মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া, খুন-বোমাবাজি! যেভাবে বিজয়গড় দখলে রেখেছিলেন নিখিল
Mastan of Kolkata Bijoygarh: পকেট থেকে বের করছে চারমিনারের হলুদ প্যাকেট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। চারদিক ধোঁয়া। ছিন্নভিন্ন ননী নাগের শরীর।
১৯৭১-এর এক ভোরবেলা। বিজয়গড় তখনও জেগে ওঠেনি। বাজারে দোকানিরা সবেমাত্র এসেছে। পিনাকী (নাম পরিবর্তিত) চলল হরিণঘাটার ডিপোয় দুধ আনতে। দুধ নিয়ে এলে বাড়িতে সকালবেলার চা হবে। পিনাকী মোড়ের মাথায় সবে এসেছে। দেখল, দুটো গাড়ি এসে পরপর থামল বাজার পেরিয়ে পচা পান মোড়ে। গাড়ির দরজা খুলে নামল নিখিল, সঙ্গে আরও জনা দশেক যুবক। পিনাকীর বয়স কম কিন্তু বিজয়গড়ের নামজাদা 'মস্তান' নিখিলকে চিনতে ভুল করল না। বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল তার। আর সামনের মোড়ের দিকে পা না বাড়িয়ে সোজা গলির রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে ছুটল পিনাকী। বাড়িতে এসে উত্তেজিত হয়ে বলল, "বাবা, নিখিল ফিরে এসেছে। গাড়ি থেকে নামল এক্ষুনি। সঙ্গে অনেক লোক।" বলতে বলতেই পিনাকী লক্ষ্য করছে, তার বাবা এসব কথা শুনতে শুনতেই গায়ের জামাটা গলিয়ে নিল। পিনাকীর কথা শেষ হতে না হতেই, ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে গেল বাবা। পিনাকীর বাবা সিপিআইএম সমর্থক।কংগ্রেসের নিখিল বসু রায় বিজয়গড়ে ফিরে এসেছে শুনে ওই মুহূর্তেই বাড়ি ছেড়ে দিল পিনাকীর বাবা।
নিখিল ফিরে এসেছে। নিখিল ফিরে এসেছে! এক ঘণ্টার মধ্যেই গোটা তল্লাট জেনে গেল। বিজয়গড়ের 'শাসক' ফিরে এসেছে। ৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে বামেদের প্রতিরোধে বিজয়গড় ছেড়েছিল নিখিল। ১৯৬৯-এর পর আবার এসেছিল। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারপর আশ্রয় নিয়েছিল পুরনো কংগ্রেস ভবনে । তারপর একাত্তর সালের এক সকালে আবার ফিরে এসেছে। সিপিআইএমের ভাষায় 'ত্রাস' আর কংগ্রেস কর্মীদের কাছে 'ত্রাতা'। নিখিল বসু রায় ফিরে এসেছে। একে একে বিজয়গড় ছাড়তে লাগল সিপিআইএম সমর্থকরা।
বিজয় গড়ের নিখিল। পুরো নাম নিখিল বসু রায়চৌধুরী। নিজের নাম কোথাও লেখার প্রয়োজন হলে, গম্ভীর গলায় নিখিল অর্ডার দিতেন, "ভালো করে লেখ, নিখিল বসু রায়চৌধুরী মহাশয়।" দীর্ঘ পেশিবহুল চেহারা। ভয় ধরানো এক উপস্থিতি। নেভিতে চাকরি করার সুবাদে রীতিমতো সেনা প্রশিক্ষণ রয়েছে। অস্ত্র চালনায় পটু। নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। বিরোধীদের বুকে ভয় ধরানো এক নাম নিখিল।
নিখিল বসু রায়কে চিনত কংগ্রেসের প্রদেশ নেতৃত্ব। সেই সময়ের তরুণ তুর্কি ছাত্র নেতৃত্ব প্রিয়-সুব্রত বিলক্ষণ জানতেন নিখিল বসু রায় আসলে কে? কংগ্রেস নেতৃত্ব একপ্রকার নিশ্চিন্ত ছিল কারণ, টালিগঞ্জে নিখিল বসু রায় আছে। বিজয়গড় কলোনিতে বসেই কন্ট্রোল করছে সে। সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গি নিখিলের সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই অতি তির্যক। তারা বলত, নিখিল গুন্ডা, স্রেফ মস্তান। বিজয়গড় তো বটেই, গোটা টালিগঞ্জেই দাপিয়ে বেড়াত নিখিলবাহিনী। এতকাল পর তাঁর পরিচয় তুলে ধরতে গেলে বলা উচিত, নিখিল ছিলেন কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত বাহুবলী। এক পলিটিক্যাল মস্তান।
আরও পড়ুন-এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে
বিজয়গড়ের নিখিল পর্ব শুরু হওয়ার একটা পটভূমি ছিল। নিখিল উত্থানের আগে বিজয়গড়ের রাজনৈতিক পরিবেশটা একটু বুঝে নিতে পারলে নিখিল বসু রায়কে বুঝতেও সুবিধা হবে। বিজয়গড়ে কলোনি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫০ সালের আশেপাশে। তার আগে থেকেই শরণার্থীদের ভিড় বাড়ছিল এই অঞ্চলে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নামল বিস্তীর্ণ দক্ষিণ শহরতলিতে। জবরদখল কলোনি হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করল বিজয়গড় কলোনি। তখনও স্বীকৃতি পায়নি কিন্তু ১৯৫০ সাল থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই কলোনিতে হাসপাতাল, অসংখ্য বিদ্যালয়, পরবর্তীতে কলেজ, রাস্তাঘাট তৈরি হলো। বিধান রায়ের আমলে হওয়া এই উন্নয়নকে পুঁজি করে কংগ্রেস শক্ত ঘাঁটি বানাল বিজয়গড়কে । শুরুর দিকে কলোনির মধ্যে হিন্দু মহাসভার বেশ কিছু সমর্থক ছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব আলাদা করে ছিল না। পরবর্তী কালে সিপিআইএম, আরএসপি ও অন্যান্য বাম দল বাড়তে থাকে। ষাটের দশকে এইসব অঞ্চলে বীরেশ্বর চ্যাটার্জি, রবি চ্যাটার্জিদের মতো ডাকাবুকো যুবকরা লাল ঝান্ডার তলায় জড়ো হয়। প্রভাব বাড়তে থাকে এদের। এলাকায় কংগ্রেসের নেতৃত্ব তখন প্রবীণ সম্প্রদায়ের। কংগ্রেসের যুবকরা আছে বটে কিন্তু বামেদের যুব মুখগুলি অনেক বেশি জোরালো। এমন একটা সময় কংগ্রেসের একজন শক্তপোক্ত ডাকাবুকো যুব মুখের প্রয়োজন পড়ছিল। এমন এক প্রেক্ষাপটেই কলোনিতে আসেন নিখিল বসু রায়। কংগ্রেসি যুবকদের সংগঠিত করেন। নিখিল বসু রায়ের বোনের বিয়ে হয়েছিল বিজয়গড় অঞ্চলে। তবে তার পরিবার, বাপ-মা এসব নিয়ে কেউই তেমন কিছু বিশেষ জানত না। সেক্ষেত্রে অনুমান করা যেতে পারে, এই বিশাল কলোনিতে বাম যুব মুখগুলির কাউন্টার হিসেবেই নিখিলের অবস্থান স্থির করে দিয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ, এই এলাকায় প্রদেশ কংগ্রেসের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন অনেক প্রবীণ চরিত্র ছিলেন। সেই সময় যাদবপুরে শচিন সেন, তার দুই ডাকাবুকো ভাইপো নান্টু সেন, পিন্টু সেন। আবার বিজয়গড়ে বীরেশ্বর চ্যাটার্জি, পাশে কাজল দত্ত, বাদল দত্ত এবং সর্বোপরি খোকা চক্রবর্তীর মতো আগুনখোর যুব মুখ ছিল। একটা এলাকা দখলে রাখতে এদের একজনই যথেষ্ট। বিজয়গড় ও তার আশপাশে বাম মিলিটান্ট যুব সংগঠন গড়ে ওঠায়, কংগ্রেসের তরফে একটা 'কাউন্টার' প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। নিখিল সেই 'কাউন্টার'। যার পরিণতিতে টক্কর জোরদার হলো বিজয়গড় জুড়ে।
এর মধ্যে উদ্বাস্তু কলোনিতে প্রথম খুনের ঘটনা ঘটল। ঘটনা কলোনির মাটিতে ঘটেনি কিন্তু প্রথম কলোনির একটি ছেলে খুন হয়ে গেল টালিগঞ্জ আইটিআই-এর সামনে। সত্তরের দশকের শুরুতেই স্বপন গাঙ্গুলি নামের এক বামপন্থী যুবককে হত্যা করে কেউ বা কারা। সিপিএমের অভিযোগ ছিল কংগ্রেস আর কংশালদের উপর। স্বপনের ডাক নাম ছিল দামু। দামুর নিথর শরীর নিয়ে মিছিল ঢুকল বিজয়গড়ে। তখন বিকেল হয়ে এসেছে। বিজয়গড় মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে রাখা হলো দামুর মৃতদেহ। এই প্রথম এক রাজনৈতিক খুন দেখল বিজয়গড়। এরপরই বিজয়গড়ের মাটিতে প্রথম হত্যাকাণ্ড। কংগ্রেস নেতা ননী নাগ খুন।
ননী নাগ এলাকার একজন গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নেতা। থাকতেন বিজয়গড় ছয় নম্বর ওয়ার্ডে। ব্যবসা করতেন ইমারতি দ্রব্যের। দোকান ছিল বিজয়গড় বাজার লাগোয়া পচা পান মোড়ে। বিজয়গড়ে দামুর হত্যাকাণ্ডের পর টেনশন বেড়ে গেল। ননী নাগকে নিরাপত্তা দিত সশস্ত্র পুলিশ। সঙ্গে দু'জন পুলিশ নিয়ে রিকশা চেপে বিজয়গড় ছয় নম্বর থেকে পচা পান মোড়ে দোকান করতে আসতেন ননী নাগ। তাঁর যাতায়াতের সময়টা মোটামুটি জানত সিপিএমের অ্যাকশন স্কোয়াড। সেই সময় নিখিলও তার বাহিনী নিয়ে বিজয়গড়েই আছে। বিজয়গড় জাগরণী ক্লাবে মাঝেমধ্যেই পুলিশ ক্যাম্প হয়। প্রিয়-সুব্রতরা এসে মিটিং করে যান। এইরকম একটা ঘেরাটোপে খুন হয়ে গেলেন ননী নাগ। বিজয়গড়ের মাটিতে প্রথম খুন। যেসব বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল তা শুধু অত্যাধুনিক নয়, চমকপ্রদও ছিল!
প্রতিদিনকার মতো বাড়ি থেকে পুলিশি প্রহরায় রিকশা চেপে আসছিলেন ননী। তল্লাট জুড়ে নিখিলের প্রবল শাসন। ননী নাগ দেখেন এলাকা বিলকুল নিরাপদ। তেমন সন্দেহজনক কেউ নেই, কিছু বাজার চলতি লোকজন। চায়ের দোকানে রোজকার মতোই কিছু লোকজন। একটা ছেলে রাস্তার পাশে ছোট দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। স্বাভাবিক শান্ত পরিস্থিতি। ননী নাগ দোকানে চললেন নিশ্চিন্ত মনে।
হঠাৎই তাঁর রিকশার সামনে লাফিয়ে নামে ঘুড়ি ওড়াতে থাকা ওই ছেলেটা। পকেট থেকে বের করছে চারমিনারের হলুদ প্যাকেট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। চারদিক ধোঁয়া। ছিন্নভিন্ন ননী নাগের শরীর। ননী নাগকে লক্ষ্য করে সেদিন চারমিনার সিগারেটের হলুদ প্যাকেটে ভরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ছুঁড়েছিল আক্রমণকারী। চারমিনারের প্যাকেটে এমন বোমা থাকতে পারে তখন কল্পনাতেই আনতে পারেনি কেউ। বড় ঘটনা ঘটিয়ে দিল সিপিআইএমের অ্যাকশন স্কোয়াড। কেঁপে উঠল বিজয়গড়।
আরও পড়ুন-মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! বাঘাযতীনের মস্তান কানা অজিত আজও কিংবদন্তি
এই ঘটনার বদলা নিতে নামল কংগ্রেসের সশস্ত্র বাহিনী। নিখিল বসু রায় ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলেন, তিনি বিজয়গড়ে থাকতে এই ঘটনা ঘটল কীভাবে! একাত্তরের শেষ, সামনে বাহাত্তরের নির্বাচন। সিপিআইএম সমর্থক-কর্মীরা এলাকাছাড়া, আশেপাশের অঞ্চলে বা বিজয়গড়ের অন্য প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যেই মূল রাস্তার উপর ঘটে গেল এমন ঘটনা। মাথায় হাত দিয়ে বসলেন নিখিলও।
কে দেয় খবর? কে বা কারা সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের ইনফরমার? এসবই শুধু মাথায় ঘুরছে নিখিলের। বিজয়গড়ের পাশেই অশ্বিনী নগর অঞ্চল। নিখিল বাহিনীর নজরে পড়ল বোবা তপন। বোবা-কালা, আধ-পাগল এই লোকটা ঘুরে বেড়ায় এলাকায় এলাকায়।
নিখিলের সন্দেহ, এই লোকই ইনফরমার। এই দিয়েছে খবর। সন্দেহ হতেই অ্যাকশন শুরু। বোবা তপনকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করল কেউ বা কারা। সিপিএম অভিযোগ করল কংগ্রেস আর নকশালদের বিরুদ্ধে। এখানেই শেষ নয়, ননী দত্ত হত্যার জেরে বোমা বিস্ফোরণ হল অশ্বিনী নগর স্কুলে। বিস্ফোরণে হাত উড়ে গেল ফুলটু দত্ত নামে এক যুবকের। বিজয়গড়ের লড়াই ক্রমে যেন ছড়িয়ে পড়ে গোটা টালিগঞ্জে।
পাল্টা বদলা নিতে অস্ত্রে শান দিচ্ছিল সিপিআইএম। স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী ভজন নাগের এক ভাই ছিল, পূজন নাগ। পূজন স্থানীয় রাম ঠাকুরের আশ্রমে একদিন ভক্তদের চরণামৃত দিচ্ছিল। তাকে তুলে নিয়ে গেল সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াড। পরের দিন পূজনের মৃতদেহ পাওয়া গেল। ঘটনায় কংগ্রেস দায়ী করল কমরেড বাহুবলী খোকা চক্রবর্তীকে। খোকা তখন বামেদের সশস্ত্র যুব বাহিনীর এক শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডার বলা যায়। খুন, বোমা, গুলির ছররার শব্দে কম্পমান একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তর সাল শুরু হল। সেই বিতর্কিত বিধানসভা নির্বাচন এসে গেল দোরগোড়ায়। সরগরম হয়ে উঠল বিজয়গড়।
বিজয়গড় কলেজে সিপিআইএম এজেন্টদের নাগাড়ে হুমকি দিতে লাগল নিখিল বাহিনী। ওদিকে, পাশেই গলফ গ্রিনের মাঠে চলতে লাগল নিধন যজ্ঞ। অভিযোগ, নিখিল, কানা অজিত বাহিনী দাপিয়ে বেড়াত ওই অন্ধকার প্রান্তরে। ভোটের দিন গোলমাল তুঙ্গে উঠল। ভোটকেন্দ্রের বাইরে রক্তারক্তি কাণ্ড। নিখিল বাহিনী ছাড়াও গলফগ্রিনের মাঠে জড়ো হয়েছে বাইরের বহু মস্তান।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্যই বলা উচিত। নিখিল বসু রায় অবশ্যই বাম কর্মীদের কাছে আতঙ্কের অপর নাম হিসেবেই বিবেচিত হতেন। তাঁর নেতৃত্বে এক বিশাল সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের একাংশের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে এক লুম্পেন বাহিনীও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাড়ার বহু সিপিআইএম সমর্থক বা ইলেকশন এজেন্টকে ঘাতক বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন নিখিল বসু রায়ই। এটা একেবারেই এক পাড়ার সমীকরণ কিন্তু বাঁচিয়েছিলেন অনেককেই! বাইরে থেকে আসা মস্তান বাহিনী ঘুরছে ভোট কেন্দ্রের বাইরে। নিখিলের লোকজন পাড়ার সিপিএম ছেলেদের কানে কানে বলে আসছে, "কেউ যদি এসে বলে বাইরে তোর বাড়ির লোক এসেছে দেখা করতে, খবরদার বেরোবি না।" পাড়ার একান্ত পরিচিত সিপিএম ছেলেদের জন্যও এই আন্তরিকতাটুকু দেখাতে ভোলেননি নিখিল। এক রক্তাক্ত সময়ে দাঁড়িয়েও কিছু ক্ষেত্রে সৌজন্য রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন-ভবানীপুরের ডন, কুঁদঘাটের বোম! দক্ষিণ কলকাতা কাঁপাতেন যে মস্তানরা
২০২৪-এ এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে, বহু প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা কথা উঠে এসেছে। সবাই এক বাক্যে বলেছেন, নিখিলের একটা মন ছিল, বড় হৃদয় ছিল। তাঁকে ঘিরে অবশ্যই বহু প্রশ্ন ছিল, আছে এবং আগামীতেও থাকবে। কংগ্রেসের চোখেও তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল মস্তান। সিপিআইএমের কাছে আতঙ্ক। কিন্তু এটাও সত্য যে নিখিল নিজে লুম্পেন ছিলেন না। কংগ্রেস সংগঠনের লোক ছিলেন, তাই মাত্রাজ্ঞানও ছিল। আবার তার সমস্যাও ছিল বিস্তর। অতিরিক্ত মদ্যপান! সন্ধে হলেই আসর বসত। সেই আসরে এলাকার বহু 'ভদ্রলোক' বলে পরিচিত মানুষজনও ভিড়ত। নিখিলের আরেকটা সমস্যা ছিল। মুখের বদলে সব সময় হাত চলত। যাকে তাকে যখন তখন মারধর করা ছিল তাঁর মুদ্রাদোষের মতো। এলাকা হাতে রাখতে মারই ছিল তাঁর প্রাথমিক অস্ত্র। সব সময় পেশির জোর দেখিয়ে এলাকা ত্রস্ত রাখাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। এই সব করে বহু শত্রুও বানিয়েছিলেন নিখিল।
বিজয়গড় বাজার বেরিয়ে বিজয়গড় দশকর্মা ভাণ্ডারের উল্টোদিকে একটা দোতলা বেডিং স্টোর্স আছে। সরু রথের মতো দোকান। এটা সত্তরের দশকে নিখিলের শৌভিক সংঘ। নীচের তলায় কাঠ কয়লার দোকান, দোতলায় ক্লাব। এই ক্লাব থেকে অনেক দূর পর্যন্ত লক্ষ্য রাখা যেত। খানিক ওয়াচ টাওয়ারের মতো কাজ হতো। বিজয়গড় মেইন রোডের উপর লোকজনের গতিবিধি নজরে রাখা যেত। তখন বিজয়গড় মেইন রোড যার এখন নাম রাম ঠাকুর সরণী, সেই রাস্তায় হাতে গোনা উঁচু নির্মাণ। ফলে শৌভিক সংঘের দোতলায় উঠলে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যেত। এই ক্লাবের দোতলায় মাঝে মধ্যেই সশস্ত্র নিখিল বাহিনী অবস্থান করত। সেই খবর পৌঁছলেই পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিত খোকা চক্রবর্তীর টিম। সেই বাহিনীতে ছিল সিপিআইএমের কাজল দত্ত, বাদল দত্তর মতো দুর্ধর্ষ যুবকরা, যাদেরকে এলাকায় পেশিশক্তির জন্যই লোকে চিনত। কাজল দত্তর কথা বলতে গিয়ে আজও প্রবীণ লোকজন বলেন, দশজনকে একা যুঝবার ক্ষমতা কাজলের ছিল। ভয়ংকর গায়ের জোর! সিপিএমের মস্তান বলেই পরিচিতি ছিল কাজল দত্ত, বাদল দত্তদের। এই দুই দুর্ধর্ষ বাহুবলী ভ্রাতৃদ্বয় বিজয়গড় আমরা ক'জন ক্লাবের কালীপুজোর অন্যতম স্রষ্টা। এই কালীপুজো ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কালীপুজো বলেই পরিচিত ছিল। তবে কাজল-বাদল ছিল মূলত এলাকার নামী স্ট্রংম্যান। সেই সময় সিপিআইএমের বাহিনীর এগিয়ে থাকা মুখ ছিল খোকা চক্রবর্তী। অ্যাকশন স্কোয়াড চলত তার ইশারায়। এই সময় জুড়ে কংগ্রেস বাহিনীর বিরুদ্ধে বহু সফল অ্যাকশন সংগঠিত করেছিল খোকার বাহিনী। যুক্তফ্রন্ট আমলে ১৯৬৮ সাল নাগাদ নিখিলকে টার্গেট করে খোকা। অনেকদিন ধরেই কংগ্রেসের এই স্ট্রংম্যানের উপর নজর ছিল খোকার। সরকার বদল হতেই হামলার ছক কষল। যদিও নিখিলের উপর মূল হামলা করেছিল কাজল দত্ত, সঙ্গে বাদল দত্ত, দাউদ খোকা এবং মুচি বাচ্চু।
বিজয়গড় জাগরণী ক্লাব চত্ত্বর ছিল বরাবরই কংগ্রেস অধ্যুষিত। ওই এলাকায় ছিল নিখিলের দাপট। একদিন এই জাগরণীর সামনেই নিখিলকে ঘিরে ফেলে কাজল দত্তর গ্যাং। সাধারণত নিখিলকে ঘিরে ছেলেদের ভিড় থাকে। ওইদিন যে কোনও কারণেই হোক ক্লাবের সামনে একাই ছিলেন নিখিল। এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে আক্রমণ করে বসে কাজল বাহিনী। কাজল দত্তর গায়ে ছিল অসুরের জোর। নিখিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজল। গায়ের জোরে যেহেতু নিখিলও ভয়ংকর, ফলে বিরাট লড়াই বেঁধে গেল। এই লড়াই চলতে চলতেই মুচি বাচ্চু নামে কাজলের দলের একটি ছেলে একটা আঁধলা ইট ছুড়ল নিখিলের মাথা লক্ষ্য করে। রড না, আগ্নেয়াস্ত্র না, বোমা না, ছোরা না, স্রেফ একটা আধলা ইট! ঘটনার আকস্মিকতায় অজ্ঞান হয়ে যান নিখিল। এলাকায় রটে গেল, আধলা দিয়ে নিখিলের মাথা থেঁতলে দিয়েছে কাজল বাহিনী। কেউ কেউ বলে, হামলার ছক আদতে করেছিল খোকা চক্রবর্তী। ওই বিরাট শরীর পড়েছিল জাগরণীর সামনে। অনেকে ভেবেছিল, নিখিল শেষ। নিখিল আর নেই। কিন্তু ঘটনার পরই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় বহু চেষ্টায় নিখিল বেঁচে যান। তবে এই ঘটনার পর কিছুদিনের জন্য এলাকা ছেড়ে দেন নিখিল বসু রায় চৌধুরী। তবে আবার ফিরেও আসেন প্রবল শক্তি নিয়ে।
আরও পড়ুন-ভিড়, ভক্ত, ফাংশান, উন্মাদনা! উত্তমকুমারকে যেভাবে আগলে রাখতেন এই মস্তানরা
সেই সময় বিজয়গড় ছিল খানা-ডোবায় ভরা। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় বর্তমানে যে মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে তা সত্তরের দশকে ছিল না। কাঁচা রাস্তা, কচুরিপানায় ভরা বিরাট বিরাট ডোবার কারণে এক একটা মহল্লা বিচ্ছিন্ন ছিল। অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হতো। এই বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগিয়েই বিজয়গড় ১০ নম্বর মহল্লায় আশ্রয় নিয়েছিল সিপিআইএমের কর্মীরা। তার অন্যতম বড় কারণ ছিল এই অঞ্চলে সিপিএমের স্ট্রংম্যান খোকা চক্রবর্তী, কাজল দত্ত, বাদল দত্তের মতো লোকজন ছিল, যারা প্রতিপক্ষের কাছে ছিল ত্রাস!
একদিন সেই আশ্রয়ও থাকল না। লায়েলকার মাঠে পুলিশের এনকাউন্টারে মারা গেল খোকা চক্রবর্তী। খোকার শূন্যতায় দশ নম্বর দখল নিল নিখিল বাহিনী। সেই সময় সিপিআইএমের বিরুদ্ধে এই অভিযানে সামিল ছিলেন নকশাল নেতা পণ্ডিত দাসও। ওই সময়ই বিজয় গড়ের দুই, এক, দশ নম্বর মহল্লাগুলির দখল নেয় নিখিল বাহিনী। পরে সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে অন্য জায়গার মতোই বিজয়গড়ে ঘরে ফেরে বাম কর্মীরা। সেই সময় সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে পাল্টা হানাহানির পথে হাঁটেনি বাম কর্মীরা। নিখিল বসু রায়দেরও এলাকা ছাড়া হতে হয়নি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিজয়গড়েই ছিলেন নিখিল। ভারতমাতা পূজা কমিটির একজন কর্তাব্যক্তি হিসেবে তাঁর সামাজিক পরিচয়ও তৈরি হয়েছিল।
তবে সত্তরের দশকে একটা অমার্জনীয় অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল! মহিলাদের উপর অত্যাচার, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া— এইসব কাজে লুম্পেন বাহিনীর ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক এবং এইসব অবাধে চলত নিখিল বসু রায়দের মতো চরিত্রদের প্রশ্রয়েই। এই প্রতিবেদন শুরু হয়েছিল পিনাকী নামের এক কিশোরের চোখে দেখা আখ্যান দিয়ে। প্রতিবেদন শেষও করব পলুর কাহিনি দিয়েই। পলুর বাবা বেরিয়ে চলে যাওয়ার পর তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয় নিখিলের প্রশ্রয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো লুম্পেন বাহিনী। মুখপোড়া ঝন্টু, বড় জগাই, ছোট জগাইরা (সব নাম পরিবর্তিত) হামলা করে পিনাকীদের বাড়িতে। পিনাকীর মা-কে চুলের মুঠি ধরে উঠোনে বের করা হয়। চলে অবাধ চড়, কিল, ঘুঁষি। এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। সেই সময় বহু পিনাকীর মা এমন নিগ্রহের মুখে পড়েছে। তাই পিনাকীদের কাছে নিখিল এক ঘৃণিত নাম, আজও।