৎ।

 

More Articles