ট্রাম না-থাকলে কত যে নাইট শো জীবনে দেখাই হত না!

Kolkata Tram: ট্রাম না-থাকলে কত যে নাইট শো জীবনে দেখাই হত না! দেখব কী করে? সিনেমা থেকে বেরিয়ে ফিরব কীসে?

ট্রামের গায়ে কলকাতার প্রেম? অনধিক একশো বছর ধরে লেপটে আছে। সেই ১৯৩২-এ লেখা:

‘নাম তার কমলা
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা—
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে…’

কবিতার নাম ‘ক্যামেলিয়া’। কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই যদি ট্রামের একটি চলন হয়, অন্যটি সেই সময়েই কলকাতার জনজীবনকে অন্তর্গূঢ় তারে আপাদমস্তক বেঁধে ফেলেছিল। ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার কাছাকাছি সময়েই (১৯২৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে লেখা হয় ‘মহাপৃথিবী’-র কবিতাগুলি) জীবনানন্দ দাশ ‘ফুটপাথে’ কবিতায় লিখেছিলেন:

‘পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন— মাথার ওপরে অসংখ্য জটিল তারের জাল
শাসন করছে আমাকে।’

এবং, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪, সেই ট্রামই পিষে ফেলেছিল জীবনানন্দ দাশকে।

এতসব তখন আমার জানার কথা নয়। বয়স দশ। সাল ১৯৬০। বড়দিন। গাঁয়ের ছেলে; এসেছি কলকাতা দেখতে। ট্রাম চলেছে এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে দক্ষিণে। আমাদের গন্তব্য প্রথমে ভিক্টোরিয়া, পরে জাদুঘর। কিন্তু যাওয়ার রাস্তাটাই তো সাঙ্ঘাতিক! চোখে আজও কাজলের মতো লেগে আছে। ডাইনে আদিগন্ত ঠান্ডা সবুজ মাঠ। দূরে, শীতের রোদে, ঘাসে গা ডুবিয়ে কেউ শুয়ে। ক্রিকেট খেলছে কোথাও উৎসাহী তরুণেরা। এত বিশাল মাঠ, দেখে মনে হচ্ছে— ওরা মাত্র গুটিকয়েক! বাঁয়ে চওড়া, মসৃণ রাস্তা। তখনও তার সরকারি নাম চৌরঙ্গি রোড। চারপাশ ঝকঝকে। আজ সন্দেহ হয়, তখন সবুজ নির্ঘাত ছিল বেশি সবুজ। সাদা বেশি সাদা। এখন শত চেষ্টা করলেও সেই রূপ আর ফিরে আসবে না।

চোদ্দো বছর আমাদের সংস্কারে একটা বড় সময়। চোদ্দো বছর পর ১৯৭৪-এ সেই ট্রাম হলো আমার নিত্যসঙ্গী। থাকি ট্রাম-রাস্তার উপরে। মেসবাড়িতে। শেষ ট্রাম চলে গেলে ঘুমোতে যাই। ঘুম ভেঙে যায় প্রথম ট্রামের ঘটাংঘট শব্দে। ফের ঢলে পড়ি দ্বিতীয় ঘুমের দিকে। আর জেগে থাকা? সারাদিন ট্রামের পাশে-পাশে। যেন মোষের সারির পিছু-পিছু পাহাড়তলির রাখাল বালক।

মেসের নীচে ট্রাম-রাস্তা। বাঁদিকে চলে গেছে কলেজ স্ট্রিট, চিৎপুর, হাওড়া স্টেশন হয়ে সেই শিবপুর। ডানদিকে শিয়ালদা হয়ে নোনাতলা, পার্ক সার্কাস পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে গলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোয়। চিৎপুরে, গ্যালিফ স্ট্রিটে, ওয়েলেসলিতে, ধর্মতলায়, রাসবিহারীতে, সার্কুলার রোডে, বেলগাছিয়ায়, কলেজ স্ট্রিটে— কত-কত ট্রাম লাইন। এত সবের মধ্যে আমার প্রিয় ট্রামরুটটি ছিল ছোট্ট। কলেজ স্ট্রিট থেকে এসপ্ল্যানেড এবং এসপ্ল্যানেড থেকে কলেজ স্ট্রিট।

সত্তরের দশকেও প্রাইভেট বাসে লোকজন চড়তে চাইত না। হয় সরকারি বাস, নয়তো দরাজদিল ট্রাম। সেই খোলামেলা ট্রামই অফিসটাইমে রুদ্ধশ্বাস। টলতে টলতে এগিয়ে যেত ডালহৌসির দিকে। দেখে ভয় করত— ‘দাদা, বাঁ পা-টা একটু চেপে।’

তেমনই, ময়দানে বড় দলের খেলা থাকলে। ওহ্, সেসব দিনের কথা না-তোলাই ভালো। সেদিন শীতের সকাল। ট্রামে ঝুলতে ঝুলতে কোনওমতে এসপ্ল্যানেড। সঙ্গে মেসের তপন। ময়দানের নানা দিক থেকে লোক হাঁটছে ইডেনের দিকে। মনে নেই, কার সঙ্গে যেন টেস্ট! তপন বলল, ‘চলুন, একটা চান্স নিই।’

কী?

‘আসুন না।’

টানতে টানতে গ্র্যান্ডের গেটে। ফুটে কড়া পুলিশ পাহারা। বললে এখন বিশ্বাস করানো মুশকিল। দেখি, হাতদুটো বুকে বিবেকানন্দ-স্টাইল, বেঁটে মতো কে যেন গ্র্যান্ড থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে আসছে। বিশ্বনাথ না? হ্যাঁ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথই তো! ঠিক পিছনেই জগদ্বিখ্যাত আরেক বেঁটে। সুনীল গাভাসকার!

আরও পড়ুন-শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় ‘ঘাতক’ ট্রামটিও

দুই

একসময় ট্রামে উঠে যখন-তখন এসপ্ল্যানেড যাওয়ার চল ছিল। এমজিএম, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স, প্যারামাউন্ট পিকচার্স, কলম্বিয়া, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ছবি আসত নিয়মিত। ট্রামে চড়ে টুক করে হাজির মার্লন ব্র্যান্ডো কী জ্যাক নিকলসনের জগতে। কখনও ফ্রাঙ্কো নিরো বা পল নিউম্যান, গ্রেগরি পেক কি ওমর শেরিফ, ঘোড়া, আগ্নেয়াস্ত্র আর রুক্ষ ধু ধু নৃশংসতায়।

ট্রাম না-থাকলে কত যে নাইট শো জীবনে দেখাই হত না! দেখব কী করে? সিনেমা থেকে বেরিয়ে ফিরব কীসে? মধ্যরাতে হেঁটে যে ফিরিনি মেসে, তা নয়। তবু, ট্রাম কলকাতার তৎকালীন মধ্যবিত্ত জীবনকে করেছিল ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রলম্বিত। সেসময় কোনও আধ-বেকার ছেলেও রাত ন'টায় বুক ঠুকে বলতে পারত— দ্য নাইট ইজ ইয়াং! সে তো সেই ট্রামেরই ভরসায়!

তবে, শেষ ট্রাম চলে গেলেও ফেরা যেত। একদিন রাত দুটো ছুঁই-ছুঁই। কী করা? রিৎজ কন্টিনেন্টাল, এখন যেটা পিয়ারলেস ইন, থেকে একটু এগিয়ে উলটোফুটে দাঁড়িয়ে। এ তো আন্টার্কটিকা নয়। একটা কিছু তো পাওয়া যাবেই। এবং গেলও। লাল একতলা বাস, ফাঁকা, টার্মিনাস থেকে বেরিয়ে তীব্র গতি নিচ্ছিল। সামনে আমরা। ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের ‘যাবে না, যাবে না’ চিৎকার। ততক্ষণে আমরা বাসে— কোথাও তো যাবে। আশ্চর্য, সে বাস সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে ইডেন হসপিটাল রোড ধরে কলেজ স্ট্রিটে পড়ল। এ কী আর আজকালকার? তখন ড্রাইভাররাও অন্যরকম। দিব্যি কলেজ স্ট্রিটে নামিয়ে দিল।

সারা এসপ্ল্যানেড জুড়ে তখন পথে-পথে চিনা তরুণ-তরুণীর দলবদ্ধ কলকলানি। অ্যাংলো ছেলেমেয়েদের ভিড়। প্রতি শীতে আসত, যাকে বলে, ফরেনাররা। অধিক কী, জীবনানন্দ লিখেছিলেন—

‘নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী;

ফিরিঙ্গি যুবক কটি চলে যায় ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে।’

এখনকার কবিতায় এসব প্রসঙ্গ আর থাকা সম্ভব নয়। এখন চারদিকে শুধু গুটখা আর পানপরাগের দলা-দলা খয়েরি পিক। এখন— ‘বলো কথা কেশরী’!

আরও পড়ুন- ১ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কেঁপেছিল কলকাতা, ট্রামের মতোই ম্রিয়মাণ বাম আন্দোলন?

ষাটের দশকের মাঝামাঝি জাদুঘরের সামনের ফুটে ভিনদেশি এক তরুণকে শুয়ে-শুয়ে কাতরাতে দেখে উৎপলদা (কুমার বসু) তুলে নিয়ে যান তাঁর বাসায়। বাড়ি বিক্রি করে তখন তিনি ক্ষীরোদ মার্কেটের দোতলায়। এসব উৎপলকুমার বসুরই মুখে শোনা। তরুণটি যেতে চাননি। বলেন যে ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে অসুখ তাঁর। মারণব্যাধি বসন্ত। উৎপলদা জোর করে নিয়ে যান এবং সারিয়ে তোলেন। সেরে ওঠার পর, বন্ধুরা গেলে দোকান থেকে সিগারেট আনাতেন সেই সাহেব-বাচ্চাকে দিয়েই। পরে জানা যায়, মানে উৎপলদা জানতে পারেন, আর কেউ নয়, ছেলেটি স্বয়ং রকফেলার-পরিবারের! এবং উৎপলদার লন্ডন বাসকালে সেই সকৃতজ্ঞ যুবক তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন আটলান্টিকের ওপারে, তাঁদের কোনও এক পৈতৃক প্রাসাদে, বিপদকালে প্রাণরক্ষকের সঙ্গে সিনিয়র রকফেলারের আলাপ করাতে।

একদিন গ্রান্ডের নীচ দিয়ে হাঁটছি। হোটেলের গেটে অভিনব দৃশ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো ঝকঝকে এসি বাস। গেট থেকে ট্যুরিস্টদের দুটো লাইন ভিন্ন-ভিন্ন বাসমুখো। একটা লাইনে ফটফটে সাদা চামড়া। অন্যটায় বাঙালির মতো বাদামি— মালয়েশিয়ান। চেহারার মতো লাগেজও আলাদা।

কলকাতার এই-যে কসমোপলিটান চেহারা, এটি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। এবার হয়তো ট্রামও যাবে। ট্রামের দেশিয়, মানে নেটিভ, এক চরিত্রও আছে। দীর্ঘদিন ঘষটাতে ঘষটাতে সেই চরিত্র নির্মিত হয়েছে। তার পুরনো গঠনে, ধীর চলনে, উদার জানালায়, গিঁট-বাঁধা দড়ির ঘণ্টায়, আদ্যিকালের পাখায় আর হাঁসফাঁস শরীরে সে যেন আপনজন। আমরা যেমন, সে ঠিক তেমনই। আর তাই ট্রামের উপর অভিযোগও বিস্তর। ট্রাম স্লো। ট্র্যাকের বাইরে যেতে পারে না। একটা খারাপ হলে পরপর মাইল জুড়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এরকম আরও কত।

আমরা ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকে বড় ভালোবাসি। তাই ট্রামের উন্নতির নানা চেষ্টা করে এসেছি। তাকে জোর করে সুন্দরী বানিয়েছি। বাজারে ছেড়েছি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রাম। কিছুতেই কিছু হয়নি। কী করলে যে হবে, বুঝতেই পারিনি। তবু ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র কলকাতাতেই টিকে আছে সে। একা। নানা দুর্নাম নিয়েও।

কত-কত বছর সে প্রাণপণে ছুটে গেছে। পৌঁছে দিয়েছে স্কুলে-কলেজে, অফিসে-আদালতে, হাসপাতালে, এমনকী শ্মশানেও। তৃষ্ণার্তদের পৌঁছে দিয়েছে শুঁড়িখানায়। মাতালদের দিয়ে এসেছে বাড়িতে। ভিক্ষুককেও সে অবহেলা করেনি। পাখাওয়ালা ফার্স্ট ক্লাস, গুমোট সেকেন্ড ক্লাস পছন্দ নয় হয়তো। তবু সে তো ওপরচালাকি করেনি। উপমহাদেশীয় পদ্ধতিতে হলেও, সবার কথা সে তো ভেবেছে!
সেই ট্রামকে নাকি আমরা তুলে দিতে চাইছি?

More Articles