ভাঙল ভাষার শিকল, এশিয়াটিক সোসাইটির হাত ধরে নয়া উড়ান বাঙালির প্রিয় ‘চণ্ডীমঙ্গলে’র
Chandimangal Translation By France Bhattacharya: ২০২৪ সালে পুজোর ঠিক আগে আগে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশ পেয়েছে চণ্ডীমঙ্গলের সামগ্রিক ইংরেজি অনুবাদ।
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মুকুন্দ চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্য বহুদিন যাবৎ বাংলাভাষী ও অ-বাংলাভাষী পাঠক-গবেষকদের নিবিড় ও সোৎসাহ চর্চার বিষয়। কবি গোবিন্দচন্দ্র দত্তের কাছ থেকে এ কাব্যের মাধুর্যের কথা শুনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড বাইলস কাওয়েল (Edward Byles Cowell), বেশ কিছুটা অংশ অনুবাদও করেছিলেন। ১৯০২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে সেই অনুবাদকর্ম ‘থ্রি এপিসোডস ফ্রম দ্য ওল্ড বেঙ্গলি পোয়েম চণ্ডী’ (Three Episodes from the Old Bengali Poem Caņḍī) নামে প্রকাশিত হয়। এরপর পেঙ্গুইন থেকে এডওয়ার্ড ইয়াজিজিয়ান (Edward Yazijian) অনূদিত ও সম্পাদিত ‘Chandimangal’ (চণ্ডীমঙ্গল) শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশ পায় ২০১৫ সালে। অবশেষে এই বছরে, ২০২৪ সালে পুজোর ঠিক আগে আগে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশ পেয়েছে চণ্ডীমঙ্গলের সামগ্রিক ইংরেজি অনুবাদ।
অনুবাদটি করেছেন ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, যিনি এর আগে অন্নদামঙ্গলের তিনটি খণ্ডের সামগ্রিক অনুবাদকর্মটি দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেছেন। ১৯৮৬ সালে সাহিত্য আকাদেমি থেকে প্রকাশিত সুকুমার সেন সম্পাদিত প্রামাণ্য সংস্করণটি এই অনুবাদে মূল পাঠ হিসাবে ব্যবহার করেছেন অনুবাদক। ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ উপন্যাসের সূত্রে আনন্দ পুরস্কার-প্রাপ্ত সুলেখক ও সু-গবেষক রামকুমার মুখোপাধ্যায় এই গ্রন্থের আরম্ভে বাঙালি ও অবাঙালি-মহলে চণ্ডীমঙ্গল চর্চা বিষয়ে একটি মনোজ্ঞ ও তথ্যবহুল ভূমিকা রচনা করেছেন।
আরও পড়ুন: শেষদিন পর্যন্ত সঙ্গে ছিল শ্রীচৈতন্যের প্রিয় সখাদল
দেবতার মানবায়িত স্বভাব, যা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা স্বচ্ছন্দ ও সরসভাবে প্রকাশিত হয়েছে শ্রীমতী ভট্টাচার্যের অনুবাদে। যেমন, ‘দ্বিতীয় দিবস/দিবা/৪৩’ অংশে নামচরিত্র চণ্ডীর সংসারযন্ত্রণা-দগ্ধ খেদোক্তি—
মূল:
কি জানি তপের ফলে হর মেল্যাছে বর
সই সাঙ্গাতিন নাঞি আইসে দেখিআ দিগম্বর।
বাপের সাপ পোএর মউর সদাই করে কলি
গণার মূষা ঝুলি কাটে আমি খাই গালি।
বাগ বলদে সদাই দ্বন্দ্ব নিবারিব কত
অভাগী গৌরীর কপালে দারুণ দৈবে হত।
অনুবাদ:
What do I know, as a result of what asceticism, I got Hara for a husband,
My companions do not come here at the sight of this naked man.
The father's snakes and the son's peacock quarrel incessantly,
Gaņā's rat makes holes in the sack and I am the one scolded.
How many constant quarrels between the tiger and the bull will I put an end to?
On the forehead of the unfortunate Gauri, what a terrible fate was written.
সামগ্রিকভাবে এই অনুবাদ সুন্দর ও সুস্পষ্ট। তবে বাংলা ভাষাভাষী সমাজের কাছেই এই কাব্যের বহু অংশ দুর্বোধ্য। তাই চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চণ্ডীমঙ্গল বোধিনী’ গ্রন্থে এ গ্রন্থের বিস্তারিত টীকাটিপ্পনী রচনা করেছেন। আমরা প্রত্যাশা রাখছি, অনুবাদকর্মটির পরবর্তী সংস্করণেও উপযুক্ত সম্পাদনার মাধ্যমে গ্রন্থটিকে সুবোধ্য করে তোলার জন্য যথেষ্ট টীকাটিপ্পনী যুক্ত করা হবে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
কাব্যের বহু স্থানেই কবি বলা-কওয়া ছাড়াই নিজস্ব কথন থামিয়ে চরিত্রবিশেষের সংলাপ আরম্ভ করেছেন, এক্ষেত্রে পাদটীকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অমুক চরিত্রের সংলাপ আরম্ভ হল। যেমন, ‘প্রথম দিবস/নিশা/২৮’ অংশের আরম্ভে—
মূল:
তনু তোর যেন কাঁচা নুনি
রৌদ্রে মিলায় হেন জানি।
স্বভাবে তুমি সে কমলিনী
হিমপ্রাতে হারাবে পরানি।
তপেরে না যাই আগো উমা
গলায় বাঁধিয়া থাকি তোমা।
অনুবাদ:
Your body is like fresh cream
Which is mixed with the sun's rays.
Your nature is like young lotuses,
That would lose their life in a cold winter morning.
Uma, don't go mortifying yourself, my dear,
I am still attached to your neck.
— এখানে অবশ্যই পাদটীকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এটি উমার তপশ্চর্যার সঙ্কল্প শুনে সন্ত্রস্ত মা মেনকার উক্তি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেওয়া যাক ‘অষ্টম দিবস/দিবা/৫৩২’ অংশে, কাব্যের একেবারে অন্ত্যভাগ থেকে—
মূল:
শকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতা
কতদিনে দিলা গীত হরের বনিতা।
অভয়ামঙ্গল গীত গাইল মুকুন্দ
আসোর সহিত মাতা হইবে সানন্দ।
অনুবাদ:
A śaka rasa rasa Veda śaśāńka gaņitā, Counting in era śaka six rasas, four Vedas, the moon,
For how many days Hara's wife sang.
Mukunda sang the song of the Abhayāmangala.
The Mother will be happy with the assembly.
এখানে লক্ষণীয় এই যে, মূলে এই চরণ চারটি ছিল তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে, অনুবাদে সেই তৃতীয় বন্ধনী বর্জিত হয়েছে। মূলে অন্ত্যটীকায় সম্পাদক সুকুমার সেন এই তৃতীয় বন্ধনীর ব্যাখ্যা হিসাবে এই অংশটুকুর বিশেষ সূত্র নির্দেশ এবং পাঠান্তর উল্লেখ করেছেন। অনুবাদে তা বর্জিত৷ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি এখানে পাদটীকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো “A śaka rasa rasa Veda śaśāńka gaņitā” চরণটির স্পষ্টতর ব্যাখ্যা। অঙ্কস্য বামাগতি সূত্রানুসারে, এই সঙ্কেত যে ১৪৬৬ শকাব্দের দিকে ইঙ্গিত করছে, এ কথা বলে না দিলে পাঠক-সাধারণের পক্ষে তা বোঝা দুঃসাধ্য।
আরও পড়ুন:রামায়ণ, মহাভারত থেকে মঙ্গলকাব্য… যেভাবে বদলে গেল বাঙালির পিঠেপুলির স্বাদ
অদূর ভবিষ্যতে এই সুলিখিত অনুবাদকর্মটির একটি সটীক ও সুসম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ পাবে, এমনই আশা পাঠকের। তবে চণ্ডীমঙ্গল অনুবাদের এই দুঃসাধ্য ব্রতপূর্তির জন্য বিদুষী ফ্রাঁস ভট্টাচার্য মহোদয়াকে বিশেষ অভিনন্দন এবং প্রণতি না জানালেই নয়।