কৃপাসিন্ধু মাংসঠাকুর ও গুহমশাইয়ের রাতবিরেতের ফোন
Barabil and Buddhadeb Guha: সে রাতের পূর্ণিমার চাঁদ নিশ্চিতভাবেই এখনও মনে রেখেছে পাইড পাইপারের নাম, বুদ্ধদেব গুহ।
রোদ্দুরের একটা আলাদা জীবন থাকে, ধর্ম থাকে, আদবকায়দা ইত্যাদি, আমি একশো শতাংশ শিওর। এ প্রায় অনন্ত চরাচরে ওম বিলোচ্ছে যে, সেই কোন আদি যুগ হতে, কই কখনও ভেবে দেখি না তো, কোথায় সে রশ্মি প্রখর ছন্দময়, কোথায় আলতো জলরূপ। আমার যেন মনে হয়, রোদঠাকুরের মাঝ-আশি বরাবর, আমার বয়সই একটা পুত্র বা কন্যা সন্তান ছিল, হয়তো আছেও বা! নইলে কী করে তিনি বুঝতেন, আজ একটু অধিক ঝলমলাই। আজ বলতে ১৯৮৮-৮৯ সালের এক বিশ্বকর্মা পুজোর সকাল। আমায় স্কুলে বেরতে হতো সাত তাড়াতাড়ি, সকাল ৭-টা। আমার স্কুল সেন্ট মেরি’জ, এখনও আমি যেখানে সন্তপর্ণে রোজ ফিরে যাই। কিন্তু এই এক দিন কিছুতেই ইচ্ছে করত না চোখ খুলতে, শত মা’র ডাকাডাকিতেও।
কারণ কাল রাতেই তো হাতি চেপে ঠাকুর চলে এসেছে সাইডিংয়ে। মুখ ঢাকা, তবুও তো চলে এসেছে। সাইডিং কেন বলা হতো জায়গাটাকে জানি না। আসলে আমাদের বাড়ির লাগোয়াই ছিল বাবার অফিস, কেমিস্ট্রি ল্যাব আর ওই সাইডিং নামক জায়গাটিতে ডাঁই হওয়া আয়রন বা অ্যালুমিনিয়াম ওর। গোল গোল লাল ও নীল সুপারম্যানের মতো শক্তিমান টিনের কন্টেনারে যদ্দিন না ওই আয়রন ওর বা ওরা জাপান-টাপান জাহাজে চড়ে চলে যেত, তদ্দিন সাইডিংয়ের রং চোবানো লালচে। তো ওই সাইডিংয়ের একটি সাফা করা অংশে ফুল-মালার এক চৌহদ্দি হতো বিশ্বকর্মার। মা আমায় ভুলিয়েভালিয়ে যতক্ষণে অল্প বিষণ্ণ সেই রোদ্দুরে নিয়ে এসে ফেলত, যে রোদ্দুর আমার পিছু নেবে ক্লাসঘরে ঢোকার আগে অবধি, ততক্ষণে দনা দাদা, বিরো দাদা, নবীন দাদা’রা খুলে নিয়েছে ঠাকুরের মুখ, এক দমকা আমায় দেখাবে বলেই? কোথাও এই অটল বিশ্বাস আজও পুষে রাখি হৃৎকমলে। ক্লাসে সেদিন কিছু কম আসত বন্ধু, কারও স্কুল বাস পুজোয় গেছে বলে, কারও নেমন্তন্নের ঢল কেউ বা এমনিই হয়তো, খেয়াল নেই আজ আর। কিন্তু খেয়াল আছে এক মরমী হাওয়া অপেক্ষা করত ক্লাস থেকে অল্প দূরে, পেট ফেটে আসছে তার জানি, যতক্ষণ না উগরে দিতে পারছে আমার সম্মুখে মাংসঠাকুরের মায়াঘ্রাণ।
আরও পড়ুন- বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
আহা এ কি যে সে খুন্তিনাড়া? ওই সাইডিংয়ের ঠিক পাশেই যেখানে জিপ গাড়িটা থাকত, সেখানেই হইহই করে বসেছে ইঁটঘেরা উনুন, কাঁধে চেপেছে পেল্লাই হাঁড়ি, আর দূরে বাজছে 'তিরছি টোপিওয়ালে, ও বাবু ভোলেভালে'! খানিক দূরেই কুচোনো চলছে পেঁয়াজ, রসুনেরা সার বেঁধে যুদ্ধে নামবে বলে তৈয়ার, খাসির মাংসের গায়ে হলুদ অলরেডি ডান আর অফিসের অ্যাকাউন্টস সামলানো বড়বাবু পাণ্ডাকাকু রণপা-সমান লম্বা খুন্তি নিয়ে চশমা’র নীচ দিয়ে দেখে নিচ্ছে সামনের বাইশ গজ পাটা না সামান্য ঘাঁটা। ওদিকে তাকাতে তাকাতেই আমি ফিরে আসতাম ঘর। সে দিন প্রায় ২ বিএইচকে সমান বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি আর সামনের পুকুরে রোদের জ্যামিতি বা তা পেরিয়ে বিস্তৃত ধানখেত দেখতাম না। তড়িঘড়ি সানমাইকা মোড়া খাবার টেবিলে এসে বসতাম, কোনও বাড়তি ডাকাডাকি ছাড়াই। মাকে বৌদি বলে ডাক তো পেয়েইছি আমি অলরেডি। মানে নবীনদাদা দরজায় দাঁড়িয়ে গরম ভাতের থালা হাতে আর সেই বাটিভরা অমৃত। মন্টা/পুপাই আগে খাবে, তার পর ওর লজ্জাঢাকা হাসির ইশারায় আগামীর উৎসব। পড়ন্ত সূর্যের শেষ প্রখরতার রং ডুমো আলুতে, চর্বিতে মন্ত্রমুগ্ধ নরম তুলোমায়া তুলোমায়া আর সদ্য যুবরাজ চিহ্নিত হওয়ার প্রতাপ মেটে-য়। ভাতের গরম যতক্ষণে থিতু হত, আমি তাকিয়ে থাকতাম জানলা ছাড়িয়ে নিমগাছ, নিমগাছ ছাড়িয়ে পুকুর, ধানখেত, সেই ঠাকুরানি পাহাড় পর্যন্ত, যেখানে তখন রোদের পুত্র/কন্যা কিঞ্চিৎ জিরোতে বসা পিতাকে (না মাতাকে? রোদ্দুর কোন লিঙ্গ?) গোল ঘুরে ঘুরে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। বা হয়তো স্রেফ নাস্তানাবুদের ভান করছেন পিতা/মাতা। ক্ষণিকের তরে ডাকাবুকো হয়ে ওঠা সন্তানের ইচ্ছেফুলে আঁজলাধরা জলীয় ভাপ শুধোচ্ছেন তাঁরা। আফ্টার অল এক দিন তো সব বিকেলেরই রং হবে ধূসর। এনিওয়ে, বোধ হয় সে দিন নিজ গোলার্ধে ঠিক ওই রোদ দেখেই চন্দ্রিল-অনিন্দ্য বহু কাল পর লিখবেন, এক ফুরফুরে রোদের জন্মদিন!
আজ বুঝি, বিশ্বকর্মা পুজোর সে ভাতমাখামাংস ছোঁয়া দুপুরেই অন্তরমহলে বীজ রোপণ হয়েছিল আমার জিভে প্রেমের। অবশ্য স্রেফ বিশ্বকর্মা আর পাণ্ডা কাকুকে সে প্রেমের মেন অফ দ্য ম্যাচ (ঈশ্বরকে এখানে হিউম্যান করে নিলাম!) ধরিয়ে দিলে পাপ দেবেন বুদ্ধদেব। আহা, গুহমশাই। তা তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাহিত্যিক না হয় ছিলেনই, তা বলে কি অন্য কাজ করতে নেই? আগেও এসেছেন বরবিল তিনি শুনেছিলাম, তো সেই বারও এলেন কিছু কোম্পানির অডিট করতে। আমি বেজায় পুঁচকে, আমায় সবাই গাবলুশ বলে গাল টিপে দেয়, ফলে প্রবল ক্রোধ আমার, আর এক কাকু শিখিয়ে দিয়েছিল এ রকম কেউ করলেই কোল থেকেই পা ছুঁড়ে দিতে, যেমন সেকালে বড় দাদা বা ফাজিল কাকু’রা হতো আর কী। আমিও তাই থেকেই প্রথম চান্সেই পা দিয়ে মাব্বো মোডে থাকতাম। ওমা, পা দিয়ে মাব্বো শুনে আবার কিছু কাকিমা এখনকার ভাষায় হাউ কিউট বলে আরও গাল টিপে দিতে আসত। আমি মায়ের কাঁধে অভিমানী ও ফ্রাস্ট্রেটেড তখন, কিন্তু মা প্রবল এমব্যারাস্ড ও রাগ চেপে, আমার ও হেন অভব্যতায়! তা অমনই এক দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ক্ষণে প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। বেজায় পুঁচকে ছিলাম বললাম না, অতএব কী বলেছিলেন বা কী হয়েছিল মনে নেই। যা মনে ধরেছিল পরে, মায়ের মুখে শুনে, তা হলো তিনি আমার হেনস্থার নিন্দা করেছিলেন, ফলে ওই পা দিয়ে মাব্বো’র মধ্যে যুক্তিও খুঁজে পেয়েছিলেন। বুঝেছিলাম, না! মানুষটা সাচ্চা দিলের দেখছি। সই পাতানোই যায়।
আরও পড়ুন- অতল খাদের আহ্বান থেকে হতভাগাদের মুক্তি নেই
সই এক রকম পাতিয়েছিলেন তিনিই, আমি অবশ্য বিশেষ বুঝতে পেরেছিলাম এমনটা নয়। হয়েছিল কী না, তিনি জঙ্গল তো প্রকাণ্ড ভালোবাসতেন। আর বরবিল জুড়ে বাঙালির যা দাপট, বুদ্ধদেববাবু’র খেলার সাথীর অভাব ছিল না। মা-বাবা যেত ওই সে ক’দিন প্রায় প্রত্যেক বিকেলেই মিত্রায়েস্কে-র (না রাশিয়ান কিছু না, আদ্যোপান্ত বাঙালি এক কেম্পানির নাম – মিত্রা এস কে, মানে এস কে মিত্র!) পাশেই ওই দুর্গাপুজোর মাঠ লাগোয়া কমিউনিটি হল-এ। তেড়ে আড্ডা-ফাড্ডা, চা-ঘুগনি অতঃপর। ওহ্, আর গুহমশাইয়ের বৈঠকী গান। আচ্ছা এক মিনিট, আমি কিন্তু আদপেই দাবি করছি না যে, ওই সেদিন থেকেই আমার পুরাতনীর ফাউন্ডেশনটা একেবারে ঝরঝরে হয়ে গিয়েছিল! কী সব আস্তে আস্তে হচ্ছে, মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে উঠছি, অদ্ভুত বিরক্ত হয়েছিলাম, যেমন যে কোনও নর্ম্যাল বাচ্চাই হতো। কিন্তু ওই টপ্পা আর খাসির মাংসের এই জ্বালাময়ী কম্বিনেশন যে এক ঘনঘোর পূর্ণিমার রাতে কিরিবুরু’র জঙ্গলে কোন লীলা রচেছিল, তা সে রাতে যারা সেখানে ছিল না, কচু বুঝবে! সে রাতের পূর্ণিমার চাঁদ নিশ্চিতভাবেই এখনও মনে রেখেছে পাইড পাইপারের নাম, বুদ্ধদেব গুহ।
আগামী পর্বের জন্যে না হয় তোলা থাক, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আসা বুদ্ধদেববাবুর সেই আচমকা ফোনের পর এগজ্যাক্টলি কী হলো! সেই গোল ডায়ালওলা ফোন। আমাদেরটার রং ছিল লাল। আমার ঘুম তখন অ্যাটলিস্ট ১৫ ওভার কাটিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ খেয়াল হলো অস্বাভাবিক এক কাণ্ড ঘটছে। মা আমায় এগারোটা নাগাদ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলছে। চোখ খুলে শুনি এক্ষুনি বেরতে হবে, উনি এসে পড়লেন বলে! তা এসে পড়ে করবেন কী? কেন? ওই রাতবিরেতে কিরিবুরুর জঙ্গল যাবেন, আমাদের মতো পাল পাল বাঙালি সঙ্গে নিয়ে…