‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’
Gaza-Israel War: ফিনিক্স নামের যে পাখিটি ভূখণ্ডের চেহারা নিয়ে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে, অনিবার্যভাবেই তার নাম জানবেন গাজ়া।
আরবিতে সঠিক উচ্চারণ হল ‘ফ্যলাস্তিন’। প্যালেস্টাইন, ফিলাস্তিন, ফিলিস্তিন… বিবিধ নামে ডাকা হয় তাকে। নামের উচ্চারণ বা বানান যাই হোক না কেন, এ নামের মানে একটাই— প্রতিরোধ! তৃতীয় দফায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একটা বছর পেরোতে চলল। এই বছরটা জুড়ে খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় কিংবা হাতফোনের ছোট্ট পরদায় ধ্বংসস্তূপে বদলে যাওয়া গাজ়া স্ট্রিপের ছবি, মৃত্যুমিছিলের ছবি, পুতুলের মতো ফুটফুটে শিশুদের লাশের ছবি আমাদের চোখ-সওয়া হয়ে গেছে; আমরা ভবিতব্যে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছি, মেনে নিয়েছি এই-ই তবে পরিণতি! গণমৃত্যুর ছায়া জীবনের থেকে দীর্ঘতর হয়ে আমাদের গিলে খেয়েছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন, সেই হাহাকারের অবধারিত বারমাস্যা ফিরে শোনানোর জন্য এ-লেখার অবতারণা— ভুল ভেবেছেন।
এই যুদ্ধের প্রধান দিক কোনটি?
এই অগ্নিগর্ভ একটা বছরকে ফিরে দেখলে ফিলিস্তিন নিয়ে বাজার-চলতি একটা অর্ধসত্য চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ে। তা হল, অসহায় ফিলিস্তিনে পরম শক্তিশালী ইজরায়েলের আগ্রাসী ধ্বংস আর গণহত্যাই ফিলিস্তিন-ইজরায়েল সংঘাতের প্রধান দিক। আমরা বলছি, তা সত্যি বটে, কিন্তু সত্যের প্রধান দিক কখনও এটা নয়। ভূমধ্যসাগর-পাড়ের এককুচি এক গাজ়া স্ট্রিপ— আয়তনে যা আমাদের হুগলি জেলার তিনভাগের একভাগ মোটে, পাহাড় বা জঙ্গলের মতো একটু কোনও আড়ালও নেই যেখানে পিঠ বাঁচানোর মতো— কীভাবে তার ভাঙাচোরা চোয়াল শক্ত করে শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াই দিয়ে যাচ্ছে টানা দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে? চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যে যে ইজরায়েল মাত্র কয়েক সপ্তাহে যাবতীয় বিরুদ্ধতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার চেতাবনি দিয়েছিল— আজ একবছর হয়ে গেল। বিজয় এখনও তাদের ধরাছোঁয়ার থেকে ঢের দূরে! গাজ়া স্ট্রিপ! সেই ২০০০ সাল থেকে ওয়েস্ট ব্যাংক নয়, গাজ়াই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধের সত্যিকারের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: এক কক্ষপথ পার, নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আজও যুদ্ধক্লান্ত গাজা
১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের ট্রাক চারজন ফিলাস্তিনি শ্রমিককে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। সেই প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে উঠেছিল অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটি, শুরু হয়েছিল এক অভূতপূর্ব গণপ্রতিরোধের— ইতিহাসে যা 'প্রথম ইন্তিফাদা' নামে চিহ্নিত। ইন্তিফাদা মানে অভ্যুত্থান। আইডিএফ-র আধুনিক অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর গাজ়া স্ট্রিপের জনতা হাতে পাথর তুলে নিয়েছিলেন, পাথর প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল এতটাই ব্যাপক আকারে যে এর ডাকনামই হয়ে দাঁড়ায় ইন্তিফাদাত অল-হিজারা (স্টোন ইন্তিফাদা)। আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু আকস্মিকতায় শেষ হয়ে যায়নি জনগণের এই অভ্যুত্থান। রীতিমতো পাঁচ বছর ৯ মাস ধরে চলেছিল সবকটি ফ্রন্টে ফিলিস্তিনি জনগণের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম— দিনে দিনে তা তীক্ষ্ণতর ও তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। এতটাই, ইজরায়েলি সরকার আশি হাজার সৈন্য নামিয়েও দমাতে পারেনি ছোট্ট দু-টুকরো দেশটির জনগণের ক্রোধের লাভাস্রোতকে।
২০২৪ সালে যখন প্রথম ইন্তিফাদা-র সাইত্রিশ বছর হতে চলেছে— ফিলিস্তিনের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখব, কীভাবে যুঝতে যুঝতে জীবন ও যুদ্ধের চিহ্ন ও অস্ত্রগুলি বদলে গেছে এতগুলি বছর ধরে। সেই কোন ১৯৬৮ সালে শত্রুপক্ষ যখন আলাম ফিলাস্তিন, মানে ফিলিস্তিনের পতাকার প্রদর্শন, বহন করা এমনকী তা আঁকাও নিষিদ্ধ করে দিল, একফালি তরমুজের ছবিতে ভরে উঠতে লাগল অধিকৃত ফিলিস্তিনের দেয়ালগুলি; পথে ঘাটে, জমায়েতে, শত্রুপক্ষের খোলা চোখের সমুখে মানুষ তুলে ধরতে লাগলেন কাটা তরমুজের ফালি। কারণ— সবুজ, লাল, কালো এমনকী সাদাও— তরমুজের টুকরোয় পতাকার সবকটি রং-ই রয়েছে! প্রথম ইন্তিফাদা-র সময়ে যখন সার্বিকভাবে ইজরায়েলি পণ্য বয়কট শুরু করা হয়েছিল, সেই সময়ে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বেইত সাহোর-এ কিছু মানুষ ইজরায়েলে উৎপাদিত দুধকে বয়কট করতে নিজেরা কয়েকটি গরু কিনে সমবায় শুরু করেছিলেন। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ইজরায়েলকে প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হয়ে উঠল গরু। আর চাবি প্রতীকায়িত করল স্বভূমিতে ফেরার অধিকারকে। অলিভের শাখা ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক, মাহমুদ দারভিশ লিখলেন— “অলিভ গাছেরা জানে কোন হাত পুঁতেছিল তাকে, নিঙড়ানো তেল তার অশ্রুবিন্দু হবে।” যুদ্ধ দু-পক্ষে যত ক্ষমাহীন হয়ে উঠতে লাগল, ততই কমে আসতে লাগল অলিভ শাখার ব্যবহার। ‘শান্তিপূর্ণ’ আর ‘প্রতিরোধ’ ফিলিস্তিনি ভুবনে তখন পরস্পরবিরোধী দুটি শব্দ। তুলনায় নবীন আরেকটি প্রতীক, চামচ, দ্রুত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য ফিলাস্তিনি সংগ্রাম আর মুক্তির সমার্থক—২০২১ সালে যখন ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে মাত্র ছ-কিলোমিটার দূরে ইজরায়েল রাষ্ট্রসীমার মধ্যে অতিসুরক্ষিত গিলোবা কয়েদখানার ছ'জন ফিলিস্তিনি রাজবন্দি শুধু ক'টি স্টিলের চামচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে জেল থেকে পালাতে পারলেন। এবং কাফিয়্যাহ্ (স্কার্ফ) আর গেরিলা পোশাকে সজ্জিত, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ফিলিস্তিনের হয়ে প্রথম নারী বিমান-ছিনতাইকারী লাইলা খালিদ বিশ্ব জুড়ে হয়ে দাঁড়ালেন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ, সংগ্রামী নারী আর বামপন্থার ‘পোস্টার গার্ল’।
প্রতীকের এই বদলে যাওয়াটা শুধু উপরিকাঠামোয় ছিল না। ২০০০ সালে যখন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয় (অল-আক্সা ইন্তিফাদা), তখন ফিলিস্তিনের মানুষ পাথরের বদলে আস্থা রাখতে শুরু করে দিয়েছেন ইনসাস, মর্টার, মিসাইলে। মুহুর্মুহু আক্রমণের ধাক্কায় ইজরায়েলের ভিত কেঁপে উঠেছে তখন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ ইজরায়েলকে বাধ্য করেছিল ডিসএনগেজমেন্টে । দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলেছিল ২০০৫ অবধি। এর ঠিক আঠারো বছর পরে ২০২৩-এর অক্টোবর সাতে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ-যোদ্ধারা যখন ইজরায়েলের সীমারেখার মধ্যে ঢুকে মারাত্মক আঘাত হানল, তার অভিঘাত ইজরায়েলের শাসকদের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছিল। কারণ ইজরায়েলের বহু-আস্ফালিত আয়রন ডোম ইত্যাদি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বাগাড়ম্বর প্রমাণ করে ছেড়েছিল এই অতর্কিত হানা। পুরোটাই কি তার অপ্রত্যাশিত ছিল ইজরায়েলের শাসকদের কাছে? বারবার দেশি ও মার্কিনি গোয়েন্দা-দপ্তর সতর্ক করার পরেও যখন আগাম ব্যবস্থা নেয়নি নেতানিয়াহু-র সরকার, তখন বেশ বোঝা যায় তারা চেয়েছিল একটা আক্রমণ হোক ফিলিস্তিনের দিক থেকে, তাহলে সেটাকে অজুহাত করে গাজ়ায় সৈন্য ঢুকিয়ে দেওয়াটাকে বৈধতা দেওয়া যাবে। তখন নেতানইয়াহু দুঃস্বপ্নেও কি ভেবেছিল যে আক্রমণের তীব্রতা এই পর্যায়ে যাবে?
আরও পড়ুন:ইজরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরেই বন্ধ ইরানের আকাশপথ! জবাব ফেরাতে পারবেন নেতানিয়াহু?
২০২৩-এর অক্টোবর সাতাশে ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স গাজ়ায় আক্রমণ শুরু করে। তার মানে এই নিবন্ধ লেখার সময় অবধি পেরিয়ে গেছে ৩৪৫টি দিন। এই দীর্ঘ সময় ধরে ধ্বংস আর গণহত্যা চালিয়ে কী অর্জন করেছে ইজরায়েল? গোটা পৃথিবীর সুস্থ বুদ্ধির মানুষের ঘৃণা আর প্রত্যাখ্যান ছাড়া? পণবন্দিদের ছাড়িয়ে আনতে পারেনি তারা; এই ৩৪৫-এর মধ্যে এমন একটা দিনও নেই আইডিএফ প্রতিরোধ-যোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের মোকাবেলা করতে হয়নি! দেশের মানুষের জীবন বাজি রেখে নেতানিয়াহুর উচ্চাকাঙ্ক্ষী একরোখা এই দখল-নীতির প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশবাসীর গণরোষ তার গদিই নড়িয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আর ইয়োভ গ্যালান্টকে আরও হিংস্র, আরও মরিয়া করে তুলছে। যত ব্যর্থ হচ্ছে তারা, ততই গণহত্যার পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে। যত বাড়ছে সেই পরিধি, ততটাই দৃঢ়ভাবে ফিলিস্তিনের মানুষেরা ফিদায়িঁ-দের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াচ্ছেন। কোনও অনুশোচনা নেই, অনুতাপ নেই কোনও। ধ্বংসস্তূপে ভাঙা দেয়ালের ওধার থেকে যে কোনও সময়ে ছুটে আসতে পারে মর্টারের শেল। মৃত্যুকে দেখে নিয়েছেন গাজ়ার মানুষজন। অশ্রু শক্তিতে, ঘৃণা ক্রোধে বদলে গিয়েছে। মনে রাখবেন, ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স নামটাই ব্যবহার করেন না ফিলিস্তিনিরা। তাঁরা বলেন ইজরায়েল অকুপেশন ফোর্স । দেশের মাটিতে হানাদারদের কবরের মাটি চেনাতে বদ্ধপরিকর তাঁরা। গাজ়ার পর অভ্যুত্থান মাথা তুলছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, আর ফিলিস্তিনের সীমা ছাড়িয়ে যুদ্ধ আজকে ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননে, ইরানের দ্বারপ্রান্তে। পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে ইজরায়েল আজ একা। আর ফিনিক্স নামের যে পাখিটি ভূখণ্ডের চেহারা নিয়ে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে, অনিবার্যভাবেই তার নাম জানবেন গাজ়া।
(শিরোনামটি মৃদুল দাশগুপ্ত-র কবিতা থেকে ধার করা)