সাহিত্যের পীঠস্থান: বইপাড়ার এক নিভৃত আত্মকথন

Boipora Boipara Book Review: 'লেটার প্রেস' থেকে আজকের 'প্রিন্ট অন ডিমান্ড' সিস্টেমে বই ছাপার যে পদ্ধতি তা কিন্তু বর্তমান প্রকাশনা ও বইয়ের বাজারে বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে।

বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান ও পীঠস্থান কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। সারা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় বইবাজার বলতে এই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়াকেই বোঝায়। এই বইটি যখন পড়া শুরু করি তখন ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় বইটি যেন আমাদেরই কথা বলে। আমরা কারা? এখানে 'আমাদের' বলতে তাঁদের কথাই বলছি, যারা সাধারণত বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। আসলে বই প্রকাশ মানে শুধু তো প্রকাশ নয়। বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থেকে এটুকু খুব সহজেই বুঝতে পেরেছি, বই প্রকাশ সেই সময়ের সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সমাজ বিবর্তনের বা সমাজ আন্দোলনের এক মুখপত্র। প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত অরুণ সেনের এই বইটি এক কথায় সামগ্রিক বইপাড়ার এক আত্মকথন। এই বইতে লেখক তাঁর বই পড়া সম্পর্কিত নানা চিন্তা ভাবনা, তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তারই সঙ্গে এই বইপাড়ার গায়ে লেগে থাকা ইতিহাসের কথা আমাদের শোনান।

"বিব্লিওফিল্' শব্দটির অর্থ দেওয়া আছে অভিধানে: পুস্তকপ্রেমিক বা সংগ্রাহক, কিন্তু তা মূলত পুস্তকের বাইরের চেহারার জন্য। যাকে বলে ফরম্যাট। বিব্লিওম্যানিয়াক্ আরও এক কাঠি উপরে! বই ভালোবাসেন অর্জিত সম্পত্তি হিসেবে। আমাদের ভাষায়, গ্রন্থকীট বা বইয়ের পোকা যতই ঠাট্টার পাত্র হন (সবসময় তা-ও নয়), তাঁরা বইয়ের ভেতরেই ঢোকেন।"

এই লেখাটি দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটির পুস্তানি। বইটি যখন হাতে পেয়েছি তখনই বইটির ভেতরে নানা কথা এবং স্মৃতি বারবার যেন বইপাড়ার অলিতে গলিতে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে, বইপাড়া দেখার জন্য। সারা বাংলার একমাত্র বইয়ের শ্রেষ্ঠ বিরাট বাজারই হল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। যুগের পর যুগ বাংলা সাহিত্যকে স্বমহিমায় বিখ্যাত করে তুলেছে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দিকপাল থেকে আজকের টিন-এজার থেকে দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে আসা কত মানুষের পদধূলিতে সুসজ্জিত এই কলেজ স্ট্রিট। বই পড়া, বই বাছা, বই কেনা সবই বইপাড়ার অনন্য সম্পদ। এমন কোনও বই হয়তো নেই যা বইপাড়ায় পাওয়া যাবে না।

এই বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯৩ সালে এবং তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের এপ্রিল মাসে। প্রায় ১৭টি নাতি দীর্ঘ প্রবন্ধ নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। প্রতিটি লেখাই পাঠককে আগ্রহী করেছে। বইপড়া বইপাড়া, বই পড়ার আগে পরে, সমালোচকের দৌড়, বই যখন অপসংস্কৃতি, অনন্য কলেজস্ট্রিট, উড়াইয়া দেখো ছাই, ছাপাখানার ভূত, মার্ক টোয়েনের শিষ্যদের হাত থেকে বাঁচিয়ে, বই কখন অস্ত্র — প্রভৃতি লেখাগুলির মধ্যে লেখকের স্বতন্ত্র ভাবনা এবং প্রকৃত মূল্যায়নের একটা দিক খুব সহজে ধরা পড়ে। একদিকে যেমন তিনি বই পড়ার ইতিহাসের সঙ্গে আজকের বইপাড়ার মিল খুঁজে পাচ্ছেন, তেমনই বিবিধ অমিল এবং পরিবর্তনের দৃশ্যও তিনি তুলছেন তাঁর লেখায়। লেখক মুখবন্ধে যে কথাটি বলেছেন, পাঠকের জন্য সে কথাটি এখানে তুলে আনলাম।

"প্রতিক্ষণ-এর প্রথম বছরে, ১৯৮৩-র জুলাই থেকে ৮৪-র জুন পর্যন্ত, ধারাবাহিক লেখাগুলো বেরোয়। বইপত্র এবং সেই সূত্রে শিল্পসাহিত্য ও সমাজসংস্কৃতির নানা কথাই এখানে উঠে এসেছে টুকরো-টুকরো এবং এলোমেলোভাবে। সমকালীন ঘটনা ও তর্কবিতর্কের ছোঁয়াও আছে অনেক জায়গায়। আমি তা মুছে দিতে চাইনি, কিছু সংশোধন ও পরিবর্ধন করেছি মাত্র। দু-একটি বিষয় নতুন করে লিখে জুড়েও দিয়েছি প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণতা পাবে আশা করে। কয়েকটি বিষয় বাদও দিয়েছি স্থান সংকুলানের জন্য। প্রতিক্ষণ-এর জন্য এই লেখাগুলোর প্রস্তাবক ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী এবং 'বইপড়া বইপাড়া' নামটিও তাঁরই দেওয়া। সেই সহকর্মী প্রয়াত বন্ধুকেই বইটি উপহার দিলাম প্রতিক্ষণ-এর দপ্তরে একদা অনেকে মিলে সুখেদুঃখে অবিস্মরণীয় বহু মুহূর্ত কাটানোর স্মৃতিতে।"

আরও পড়ুন- মেঘে মেঘে তারায় তারায়: ধ্রুপদী পথে হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুপদহীন বাঁক

বইটির প্রথম প্রবন্ধ 'বইপড়া বইপাড়া'। এই আলোচনায় লেখক পূর্ববর্তী লেখকদের নানা তত্ত্ব ও আলোচনাকে কেন্দ্র করে লেখা ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গ সূত্রেই এসেছে বাঙালির পুরনো কালের বই পড়ার অভ্যাস থেকে নিজস্ব বাড়িতে তৈরি হওয়া লাইব্রেরি। এবং এই আলোচনাতেই এসেছেন প্রমথ চৌধুরী, চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, আবার প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকদের কথাও। বই পড়ার যে সাধারণ প্রবৃত্তি এবং মনোভাব এবং তারই সঙ্গে বইকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের নিজস্ব পরিমণ্ডল গড়ে তোলার কাহিনি লেখক আমাদের বলেছেন। এই লেখা প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে স্বামী বিবেকানন্দের পড়ার একরকম স্টাইল। তিনি নাকি খুব দ্রুত পড়তে পারতেন। অর্থাৎ একটি বই হাতে পেলে তিনি সম্পূর্ণভাবে সেই বইয়ের পাতাতে নিজেকে মনোনিবেশ করতে পারতেন। আলোচনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে লেখকের অগ্রজ বিষ্ণু দের কাছ থেকে শোনা নানা গল্প। আরও এক অগ্রজ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন লেখক। এই প্রবন্ধে তিনি একটি শব্দ প্রয়োগ করেছেন, তীর্থস্থান। বহু মানুষই বার্ধক্য পেরিয়ে তীর্থে যান পূণ্যলাভের জন্য। পাঠক বা বইপ্রেমী মানুষ বইয়ের তীর্থে অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিট বা বইপাড়া অঞ্চলে আসেন বইয়ের তথ্য ও তত্ত্ব উপভোগের জন্যই। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা করেছেন,

"কলকাতা শহরের বইপাড়া নিয়ে অনেকেরই গর্ব। সেখানে শুধু কলেজ স্ট্রিট-বইপাড়ার সাম্রাজ্যই নেই। আছে আরো ছোটো- ছোটো দ্বীপও অনেক। ওয়েলিংটন স্কয়্যারের কাছে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, ওয়েলেসলিতে, চিৎপুরে, রাসবিহারী বা গড়িয়াহাটায়- কোথাও বইয়ের ছোটো স্টল, কোথাও ফুটপাথে ছড়ানো বই, কোথাও দু-পাঁচটা দোকান। শহরতলি বা মফস্সল-শহরেও হয়তো একটি-দুটি দোকান নিয়েই বইপাড়া। বলাবাহুল্য, কলেজ স্ট্রিটের ধারেকাছে কেউ নয়, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু কম-বেশি প্রত্যেক জায়গাতেই দেখা যাবে ওই দায়বদ্ধ বই-পড়ুয়ারা কুঁজো হয়ে ঝুঁকে বই ঘাঁটছে, পাতাগুলো নাড়াচাড়া করছে, চোখের পলকে কিছু পড়েও ফেলছে, ফেরত দিচ্ছে বা কিনে নিচ্ছে। কিংবা নিছক হাঁটাহাঁটিই করছে কিছুক্ষণ। অন্তত কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় তো তা দেখা যায়ই।"

বইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা 'অনন্য কলেজ স্ট্রিট'। নামের মধ্যে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে কলেজস্ট্রিট বা বইপাড়া আর অন্যান্য দেশের বই বাজারের মতো ঠিক নয়। এই প্রসঙ্গেই তিনি একটি জায়গায় লিখছেন,

"বিদেশে, প্রধানত ইউরোপে, বইপাড়া আছে কিনা তার খোঁজও মহান লেখকদের লেখায় পাইনি। রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ- প্রবাসীর পত্র বা য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি-তে টার্কিশ-বাথ, নাচ-পার্টি, ছবির এক্সিবিশন, থিয়েটার সবকিছুর বর্ণনা আছে, নেই বই পাড়ার।"

আসলে, আমাদের কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়াই একমাত্র বইপাড়া সম্ভবত, পৃথিবীর কোথাও সেভাবে আর বইপাড়া নেই বললেই চলে। আসলে এই বইপাড়া শুধুমাত্র বইপ্রেমী মানুষ বা বই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের যোগাযোগ স্থাপনের বা কাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু নয়। বইপাড়াতেই ঘটেছে একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনা। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হাসনাত আবদুল হাই-এর জর্নাল ৮৯। এই বই সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 'চমৎকার একটি বই'। আরও একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, বইটির মধ্যে একটি রাস্তার বর্ণনা। "ব্ল্যাকওয়েল, থর্নটন, ডিলনস বুক শপ যেন এক একটা জীবন্ত হয়ে ওঠে লেখার গুণে। ওখানেই বডেলিয়ান লাইব্রেরী এবং সেলডনিয়ান থিয়েটার। তবু কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ার পাশে যে কিছুই নয় তা হাই-এর মুগ্ধতা সত্বেও টের পেতে দেরি হয় না।"

এই আলোচনাতেই তিনি আরও একবার ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একটি স্মৃতিচারণার উল্লেখ করেছেন,

“ছেলেবেলা থেকে বই কিনে আসছি আর পড়ছি। প্রায় স্কুল থেকেই আরম্ভ হলো। শিয়ালদা স্টেশনে ছ'আনার জিনিস আট আনায় জর্জ এলিয়টের Adam Bede কিনলাম। তারপর মেকলের ইতিহাস, এখনও আছে। কলেজে সেন ব্রাদার্স, প্রথম খোলে কলেজ স্ট্রীট আর বৌবাজারের কোণে, তারপর প্রেসিডেন্সী কলেজের সামনে উঠে এল। বিদেশী সাহিত্য আর ইতিহাস, কিনেই পড়তাম। ভোলা সেনের মৃত্যুর পর সে দোকানে আর ঢুকিনি। তারপর থেকে বুক কোম্পানি। কত ধরনের বই-ই না কিনেছি। প্রফুল্ল ঘোষ, সতীশ বাগচি প্রভৃতি দু-এক জনের কথা বাদ দিচ্ছি, কিন্তু তাঁদের বাদ দিলে আমাদের বন্ধুরাই সবচেয়ে বেশি বই কিনতেন।”

সমসাময়িক বই তৈরির ক্ষেত্রে বইপাড়ায় যে উন্নত প্রযুক্তি বা উন্নত মানের বই তৈরির পরিকাঠামো দেখা যায়, আজ থেকে বেশ কয়েকশো বছর আগে তা হওয়া সম্ভবই ছিল না। 'লেটার প্রেস' থেকে আজকের 'প্রিন্ট অন ডিমান্ড' সিস্টেমে বই ছাপার পদ্ধতি বর্তমান প্রকাশনা ও বইয়ের বাজারে বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে। এই প্রবন্ধের আলোচনাতেই তিনি তাঁর ছাত্র বয়সের বিখ্যাত কিছু অগ্রজদের স্মৃতিকে টেনে এনেছেন। নির্মল কুমার বসু, নীহাররঞ্জন রায়, বিনয় ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে।

বইটির আরও একটি প্রবন্ধ ' উড়াইয়া দেখ ছাই'-এ মূলত তিনি কিছু মূল্যবান প্রাপ্তির কথা বলেছেন। তিনি লিখছেন,

"আরেকটা বই পেয়েছিলাম সোনারঙ্গ। ঢাকা জেলার একটি গ্রামের ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ সবকিছু। এরকম অঞ্চলের ইতিহাস বা গ্রামের ইতিহাসের খোঁজে প্রায়ই যাওয়া হত ইন্দ্রবাবুর কাছে। কিন্তু সোনারঙ্গ-র জোড়া পাইনি। সে বইতে গ্রামের প্রতিষ্ঠা, পূজাপার্বণ, শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি ইত্যাদির কথা তো আছেই। গ্রামে ক-জন ভিখারি, ক-জন নাপিত, ক-জন ধোপা, ক-জন কুমোর, কী তাদের নামধাম, গ্রামের কী কী বড়ো গাছ, কোন কোন ফুল ফোটে, কোন গাছের তলায় কোন আড্ডা-কিছুই বাদ নেই।"

এই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন কলেজ স্ট্রিটের বহু আলোচিত ও প্রচারিত পুরনো বইয়ের দোকানের কথা, যা মূলত প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিং বরাবর আজও সগৌরবে ও সসম্মানে বসে। যদিও খুব সম্প্রতি এই পুরনো বইয়ের দোকানগুলিকে নতুনভাবে গড়ে দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এখানে যারা বই বিক্রি করেন এক এক সময় লেখক এবং পাঠকের থেকেও তারা অনেক বেশি বইয়ের রেফারেন্স জানেন। এর কারণ মূলত বংশ-পরম্পরায় বই বিক্রি করার প্রবণতা বা ব্যবসায়িক ধারা। যার ফলেই একজন পুরনো বই বিক্রেতা অনায়াসেই একটি বিষয়ের অন্তত পনেরোটি বই হাতের সামনে তুলে দিতে পারেন। এরই সঙ্গে তিনি প্রায় স্বীকারই করেছেন, এই প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিং লাগোয়া পুরনো বইগুলির দোকানে পাওয়া যায় না এমন বই হতেই পারে না। বরং এমন অনেক ' আউট অফ প্রিন্ট ' বইয়ের রতন হাতে চলে আসতেই পারে।

আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশনা জগতের খুব চলতি শব্দ, 'ছাপাখানার ভূত'। এ প্রসঙ্গে মূলত তিনি একটি বই প্রকাশনার ভুলভ্রান্তি বিষয়গুলি নিয়েই আলোচনা করেছেন। কম্পোজিটর থেকে ছাপাখানার কর্মীর কথা তুলে ধরেছেন। দারুণ এক সত্যের কথা তিনি লিখছেন, "বাংলা বই বা পত্রপত্রিকায় ভুলের আধিপত্য এতটাই যে, বাংলা ভাষায় কোনও লেখা নির্ভুল ছাপা হবে, এই প্রত্যাশা করাটাই প্রায়ই বাড়াবাড়ি।" নির্ভুল ছাপার বই হাতে পাবেন, এই ঘটনা যেন হতেই পারে না। একটি বই শুধুমাত্র একজন কর্মীর মাধ্যমে তৈরি হয় না। একটি বইয়ের নির্মাণ নির্ভর করে ন্যূনতম ছয় থেকে সাত হাতের উপর। ছয় থেকে সাত হাত ঘুরে একটি বই লেখক বা পাঠকের হাতে আসে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিভাগের কাজ পর্যাপ্ত নির্ভুল হওয়া না পর্যন্ত সর্তকতা থেকেই যায়। এ প্রসঙ্গে অপ্রিয় একটি সত্যি বলেছেন তিনি। তিনি বলছেন, একটি পাণ্ডুলিপি ভুল হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন কম্পোজিটরের বা প্রকাশনার ত্রুটি থেকে যায় ঠিক তেমনই পাণ্ডুলিপি নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকের অনেকটা দায় বর্তায়। একজন লেখকের পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত যত্নশীল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি লিখছেন ,

"কারো-কারো পাণ্ডুলিপি এত নোংরা, তার অক্ষরগুলো এত খুদে যে মনে হয় কম্পোজিটরকে পীড়ন করার মর্ষকামী সুখ পাওয়া ছাড়া এর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। অথচ ছাপার ভুল হলে প্রায়শই ভাবটা এমন দেখানো হয়, যেন ওটা প্রেসের হরফ সাজানো বা ছাপাছাপিরই গোলমাল। প্রুফ রিডারের অমনোযোগ। লেখক তার ফাঁকে বেরিয়ে আসতে চান।"

এই ভুল ও অসঙ্গতি নিয়েই তিনি কখনও সময় সুভাষ ভট্টাচার্য, অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের বানান সম্পর্কিত আলোচনাও করেছেন। এ প্রসঙ্গেই নিজের একটু ব্যক্তিগত মতামত রাখি। যখন একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশনা সংস্থায় বই হয়ে প্রকাশের জন্য আসে তখন থেকে বই প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় দায় বর্তায় সেই প্রকাশনার উপর। সাধারণত যে কোনও প্রকাশনা সংস্থায় একজন কম্পোজিটার, একজন প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফ রিডার সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত থাকেন। বর্তমানে এই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা অনেকেই দিশা পাচ্ছেন না এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছাপানো পত্রিকা বা বই অপেক্ষা ডিজিটালের দিকে বিরাট এক শ্রেণির পাঠকের অভিমুখ বদলে যাওয়ায় এই শিল্পের ভবিষ্যৎ বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে! বর্তমানে দেখা যায়, কোনও প্রকাশনা সংস্থা তার নিজস্ব একজন প্রুফরিডার রাখতে অক্ষম। ফলত টিকে থাকার লড়াইয়ে, পেটের টানে, সংসারের তাগিদে একজন প্রুফরিডার অন্তত চার পাঁচটি প্রকাশনার সঙ্গে আংশিক বা মৌখিক চুক্তির সাপেক্ষে কাজে যুক্ত থাকছেন। ফলস্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই, দ্রুত প্রুফ দেখার প্রবণতা বা কাজ শেষ করার প্রবণতা বাড়ছে। নির্ভুল হবার সম্ভাবনা কমে আসছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, আগামী পাঁচ-দশ বছরে প্রকাশনা সংস্থায় প্রুফ রিডার বিভাগটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তখন সামগ্রিক নির্ভুল হবার প্রুফ বর্তাবে লেখকদের নিজের উপর।

এই বইয়ের আরও একটি বিষয় সমকালীন প্রকাশনা জগতের মূল স্তম্ভ, তা হল 'নিজের পয়সায়'। অর্থাৎ অগ্রজ কবিদের ভিড়ে বা দলে নবাগত কবিদের আগমন তারা নিজেদের মতো করে সুনিশ্চিত করতে নিজের আর্থিক উদ্যোগেই বিভিন্ন প্রকাশনার সঙ্গে বই প্রকাশে নিযুক্ত হয়েছেন। এর যেমন সুদিক রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে বিপদ। সুদিকের কথা বলতে গেলে, এমন কিছু অনন্য লেখক রয়েছেন যাদের চিন্তা এবং কাজ প্রকাশনা জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। বিপদ বলতে, এই সমৃদ্ধি পাওয়ার আশায় যারা আজকের সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর সাহিত্যচর্চায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং যাদের সাহিত্যচর্চার কোনও যোগসূত্র বা আগ্রহ নেই, সমকালীন সাহিত্যের প্রতি একাগ্রতার প্রশ্ন বা চিন্তাও নেই, সেখানে খুব সহজেই সাফল্যের শিখরে ওঠার যে প্রয়াস এবং বাংলাবাজারে প্রায় হাজারের বেশি প্রকাশনায় যুক্ত প্রকাশকদের সঙ্গে মৌখিক বা আর্থিক চুক্তি, প্রকৃত বইকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন- উই দ্য পিপল: পাতা উল্টে ভারত ভ্রমণ করায় যে বই

তিনি এই প্রবন্ধে একটি জায়গায় লিখছেন, স্মৃতি উদ্ভাসিত করে মনে পড়ে, তিনের দশকে বাংলা কবিতায় যাঁরা নতুন পথ তৈরি করেছিলেন, তাঁদের আত্মকথনে বা নানা গল্পসূত্রে জানতে পারি, আত্মপ্রকাশের গরজ ছিল এতটাই তীব্র যে, এ নিয়ে কুণ্ঠিত হওয়ার সময়ই ছিল না তাঁদের। বুদ্ধদেব বসু তবু এঁদের মধ্যে প্রথম থেকেই প্রকাশক জুটিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেই জোটানোর ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক। তিনি লিখেছেন,

"যা বাকি রইল তা নিছক খাটুনি-শুধু লেখার নয় (তাতে আমি সর্বদা রাজি), উপরন্তু আবার নতুন এবং নতুনতর প্রকাশক-সন্ধান, আবার কখনো বা পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ধন্না, এক-এক দফায় পাঁচ টাকা বা দু-টাকা পর্যন্ত হাত পেতে নেয়া।”

অগত্যা এর চেয়ে সম্মানজনক নিজের-নিজের পয়সায় বই বের করা। “কয়েকদিন চলল বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, হিশেব-নিকেশ, প্রেসের সন্ধান, আর সেই সব সুখদায়ক জল্পনা-কল্পনা যা এসব উদ্যমের আসল মুনাফা। মূলধন বলতে কিছুই অবশ্য নেই আমাদের কিন্তু তার প্রয়োজনই বা কী? বই বেরবে লেখকদের নিজ-নিজ ব্যয়ে, বিক্রির চেষ্টা চলবে যৌথভাবে।” এই উদ্যমেরই ফসল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর আমরা, বুদ্ধদেব বসুর একটি কথা এবং বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস। উর্বশী ও আর্টেমিস ও চোরাবালি বেরিয়েছিল পিতৃদত্ত নিজের পকেট-খরচের পুঁজি থেকেই। সমর সেনের বাবু বৃত্তান্ত-তে খবর পেয়েছি, “প্রথম বই 'কয়েকটি কবিতা' বের করি ১৯৩৭-এ স্বর্ণপদক বেচে।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক-এর খরচ জুগিয়েছিলেন তাঁর কয়েক বন্ধু চাঁদা তুলে।" এবং পরবর্তীতে এই আলোচনায় তিনি বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নিজে পয়সায় বই প্রকাশের ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন।

সবশেষে বলা যায়, স্মৃতি ঘটনা এবং ইতিহাসের সমন্বয়ে লেখক আমাদের বইপাড়ার গল্প বলেছেন অবলীলাক্রমে। বইপাড়ার ভালো-মন্দ, ভূত ভবিষ্যৎ, মানবিকতা থেকে ব্যবসায়িক দিক, সবটাই এই বইয়ের প্রধান উপজীব্য। কখনও গল্প থেকে কাহিনি আবার কাহিনি ফাঁকতালে তিনি নিজে মাঝে মাঝে উপস্থিত হয়েছেন, আর আমাদের দেখিয়েছেন এই বিরাট মহীরূহর আড়াল-আবডাল। একাধারে স্মৃতি আর ব্যঞ্জনায় এই বই যেন বইপাড়ার অমূল্য সম্পদ।

 

বইপড়া বইপাড়া
অরুণ সেন
প্রকাশনা - প্রতিক্ষণ

মূল্য - ২০০.০০

More Articles