মোদির লক্ষ্যপূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন কাশ্মীরের নির্দল নেতারাই

Jammu and Kashmir Election 2024: এর রশিদের প্রচারের ফলে জম্মুর ২৪টি বিভাগে বিজেপির উল্লেখযোগ্য লাভ হবে।

বহু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই এর রশিদের অন্তর্বর্তী জামিনকে ভারতীয় গণতন্ত্রের বিজয় হিসাবে দেখেন। তবে, জম্মু ও কাশ্মীরের সাধারণ জনগণের কাছে বিষয়টা বিজয় নয়, বিভিন্ন উদ্বেগের কারণ। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের কাছে প্রতারণা শব্দটি নয়া আমদানি নয়। বারবার প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন এই মানুষরা। গণতন্ত্রের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে আর হরহামেশাই এই মানুষদের জীবনগুলো আমূল বদলে গিয়েছে।

আপাত রাজনৈতিক কারণে ২০১৯ সালে সমস্ত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিন্তু এর রশিদকে UAPA-এর অধীনে আটক করা হয়েছিল। কাশ্মীরিদের মৃত্যুকে ব্যবহার করে সম্পদ সংগ্রহের অভিযোগে তিহার জেলে বন্দি করা হয়েছিল তাঁকে। সম্প্রতি দিল্লির একটি আদালত তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, এর রশিদকে জামিন দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অনেক হিসেব কষে নেওয়া এক রাজনৈতিক পদক্ষেপই। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রচারে এর রশিদের অংশগ্রহণ নির্বাচনী গতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে উত্তর কাশ্মীরে যেখানে মোট ১৬টি বিধানসভা রয়েছে। এরই পাশাপাশি আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, এর রশিদের প্রচারের ফলে জম্মুর ২৪টি বিভাগে বিজেপির উল্লেখযোগ্য লাভ হবে। এই বিভাগগুলিতে একই দফাতে ভোট রয়েছে। ঠিক এখানেই প্রশ্নটা উঠছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে যার বিরুদ্ধে, তেমন ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয় কি? এই একই অভিযোগে এখনও বহু রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র জেলে বন্দি আছেন। জেলে মারাও গেছেন! অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার পর রশিদকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিজেপির অংশ হিসাবেই চিহ্নিত করেছে। তাঁর মুক্তিকে কাশ্মীরের জনগণের মতামতকে ঘেঁটে দেওয়ার কৌশলের অংশ হিসাবেই দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন- লাদাখকে দেওয়া কথা রাখেননি মোদি! রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাবে জম্মু-কাশ্মীর?

ইঞ্জিনিয়ার রশিদ

যাইহোক, এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে আরেকটু খতিয়ে দেখা দরকার। প্রথমত, বিজেপি জম্মু অঞ্চলে, বিশেষ করে উধমপুর, কাঠুয়া, সাম্বা এবং জম্মু জেলাগুলিতে নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। এই পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করার জন্য বিজেপির মেরুকরণ প্রয়োজন। এর রশিদ এবং তথাকথিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-রাই এই মুহূর্তে সেরা তুরুপের তাস হতে পারে বিজেপির। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার ফলে দেশের বাকি অংশেও বিজেপি এবং আরএসএস উপকৃত হবে।

এর রশিদের বক্তৃতা আবেগপ্রবণ। একজন ‘ইসলামিস্ট’ হিসাবেই আত্ম-পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তিনি। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়কে গোঁড়া ধার্মিক হিসাবে চিত্রিত করার ঝুঁকি রয়েছে। এটি বিজেপিকে জম্মু অঞ্চলের নির্বাচনের সাম্প্রদায়িককরণে সহায়তা করতে পারে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এই অঞ্চলে সুশাসন, উন্নয়নের অনেক বুলিই দিয়েছিল বিজেপি। সেসবের ব্যর্থতাকে ঢাকতে বিজেপির কাছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছাড়া পোক্ত অস্ত্র আর কী হতে পারে। জম্মুতে সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসবাদী হামলা বেড়েছে। এর মধ্যেই এর রশিদের গরুর মাংস বিতর্ক (২০১৫) এবং সন্ত্রাসের অভিযোগে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন (বিশেষভাবে নির্বাচনী প্রচারের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে) সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকারের লক্ষ্য ছিল এটাই। এর রশিদ এবং আরও যারা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ রয়েছেন তাদেরকে সামনে রেখে সমস্ত কাশ্মীরিদের ধর্মান্ধ এবং সন্ত্রাসবাদী হিসাবে চিত্রিত করার বিজেপির কৌশলের কার্যকরী হাতিয়ার এই সিদ্ধান্ত।

১৯৫০-এর দশকে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্স যখন জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের জমি, চাকরি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার চাহিদাগুলির জন্য কথা বলতে শুরু করে, ভারতীয় ইউনিয়নের ফেডারেল কাঠামোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমর্থন প্রকাশ করতে শুরু করেন, তখন তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকেই রাজনৈতিক নেতাদের প্রান্তিকতার সূচনা। বক্সী, সাদিক এবং অন্যান্যদের আরও ব্যক্তিরা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনকে নষ্ট করার প্রচেষ্টায় নয়াদিল্লির সঙ্গে জুড়ে যান। যার ফলে ক্লায়েন্ট নেতাদের উত্থান ঘটে যাদের বাস্তবে কোনও জনভিত্তিঅ নেই। কাশ্মীরের নাগরিকদের হরি সিং এবং তাঁর অন্যান্য জমিদার বন্ধুদের দমনমূলক শাসন থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে নেতৃত্ব দিয়েছে জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সই। গান্ধি ও নেহরু ভারতের কাছে যেমন, শেখ মহম্মদ আবদুল্লাহ জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে তাইই। শেখ আবদুল্লাহকে আধুনিক জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থেকে আলাদা করা যায় না কোনওভাবেই।

শেখ মহম্মদ আবদুল্লাহের সঙ্গে নেহরু (১৯৪৮)

ন্যাশনাল কনফারেন্স ভূমি সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছে। কাশ্মীরিদের জীবন এই ভূমি সংস্কারকে ঘিরেই মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই সংস্কারগুলি সকলের জন্য জমি, খেতে-পরে বাঁচা এবং জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অর্থনৈতিক গতিশীলতা এবং উন্নত ভবিষ্যতের আশার ভিত্তি তৈরি করে। সেই সংস্কারের ফলেই কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে প্রথম সারিতে রয়েছে।

বিজেপি-আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভাবধারা, তাঁদের ভূমিকাকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা মোদির আমলে ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’-এর মতোই ‘এনসি মুক্ত জম্মু ও কাশ্মীর’ স্লোগানকে প্রচার করা হচ্ছে। মুফতি, লোনস, বুখারি এবং রশিদদের মতো মানুষরা আসলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের কাছে তুচ্ছ কারণ কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে এই মানুষদের গভীর আদর্শগত সংযোগের অভাব রয়েছে। চাইলেই এই মানুষদের গোষ্ঠী যে কোনও সময় ভেঙে দেওয়া যেতে পারে, যেমন সম্প্রতি পিডিপি-র ক্ষেত্রে হয়েছে। উল্টোদিকে, ন্যাশনাল কনফারেন্স কিন্তু আমজনতার সঙ্গে শক্তিশালী এবং স্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখে। সেই কারণেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন নয়াদিল্লি ওমর আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্সের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

আরও পড়ুন- কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য দায়ী নেহরু, বলছেন অমিত শাহ! কী বলছেন কাশ্মীরে মানুষ?

ন্যাশনাল কনফারেন্স ধারাবাহিকভাবে নয়াদিল্লিতে এবং জম্মু ও কাশ্মীরে সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্বার্থের বিরোধিতা করেছে যারা জম্মু ও কাশ্মীরে ভূমি সংস্কারের বিরোধিতা করেছিল। লখনপুর থেকে কর্নাহ পর্যন্ত ন্যাশনাল কনফারেন্স জনগণের সঙ্গে গভীরে সংযোগ বজায় রেখেছে। জনগণের সঙ্গে দলের সম্পর্ক দলের পরিচয়ের অন্যতম মৌলিক দিক হয়ে উঠেছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স সাধারণ মানুষের জীবন গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। জীবনকে প্রভাবিত তো করেছেই।

ফারুক আবদুল্লাহর সঙ্গে রাহুল গান্ধি

গত কয়েক দশক ধরে, রাজনৈতিক কৌশল এবং অবিচারের বহু উদাহরণ জম্মু ও কাশ্মীরকে প্রভাবিত করেছে। নির্বাচনী গণতন্ত্র স্থগিত করার পর ১৯৯৬ সালে, ফারুক আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্স বিজয়ী হয় এবং বিধানসভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের জন্য চাপ দেয়। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই দেওয়া এই প্রস্তাবটি বিজেপির ঘুম উড়িয়ে দেয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য, বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র মুফতি মহম্মদ সঈদের নেতৃত্বাধীন পিডিপি-র মাধ্যমে ‘স্ব-শাসন’ ধারণাটি চালু করে। এই শব্দটি কেবল সাংবিধানিক কাঠামোই নয়, সার্বভৌমত্বকেও ছাড়িয়ে যায়। জনগণ বিভ্রান্ত হয়। আসলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এবং বিভক্ত করার একটি চক্রান্ত ছিল এই কৌশলটি। যার পরিণতি হিসেবেই কিন্তু আজ আপনি পার্টির মতো দল গঠন হচ্ছে, যার নেতৃত্বে আছেন আলতাফ বুখারি। বুখারি আগে পিডিপির সঙ্গেই যুক্ত ছিল। সাজাদ লোনের নেতৃত্বে পিসি, গুলাম নবি আজাদের নেতৃত্বে ডিএপিএ তৈরি হয়েছে। মোদির প্রোপাগান্ডাকে বাস্তবায়িত করাই এদের লক্ষ্য। এদের রাজনৈতিক ভিত্তি মোদির তথাকথিত ‘নয়া কাশ্মীর’ প্রেক্ষাপটেই তৈরি।

এদের সকলের আসল রূপ প্রকাশ করে দিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণই, এদের প্রত্যাখ্যানও করেছে। এখন, একটি নতুন বিভ্রমকে সামনে আনা হচ্ছে। রশিদ ও তথাকথিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-দের মাধ্যমে পরিচয় ও নৈতিকতার রাজনীতির মুখোশ পরিয়ে (যেমন ১৯৯৯ সালে MUF-এর প্রতীক আর PDP-র স্ব-শাসন) কাল্পনিক রাজনৈতিক বিভ্রম তৈরি করা হচ্ছে। কেন্দ্রের এই কৌশলটির লক্ষ্য আমাদের অধিকার এবং সম্পদের উপর প্রকৃত দাবিকে ক্ষুণ্ন করা। ন্যাশনাল কনফারেন্স কাশ্মীরিদের অধিকারের কথা বলে, এখানের সম্পদের উপর তাঁদের দাবিকে সমর্থন করে। বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার আমাদের ঐক্যকে দুর্বল ও পরাস্ত করতে আমাদের অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে যাতে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। এই মূহূর্তে একমাত্র শক্তি যা জনগণের স্বার্থের জন্য লড়াই করতে পারে তা হলো জম্মু ও কাশ্মীরের ক্যাডার ভিত্তিক রাজনৈতিক দল— ওমর আবদুল্লাহর নেতৃত্বে জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স।

 


লেখক ইরফান গুল জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত একজন রাজনৈতিক কর্মী

More Articles