এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে

Mastan Kana Ajit: দুই ছেলে সঙ্গে নিয়েই একদিন কানা অজিতকে ছেড়ে গেল ওর স্ত্রী। পরবর্তীকালে বিয়েও করল অন্যত্র। ঘরের মাঠে এত বড় গোল খাবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি অজিত।

জলা-জংলা, ঝোপঝাড় আর দরমার সারি সারি ঘরের পাশ দিয়ে মিলিটারি রোড চলে গেছে। ষাটের দশকের বাঘাযতীন। কলোনি গড়ে উঠেছে। দেশভাগের দগদগে ঘা শরীরে-মনে বয়ে নিয়েই বসতির পর বসতি জুড়ে বেঁচে থাকার কোলাহল। বাঘাযতীন বিদ্যাসাগর ই-ব্লক, আই-ব্লক তখন বৃষ্টি হলেই জলের তলায় চলে যায়। পুকুর, রাস্তা এক হয়ে যায়। বড় বড় রুই, কাতল উঠে আসে রাস্তায়। হোগলা বন বেয়ে জোলো হাওয়ায় শিরশির করে ওঠে গা।

এমন একটা আধা গ্রাম-আধা মফসসলে বড় হয়ে উঠছে ওরা। ওরা মানে অজিত, দীপক আর ভক্ত। বছর দশ-বারোর ছেলেপুলে ওরা। মিলিটারি রোড জুড়ে ছুটে বেড়ায়। লেখাপড়ায় মন নেই। বই-খাতা ফেলে দিনরাত রাস্তায় টো-টো করে। দারিদ্র্যতাড়িত সেই সময়ের কলোনি। প্রকৃতি,পরিবেশ, দারিদ্র্য, সব কিছুর বিরুদ্ধে অসম লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করে চলে মানুষ। আগে তো বাঁচবে! তারপর লেখাপড়া, তারপর তো মানুষ হওয়া!

মানুষ হওয়া হয় না ওদের। মানুষ কীভাবে হয়? কাকে বলে মানুষ হওয়া? এসব বুঝে ওঠার আগেই ছোট ছোট লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে ওরা। ছোট ছোট কারণে লড়াই শুরু হয়। পাড়ায় পাড়ায় ছোটদের গ্যাং। ভবিষ্যতের বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে যেন! ওই বয়সেই বোমার সঙ্গে পরিচয় হয় অজিত-দীপকদের। ওরা রাজনীতি বোঝে না কিন্তু কংগ্রেস বোঝে। বোঝে মানে, জানে। ওদের বাড়ির লোক কংগ্রেস। তাই ওরাও কংগ্রেসের লোকদের নিজের মনে করে। আর প্রতিদ্বন্দ্বী? সিপিএম। পঞ্চাশের মাঝামাঝি বাঘাযতীন, যাদবপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একদিকে রিফিউজি পরিবারগুলিতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মজবুত ভিত। অন্যদিকে কংগ্রেস। এরপর অজিত দাসরা যখন বড় হয়ে উঠছিল, সেই পর্বে এলাকায় দাপট বাড়াতে থাকে নতুন পার্টি সিপিআইএম। মাঝে মধ্যেই কংগ্রেস সিপিএম লড়াই লাগে। বোমাবাজি হয়। এই সেই পর্ব, যখন রাজনীতির সব পক্ষের হাতেই মজুত রয়েছে অস্ত্র। সকাল বিকেল অস্ত্রের ঝনঝনানি। ছোটখাট বিবাদ থেকে কার দখলে কোন কলোনি থাকবে, এই সব বড় প্রশ্ন! সবেতেই অবধারিত মারদাঙ্গা।

অজিতদের গ্যাং ইতিমধ্যেই গড়ে উঠছে। প্রতিপক্ষ সিপিএম-এর যুব মুখ পল্টু ভট্টাচার্য। পার্টি ক্লাস থেকে অ্যাকশন স্কোয়াড— সর্বত্র তিনি। এর সঙ্গেই অজিতদের লড়াই প্রথম থেকেই। একদিনের ঘটনা। মিলিটারি রোডের উপর পাড়ার চায়ের দোকান, আড্ডা চলছে। হঠাৎই ব্যাপক গোলমাল শুরু হলো খানিকটা দূরে। এরকমই হয়। হঠাৎ হঠাৎ মারপিট, গোলমাল, বাড়াবাড়ি হলে বোমাবাজি! এদিনও বোমাবাজি শুরু হয়ে গেল। ধোঁয়াই ধোঁয়া চারদিক। চায়ের দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিল দোকানদার। ক্রেতাদের মধ্যে যে যার মতো ঢুকে গেল গলি-গলতায়। বোমার আওয়াজে এলাকা কাঁপতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে চলল। তারপর একসময় সব চুপচাপ হয়ে গেল।
নিস্তব্ধতার মাঝখানেই দূর থেকে একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। চায়ের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিল যে কয়েকজন, ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে দোকানের ঝাঁপ ফাঁক করে।

আরও পড়ুন-মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! বাঘাযতীনের মস্তান কানা অজিত আজও কিংবদন্তি

"মনে হয় মাইরা ড্রেনে ফেলায় রাখসে," কে যেন বলে উঠল। বলছে বটে কিন্তু এগোবার সাহস নেই। জটলার মধ্যেই ছিল এক যুবক। কলেজে পড়ে। মা কংগ্রেসের নেত্রী স্থানীয়। কী হয়েছে দেখতে এগিয়ে গেল সে। কাছে গিয়ে যুবক দেখে ড্রেনের মধ্যে অজিত আর দীপক পড়ে আছে। খুব কাছ থেকে দেখবার জন্য মাথা ঝোঁকাল সে। দেখে, 'মরে নাই, বাঁইচ্যা আসে'। এক্ষুনি হাসপাতাল নিয়ে গেলে বেঁচে যেতেও পারে। দীপক আর অজিতকে ড্রেন থেকে তুলে বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যায় ওই যুবক। তখনও ধিকি ধিকি প্রাণ বেঁচে আছে। হাসপাতালে দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে দীপক আর অজিত, দু'জনেই বেঁচে যায়। এলাকায় ফিরে আসে। ওদের প্রাণ বাঁচিয়েছিল যে যুবক, একদিন রাস্তায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ওদের। কৃতজ্ঞতায় পা জড়িয়ে ধরে ওরা। সেই থেকে ওই উচ্চ শিক্ষিত যুবক ওদের কাছে 'বড়দা'। সাক্ষাৎ ভগবান! আর ওদের চোখে সাক্ষাৎ শয়তান পল্টু ভট্টাচার্য। সিপিএম-এর ইয়ং ব্রিগেড যার ইশারায় চলে।

বাঘাযতীন ই-ব্লকে এই বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন অজিত। এই জানালা দেওয়া ঘরেই

ততদিনে একচোখ হারিয়ে অজিত হয়েছে কানা অজিত। চাকু-বোমা-পিস্তলের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মদের নেশা। কারও কারও মতে ওই নেশার ঘোরেই মাছ ধরার বড়শির কাঁটা চোখে গেঁথে যায় অজিতের। ওই অবস্থাতেই কাঁটা ছাড়াতে পাল্টা টান মারে অজিত। পরিণতিতে চোখ খুবলে বেরিয়ে আসে। অজিত দাস ওরফে সঞ্জীব দাস হয়ে যায় কানা অজিত। কারও কারও কাছে শুধুই কানা। ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে রাজনৈতিক বিন্যাস পরিবর্তিত হয় দক্ষিণ শহরতলিতে। এলাকার রিফিউজি পরিবারগুলিতে তখন সিপিএম-সিপিআই দলগুলি শিকড় গেড়েছে। ভারত সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নীতি নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল। দণ্ডকারণ্য, আন্দামান, মধ্যপ্রদেশে তারা পুনর্বাসন চাইছিলেন না। তারা চাইছিলেন, কলকাতা লাগোয়া এলাকাতেই থেকে যেতে। এক্ষেত্রে তাদের দাবির সপক্ষে তারা সিপিআইএম বা বাম দলগুলিকে পাশে পাচ্ছিল। তাই শাসক কংগ্রেস ছাড়া বাম দলগুলি, বিশেষত সিপিআইএম-এর একটা প্রভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল উদ্বাস্তু পরিবারগুলিতে। ১৯৬৭-র যুক্তফ্রন্ট। সিপিআইএম-এর হাত ধরে রিফিউজিদের একাংশের প্রথম রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটল। মূলত সেই অংশের যারা কংগ্রেস-বিরোধী বলেই পরিচিত ছিলেন। ফলে দ্বন্দ্বও বেড়ে গেল। ১৯৬৭-র পর বাঘাযতীনের বিস্তীর্ণ অংশের কংগ্রেস কর্মীরা ঘরছাড়া হলো। এলাকা দখল নিল সিপিএম। অজিত দাসও তখন ঘরছাড়া। বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াল অজিত। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিজয়গড়ে আশ্রয় নিল।এরপর এল ১৯৬৯ সাল। নকশাল আন্দোলনের ঢেউ এইসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। টালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুরে নকশাল পন্থীদের দাপট বাড়ল যথেষ্ট পরিমাণে। টালিগঞ্জে ছিল প্রবল দাপট। পেশি শক্তি, মেধাশক্তি, লোকবল, সংগঠন সব কিছুতেই টালিগঞ্জে নকশালপন্থীদের মজবুত উপস্থিতি ছিল। যাদবপুরেও তাই। এই সময়টা জুড়ে অজিত ভক্তরা ধীরে ধীরে এলাকায় ফিরে এল। সিপিএম পরিবার থেকে আসা যুব প্রজন্মের অনেকেই তখন নকশাল। এই অবস্থাটাকে কাজে লাগাল অজিতরা।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। বাঘাযতীন মিলিটারি রোডে যেখানে এখন হাসপাতাল, সেখানে তখন কিছুই ছিল না। ঝিল-জলা ঘেরা অঞ্চল। রাস্তার উপর একটা কাঠ কয়লার দোকান ছিল। তার পেছনে বসে একদিন বোমা বাঁধছিল অজিত আর দীপক। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে তারা দেখে, উল্টোদিকে জেকে স্টোর্সের সামনে গোলমাল হচ্ছে। ওই বাড়ির ছেলে পলু নকশাল হয়ে গেছে। ওই নকশালপন্থী যুবককে পাকড়াও করে ঠেলা গাড়িতে চাপিয়েছে সিপিএম-এর অ্যাকশন স্কোয়াডের ছেলেরা। ঠেলায় দড়ি দিয়ে বেঁধেছে পলুকে। ওরা পলুকে নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই দু'হাতে দুটো বোমা নিয়ে প্রস্তুত অজিত। সিপিএম-এর প্রতি ওর রাগ,ঘৃণা বরাবর। মার খাওয়া, পাড়া ছাড়ার স্মৃতিটাও দগদগে হয়ে জিইয়ে আছে মনে। পলুকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে দেখেই বোম চার্জ করল অজিত। দীপকও বোম ছুঁড়ল। সিপিএম-এর ছেলেদের কাছে পিস্তল ছিল। ওরাও পাল্টা গুলি ছুঁড়লে ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। মনের যাবতীয় রাগ উগরে ফেলে ব্যাপক বোমা ছুঁড়ল অজিতরা। সিপিএম-এর অ্যাকশন স্কোয়াড পিছু হঠল। সেই যাত্রায় বেঁচে গেল পলু।

এভাবেই প্রতিদিন হানাহানি লেগেই ছিল। বোমার শব্দে সকাল হতো, বোমা পড়ত গভীর রাত পর্যন্ত। অজিতের দলবল বেড়েই চলেছে। অজিতের ভাই নির্মল এক অতি ঠান্ডা মাথার শ্যুটার। রীতিমত ডেঞ্জার। অজিতের উত্তেজনা বেশি, ছড়িয়ে ফেলে। কিন্তু নির্মল লক্ষ্যে স্থির। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকায় ত্রাস হয়ে উঠল নির্মল। কানা অজিতের দবদবা এলাকা জুড়ে। এভাবেই সময় গড়িয়ে গিয়ে একাত্তর সালে পড়ল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইন্দিরা গান্ধির জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। এই সময় একটা ঘটনা আকছার ঘটত। এ এক অলিখিত ইতিহাস। যা এইসব অঞ্চলের প্রবীণ মানুষদের বয়ানে আজও বেঁচে আছে। একাত্তর সালে জিপে কংগ্রেসের পতাকা লাগিয়ে অনায়াসে বর্ডার পার করত বাঘাযতীনের কানা অজিত, বিজয়গড়ের নিখিলরা। ওপারে তখন মুক্তিযুদ্ধের দৌলতে নানা কিসিমের অস্ত্র যেন খোলামকুচি। নিখিল-অজিতরা জিপ বোঝাই করে অস্ত্র নিয়ে আসত। তবে এ ব্যাপারে সিপিএমও পিছিয়ে ছিল না। অঞ্চলের প্রবীণদের মতে বাংলাদেশ থেকে আনা রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড, ছোট কামান তখন কলোনির সব রাজনৈতিক দলের কাছেই ঘুরছে। শুধু দক্ষিণ কলকাতা শহরতলি না, উপদ্রুত সব কলোনিতেই কমবেশি এই অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিল।

সবাই সাধ্যমতো অস্ত্র সংগ্রহ করল। অজিত অর্জন করল আরও বেশি কিছু। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের আবহে ইন্দিরা গান্ধির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সেই পরিবেশকে হাতিয়ার করে কংগ্রেস বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু করল। এই সময়েই কংগ্রেসের বাহুবলী অথবা মস্তান, যাই বলো না কেন, কলোনিতে ফিরতে লাগল। কানা অজিত বাঘাযতীনে ঢুকল সিআরপিএফ সঙ্গে নিয়ে। একাত্তরের আশেপাশে সিআরপিএফ কর্তাদের সঙ্গে যেভাবেই হোক ভাব জমিয়ে নিল কানা। ওদের কাছেই অত্যাধুনিক অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ পেয়ে গেল। এই বাহিনীর সঙ্গেই এবার বাঘাযতীনে ঢুকল কানা অজিত। সিআরপিএফকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে ও। প্রতাপ চতুর্গুণ হয়ে দাঁড়াল। এলাকায় অজিতের তাণ্ডবে পাড়া-ছাড়া হলো সিপিএম। বাহাত্তরের ভোটে কংগ্রেস ক্ষমতায় এল। এই ভোটে সিপিএম-এর বহু ইলেকশন এজেন্টকে গলফগ্রিনের মাঠে নিয়ে গিয়ে গলা কেটেছে অজিত। এমন গল্প সেই আমল থেকেই চাউর ছিল। আসলে গল্প নয়, ঘোর বাস্তব। একদিন বাঘাযতীনের এক সিপিআইএম সমর্থক ছুটতে ছুটতে গেল স্থানীয় এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি। ওই মাস্টারমশাই আর কেউ নন, অজিতের সেই বড়দা। যিনি জীবন বাঁচিয়েছিলেন অজিতের। একথা ওই সিপিআইএম সমর্থক জানেন। মাস্টারমশাইকে ওই বামকর্মী বলেন, "দাদা বাঁচান, আমার ছেলেকে কানা অজিত গলফগ্রিনের মাঠে নিয়ে গেছে। আপনি কিছু করুন।" গলফগ্রিনের মাঠ মানেই তখন নিশ্চিত মৃত্যু। কেউ ওই মাঠ থেকে বেঁচে ফেরে না। কানা অজিত সিপিএম-এর কাছে তখন আতঙ্কের অপর নাম। তো সেই মাস্টারমশাই ছুটলেন পাশেই সত্য বলে এক যুবকের বাড়ি। সত্য হলো অজিতের ক্যুরিয়ার, ইনফরমার গোছের একজন। মাস্টারমশাই সত্যকে বললেন, "ছুইট্যা যা, অজিতরে কইবি বড়দা পাঠায়সে, অমুক ছেলেডারে তুমি ছাইড়া দাও।" সত্য সাইকেল করে গিয়ে দেখে, গাছের সঙ্গে সারি দিয়ে বেশ কয়েকজন বাঁধা। অজিত বাহিনীসহ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। সত্যকে দেখে একটু চমকে গেল অজিত।

"কী হইসে রে? তুই এইখানে ক্যান?"

"দাদা বড়দা পাঠাইসে, কইল এই নামের পোলাডারে ছাইড়া দিতে।"

কাগজে লেখা নামটা দেখেই অজিত শাগরেদদের বলল, "ওরে ছাইড়া দে।"

নিজের জীবন ফিরে পেয়েছিল অজিত যাঁর বদান্যতায়, তাঁর অনুরোধ ফেলবে কীভাবে! বড়দাকে সত্যি সত্যিই সম্মান করত অজিত, নির্মলরা। এভাবেই অজিতের বড়দা ওই মাস্টারমশাই অনেক সিপিএম সমর্থকদের প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। তবে এসব ব্যতিক্রম। বাহাত্তরে অজিত জ্বলজ্যান্ত এক ত্রাস এলাকা জুড়ে!

আজকের বাঘাযতীন মিলিটারি রোড

আরও পড়ুন-ভবানীপুরের ডন, কুঁদঘাটের বোম! দক্ষিণ কলকাতা কাঁপাতেন যে মস্তানরা

বাহাত্তরে কংগ্রেস ক্ষমতায় এল। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। অজিতের মানুদা। এই সময়ই সিদ্ধার্থ-জায়া মায়া রায় এসেছিলেন বাঘাযতীনে। চেপেছিলেন অজিতের বাইকের পেছনে। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যারিস্টার স্ত্রীকে মোটরসাইকেলে চাপিয়ে নিজের প্রতিপত্তি জাহির করেছে অজিত। শোনা যায়, অজিতের একতলা ছোট বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছেন মায়া রায়। যখন এদিকে কোনও অনুষ্ঠানে এসেছেন, তখনই অজিত তাঁর সঙ্গী হয়েছে। এই বিপুল প্রতিপত্তি কানা অজিত ছাড়া কেউ অর্জন করতে পারেনি দক্ষিণ শহরতলিতে। অজিত একাই একশো।

এই সময় আরও একটা ঘটনা ঘটল। বাঘাযতীন বাজারের সামনে একটি বাম সমর্থক পরিবার ছিল। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির। এক ছেলে আর এক পরমা সুন্দরী মেয়ে। যাতায়াতের পথে অনেক দিনই এই পরিবারটিকে দেখেছে অজিত, মুখে কিছু বলেনি। তবে মাথায় ঘুরেছে কিছু একটা। তা ওর হাবভাব দেখেই বোঝা যেত। একদিন অজিত একটা কাণ্ড করে বসল। ওই বাড়ির ছেলেটাকে অপহরণ করে নিয়ে গেল। গোটা বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। অজিত উঠিয়ে নিয়ে গেছে, সিপিএম বাড়ির ছেলেকে। মানে ও-ছেলে আর ফিরবে না। কপাল চাপড়াচ্ছে বাড়ির লোক। এমন সময় শোকাহত ওই বাড়িতে হাজির হলো কানা অজিতের ইনফরমার। বলল, "পোলারে ফিরা পাইতে চান? একটা শর্ত আসে!"

- আমাগো পোলারে ফিরাইয়া দাও , বাড়ি-ঘর সব নিয়া নাও, যা আসে!

- বাড়ি-ঘর না, অন্য কিছু চাই

- কী?

- আপনার মাইয়ার লগে কানা অজিতের বিয়া দিতে লাগব!

শর্ত শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল বাপ-মা। পরস্পরের দিকে তাকাল। ছেলে ফিরে পেতে আর কোনও উপায় নেই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন তারা। পরমা সুন্দরী কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মস্তান কানা অজিতের। বাড়ির ছেলেও ফিরে এল ঘরে।

এই মস্তানদের (তা সে যে দলেরই অনুমোদিত হন না কেন) সুন্দরী বউরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা। এই ব্যাপারটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়। পাড়ার ফুটো মস্তানও এ ব্যাপারে বিশেষ হাতযশ দেখিয়েছে। যাইহোক, কানার কীর্তি মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। কংগ্রেস জমানাজুড়ে কানা অজিত যেন উড়ন তুবড়ির মতো ফেটে পড়ল দক্ষিণ কলকাতায়। বিরাট প্রতাপ। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর 'মানু দা'। আর কী লাগে! অন্যদিকে, সিপিআইএম ততদিনে পাড়া-ছাড়া। এলাকার পর এলাকা শাসন করছে অজিত আর অজিতের গ্যাং।

সেই সময় হোক বা এই সময়, বহু মস্তান তাদের সামাজিক পরিসরে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে 'মসিহা', 'রবিন হুড' বলেও পরিচিতি ছিল চেনা বৃত্তে। যে কোনও কারণেই হোক, কানা অজিতকে মানুষ ভয় পেত, ত্রস্ত হতো কিন্তু তেমন পছন্দ করত না, ভালোবাসা তো দূর। ব্যক্তি জীবনেও জোর করে অজিত অনেক কিছু পেতে চেয়েছে, পেয়েই ছেড়েছে কিন্তু সমীহ-সম্মান-ভালোবাসা যে জোর করে পাওয়া যায় না সে কথা জীবন তাকে হাড়েহাড়ে বুঝিয়েছে।

১৯৭৩ সালে জরুরি অবস্থা জারি হয়ে গেল। নকশাল অধ্যায় পেরিয়ে এখন সরাসরি কংগ্রেস-সিপিআইএম সংঘাত কলোনিতে। এরমধ্যে টালিগঞ্জে একটা ট্রেন্ড দেখা দিল। সিপিএমএর সশস্ত্র আক্রমণে কোণঠাসা বহু নকশাল কর্মী কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে লড়াই করত। কানা অজিতের মস্তান জীবনের প্রথম পর্বে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিআইএম-এর পল্টু ভট্টাচার্য। এরপর অজিতকে বড়সড় চ্যালেঞ্জ জানাল কামারপাড়ার খোকা দাস, সে এক দুর্দান্ত বাহুবলী, কমরেড বাহুবলী। মজার কথা, টালিগঞ্জ এলাকার নকশাল স্কোয়াড কমান্ডার পণ্ডিত দাসের সঙ্গে কংগ্রেস বাহুবলী নিখিল বসু রায়দের সুসম্পর্ক বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ থাকলেও অজিতকে তেমন পছন্দ করতেন না পণ্ডিত দাস। বরং পণ্ডিতের অনুগামী ছেলেদের হাতে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছে অজিত গ্যাং। কানা অজিত নিজেও বহুবার ধাওয়া খেয়েছে। এই একটা সমস্যা কানা অজিতকে নিয়ে ছিলই। ছোটখাট যে কোনও মারপিটে জড়িয়ে পড়ত অজিত, পরিণত বয়সেও। তবে তার ভাই নির্মল ছিল এক অতি ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়। পিস্তলের হাতটাও ছিল চমৎকার! অব্যর্থ নিশানা। নির্মলের এই ঠান্ডা মাথার ঝটিকা আক্রমণ ভয় পেত সিপিএম-এর অ্যাকশন স্কোয়াড।

মায়া রায়

যাইহোক, জীবন এগোচ্ছিল অজিতের। কংগ্রেসের সূত্রে সরকারি কন্ট্রাক্টর হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেছিল অজিত। তবে নিজের নয়, লাইসেন্স ছিল স্ত্রীর নামে। এবার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বলি।

সরকারি কাজ পেতে, টাকা আদায় করতে যা যা নিয়ম সেই নিয়ম মেনে কাগজপত্র জমা করত অজিতের স্ত্রী। এরপর শেষ বেলায় মাঠে নামত অজিত। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে বসে ফাইনাল ডিল ওই করত। সে এক কিসসা। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারকে তো আর পাড়ার মস্তানদের মতো হুমকি দেওয়া যায় না। তাই এক অভিনব পন্থা নিয়েছিল অজিত। ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে প্রথমে 'স্যার-স্যার' বলে হাসিমুখে কথা শুরু করত অজিত। তারপরই সরকারি আধিকারিক বেগড়বাঁই করলে চোখ থেকে চশমা নামিয়ে নিত অজিত। ওর এক চোখ তো কানা। সেই চোখে একটা পাথরের নকল চোখ বসানো থাকত। অজিত 'হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার' করে ঘাড় নাড়তে নাড়তেই পাথরের চোখটা অক্ষিকোটর থেকে বার করে ফেলত। পুরো হাঁ-মুখ অক্ষিকোটর! বীভৎস দৃশ্য। আর পাথরের চোখটা নিয়ে হাতে নাড়াচাড়া করছে অজিত। এই দৃশ্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ে কম্পমান হয়ে উঠতেন শিক্ষিত ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। নিজের চোখ হাত দিয়ে ঢেকে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বলে উঠতেন, "অজিতবাবু আপনি চলে যান, আমি আজই ফাইল ছেড়ে দিচ্ছি। " অজিতও অম্লানবদনে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিত সরকারি দফতর থেকে।

আরও পড়ুন-ভিড়, ভক্ত, ফাংশান, উন্মাদনা! উত্তমকুমারকে যেভাবে আগলে রাখতেন এই মস্তানরা

এই ঘটনাগুলো ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও চালিয়ে গেছে কানা অজিত। ঠিকাদারি করে লাখপতি হয়েছিল অজিত দাস। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছিল। দুই ছেলেকে রাজ্যের বাইরে রেখে পড়াচ্ছিলেন অজিত। ছেলে-মেয়েরা পড়ুক, মানুষ হোক এমনটাই চাইতেন অজিত, নির্মলরা। আর এ ব্যাপারে ওদের ভরসার জায়গা ছিল সেই বড়দা, সেই মাস্টারমশাই। তাঁর কাছেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য পরামর্শ নিত ওরা। ওদের জীবন যেন বাচ্চারা না পায়, এমনই উপলব্ধি ছিল ওদের । যাইহোক, ভালোই অর্থ উপার্জন করতে পেরেছিল অজিত। ব্যবসা চলছিল স্ত্রীর নামে। নিজের নামে এলাকা শাসন করে সফল হলেও বউয়ের নামে ব্যবসা করে দাম দিতে হলো অজিতকে। ঘরের মাঠে কখন যে শোচনীয় পরাজয়ের প্লট সাজানো হচ্ছিল, টের পায়নি অজিত। চরম অপছন্দের বিয়ে মনে-মনে বোধহয় মেনে নিতে পারেননি অজিতের স্ত্রী। তাই ব্যবসার সব টাকা কুক্ষিগত করছিলেন। লাইসেন্স তো আগে থেকেই তার নামেই ছিল, এবার জমা টাকাও সরিয়ে দিলেন।

বাঘাযতীন বাজার লাগোয়া অঞ্চল

এবার ছিল চরম বার্তা দেওয়ার পালা। দুই ছেলে সঙ্গে নিয়েই একদিন কানা অজিতকে ছেড়ে গেল ওর স্ত্রী। পরবর্তীকালে বিয়েও করল অন্যত্র। ঘরের মাঠে এত বড় গোল খাবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি অজিত। ব্যবসা, সংসার এক লহমায় সব শেষ। সঞ্চয়ের টাকা পর্যন্ত নিয়ে গেছে স্ত্রী, দুই ছেলেও। ওদিকে জমানাও বদলে গেছে। এই প্রথম নিজেকে মনে হলো, কেউ যেন গভীর এক শূন্যতায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মদ খাওয়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিল অজিত। বাঘাযতীন মিলিটারি রোড, যে রাস্তা জুড়ে তার জীবনের স্মৃতি লেগে আছে সেই রাস্তায় ঠেলার উপর কচুরির দোকান দিল কানা অজিত, প্রতিদিনের খরচটুকু তুলতে।

টাকার জন্য তো কোনওদিন ভাবেনি আলাদা করে, এবার ভাবতে হলো। কচুরির দোকানে বসে কানা অজিত ভাবে, তার কোনও ঋণ কি থেকে গেল কারও কাছে? অজিতের মনে পড়ল, বছরখানেক আগে, স্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা যখন তুঙ্গে, সব টাকা যখন আটকে দিয়েছে বউ, তখন বড়দার কাছে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছিল সে। বছর ঘুরে গেছে। বড়দাও চায়নি, সেও ফেরায়নি। মনে মনে ভাবল, বড়দার কাছে একদিন যাবে।

পরদিন বিকেলে মিলিটারি রোডের এক চায়ের দোকানে বড়দাকে পেয়ে গেল অজিত।

- বড়দা, আপনে আমার কাছে ৫০০ টাকা পান।

- কীসের ৫০০ টাকা? কবে দিসিলাম মনে নাই তো!

- না, দিসিলেন। আপনের মনে নাই...

- তয় কী করুম ক, আমার তো মনেই পড়ে না!

- কইতাছি টাকাটা আপনে ছাইড়া দেন।

- আমার মনেই পড়ে না, আবার ছাড়ব ক্যান?

- হ্যাঁ, আপনে ছাইড়া দেন! আমি ফিরাইতে পারুম না। অনেক চেষ্টা করসি। পারুম না।

- পারতে অইবো না! এখন চা খা। স্নেহের কানাকে আশ্বস্ত করে বড়দা।

এর পরের দিন, সকাল ন়'টা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড়দা। হঠাৎই পাড়ার একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে এল।

- দাদা, (ছেলেটা হাঁপাচ্ছে)

- কী রে কী হইসে? বড়দা জিজ্ঞাসা করলেন

- দাদা... কানা...

- কানা? কানার কী হইসে?

- দাদা, কানা অজিত নাই দাদা, কানা অজিত সুইসাইড করসে।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন বড়দা। বাকরুদ্ধ। গতকালই তো এত কথা হলো। অজিত! ভাবতে পারছেন না তিনি। ভাবতে পারছিল না বাঘাযতীন, বিদ্যাসাগরের আমজনতাও। কানা অজিত নেই। কানা অজিত চিরদিনের জন্য পালিয়ে গেছে।

সেদিন সকালবেলা ঘর থেকে কোনও সাড়া-শব্দ না পাওয়ায় দরজা ভাঙা হলো। ততক্ষণে সব শেষ। যারা ঘরে ঢুকতে পেরেছিলেন, তারা দেখলেন দশ লিটার ফলিডলের বোতল অর্ধেক ফাঁকা। ঘরের কোণায় একটা ফাঁকা মদের বোতল। তড়িৎ গতিতে খবর ছড়িয়ে গেল গোটা দক্ষিণ কলকাতায়। কানা অজিত নেই। সেদিন কংগ্রেসের কর্মীরা দলের পতাকা নিয়েই কানা অজিতের শেষ যাত্রায় সামিল হয়েছিলেন। বাঘাযতীন মোড় লোকে লোকারণ্য। মিছিল বাঁদিক নিল, বাঘাযতীন বাজার পেরোচ্ছে মিছিল। এই সেই বাজার সংলগ্ন অঞ্চল বাড়িঘর, যারা জানে অজিতের জীবনের অনেক না-জানা কথা। ধীর গতিতে চলেছে শেষ যাত্রা। ডানদিকের বাড়িটা থেকে কে যেন একবার উঁকি দিল, তারপর জানলা বন্ধ করে দিল।

জীবনের পুতুলখেলা ফেলে রেখে কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে ছুটে চলল কানা অজিতের নিথর শরীর।

More Articles