মজেছিলেন আকবর থেকে রানি ভিক্টোরিয়া! খিচুড়ির অবাক করা ইতিহাস আজও অজানাই

Origin of Khichdi: ফজল প্রতিদিন ৩০ মণ খিচুড়ি রান্না করতেন। তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া যে কেউ নাকি চাইলেই সেই খিচুড়ি খেতে পারতেন।

মুগ ডাল ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করা হয়, তারপর মাখন দিয়ে খাওয়া হয়। তারা একে কিশরী বলে এবং প্রতিদিন প্রাতঃরাশে খায়।

১৪ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরতে এলেন মরক্কোর পণ্ডিত এবং পর্যটক ইবন বতুতা, ভারতে এসে প্রথম খিচুড়ি খান তিনি। সেই খিচুড়ির স্বাদ ঠিক কেমন, বা খিচুড়ি আসলে কী, সেই সম্পর্কেই উপরের ওই দু'লাইন লিখেছিলেন ইবন বতুতা। এর প্রায় একশো বছর পরে, ১৪৬৯ সালে রাশিয়ার বণিক এবং ভারতে ভ্রমণকারী প্রথম ইউরোপীয়দের অন্যতম আফানাসি নিকিতিন, তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে লিখলেন কীভাবে ঘোড়াদের চিনি এবং ঘি দিয়ে তৈরি ভাতের একটি ভারতীয় পদ ডাল এবং খিচুড়ি খাওয়ানো হয়েছিল। পরবর্তীতে, ১৬০০-এর দশকে, ফরাসি পর্যটক জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার ছ'বার ভারতে আসেন এবং সবুজ মসুর ডাল, চাল এবং ঘি দিয়ে খিচুড়ি তৈরির বিষয়টিকে লক্ষ্য করেন। তিনি তাঁর লেখায় খিচুড়িকে 'কৃষকের সন্ধ্যার খাবার' হিসেবে উল্লেখ করেন। এর আরও ঢের ঢের আগে ৩০৫-৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে যুদ্ধের সময়, গ্রিক রাজা সেলুকাসও উল্লেখ করেছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ডাল আর ভাত একসঙ্গে সেদ্ধ করে একটি খাবার খেতেন।

কত শতাব্দী ধরে যে ভারতের মানুষ খিচুড়ির স্বাদে মজে রয়েছে নিশ্চিত করে বলাই দায়। ভারতে খিচুড়ির প্রাচীনতম নিদর্শনের বয়সই প্রায় ২০০০ বছর। ২০১৫ সালে মহারাষ্ট্রের তের অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় দু'টি বিশাল পাত্র মেলে। সেখানে ভাত আর মুগডাল একসঙ্গে পোড়া অবস্থায় মেলে। তারপর থেকে খিচুড়ির মাহাত্ম্য যে কোন কোন আঙিনা ছুঁয়েছে সংস্কৃতির, গুণে বলা মুশকিল। ভোগের খিচুড়ি, পথ্য খিচুড়ি, ইলিশ ভাজার সঙ্গে বর্ষাকালীন খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, ডিমভাজা, আলুভাজা দিয়ে খিচুড়ি- বাংলার বাড়িতে বাড়িতে বৃষ্টির অন্য নামই খিচুড়ি!

আরও পড়ুন- অম্বুবাচীর বিকেলে খিচুড়ি আর মাছের চচ্চড়ির গন্ধ

খিচুড়ি শব্দটি এল কীভাবে? সংস্কৃত শব্দ 'খিচা' থেকে এসেছে খিচুড়ি শব্দটি। চাল এবং ডাল দিয়ে রান্না করা একটি আদ্যোপান্ত ভারতীয় খাবার। খিচুড়িতে মূলত মুসুর ডাল ব্যবহার করা হয়, মুগ ডালও বেশ জনপ্রিয়। ভারত জুড়ে খিচুড়ির বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের দেখা মেলে। যে অঞ্চলের মূল খাদ্যশস্য যা, তা দিয়েই তৈরি হয় খিচুড়ি, যেমন বাজরা খিচুড়ি।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পদ 'কেডগেরি’-র নেপথ্যে রয়েছে খাঁটি ভারতীয় খাবার খিচুড়ি। কেডগেরি এক জনপ্রিয় ব্রিটিশ পদ। এই খাবারে রান্না করা, শুকনো মাছ (ঐতিহ্য মেনে রান্না করতে গেলে স্মোকড হ্যাডক ছাড়া চলবেই না), সেদ্ধ চাল, পার্সলে, ভালো করে সেদ্ধ করা ডিম, কারি পাউডার, মাখন বা ক্রিম এবং মাঝে মাঝে সুলতানাও (বীজহীন আঙুর) দেওয়া হয়ে থাকে।

১৭৯০ সালে স্টিফেনা ম্যালকমের লেখা একটি বইতে কেডগেরির এক স্কটিশ রেসিপির উল্লেখ মেলে। সেই রান্নায় আবার লাল লঙ্কার ব্যবহার উল্লিখিত হয়েছে। খাদ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা এবং তাদের আত্মীয়রা খিচুড়ি পদটিকে নিজেদের দেশে নিয়ে আসেন।

মহাভারতে খিচুড়ির বিশদ উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব নবম এবং অষ্টম শতাব্দীতে খিচুড়ির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যেতে পারে। বনবাসের সময় দ্রৌপদী পাণ্ডবদের খিচুড়ি খাওয়াতেন বলে জানা যায়। সুদামার কাহিনিতেও খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু সুদামা দ্বারকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। সঙ্গে ছিল দুই পুঁটুলি। একটি পুঁটুলিতে ছিল খিচুড়ি এবং অন্যটিতে ছোলা ভাজা। পথমধ্যে খিচুড়ির পুঁটুলিটি ছিনিয়ে নেয় এক বাঁদর। ছোলা ভাজার পুঁটুলিটি কোনওমতে বাঁচিয়ে সুদামা যান সখার সঙ্গে দেখা করতে। দ্বারকায় কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হলে দু'জনে মিলে শেষ পর্যন্ত ছোলা ভাজা খান।

মুঘল সাম্রাজ্যের সময় খিচুড়ি বেশ বিখ্যাত পদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আকবর খুব সামান্য পরিমাণে খেতেন, কিন্তু খেতে ভালোবাসতেন। জানা যায়, আকবরের অন্যতম পছন্দের খাবার ছিল খিচুড়ি। আকবরের দরবারি আবুল ফজলকে ঘিরে খিচুড়ির এক দুর্দান্ত গল্প রয়েছে। ফজল প্রতিদিন ৩০ মণ খিচুড়ি রান্না করতেন। তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া যে কেউ নাকি চাইলেই সেই খিচুড়ি খেতে পারতেন। এক মণ মানে হচ্ছে ৪০ সের, আনুমানিক ৪০ কেজি। তাহলে ৩০ মণ সমান হচ্ছে ১,২০০ কেজি! রোজ ১,২০০ কেজি খিচুড়ি! রোজ!

আরও পড়ুন- বেহুলা থেকে রোহিঙ্গা, মাছে-ভাতে বাঙালিকে ভারত অবহেলা করতে শিখল কবে?

সম্রাট জাহাঙ্গিরের পছন্দের খাবার ছিল লাজিজান। লাজিজান হচ্ছে খিচুড়ির এক গুজরাতি সংস্করণ। আওরঙ্গজেবও এই লাজিজান বেশ পছন্দ করতেন। বিশেষ করে রমজানের সময় সম্রাটদের খিচুড়িই ছিল নির্ভরযোগ্য খাবার। বাহাদুর শাহ জাফর মুগ ডালের খিচুড়ি খেতে এত পছন্দ করতেন যে ডালটি পরে 'বাদশা পাসন্দ' নামে পরিচিত হয়ে যায়।

১৮২৭ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত অওধের নবাব নাসির-উদ্দিন শাহ, তাঁর রাঁধুনির তৈরি একটি রাজকীয় খিচুড়ি দুর্দান্ত পছন্দ করতেন। পেস্তা এবং বাদাম কুচিয়ে ফেলা হতো মুসুর ডাল এবং চালের দানার আকারে। তারপর সেই পেস্তা আর বাদাম দিতে তৈরি হতো খিচুড়ি।

রানি ভিক্টোরিয়ার আমলেও খিচুড়ি ছিল বিশেষ এক পদ। রানির উর্দু গৃহশিক্ষক মুন্সি আব্দুল করিম প্রথম ভিক্টোরিয়াকে খিচুড়ি খাওয়ান। চালের সঙ্গে মুসুর ডাল পছন্দ করতেন তিনি। সেই কারণেই ডালটি 'মালিকা মসুর' নামে পরিচিতি লাভ করে।

ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের খিচুড়ি ভিন্ন ভিন্ন। বাঙালিদের খিচুড়ি হোক বা, কন্নড়ভাষীদের বিসি বেলে ভাত, তামিলদের পোঙ্গাল, হরিয়ানার হরিয়ানভি খিচড়ি (বাজরা দিয়ে তৈরি), পার্সি ভারুচি বাঘরেলি খিচড়ি এবং ওড়িয়াদের আদাহেঙ্গু খেচড়ি- নাম বিবিধ হলেও সবকটিই আসলে ভারতের প্রাচীনতম খাবার খিচুড়ি, যার গায়ে ঘিয়ের মতোই মিশে আছে ইতিহাসের গন্ধ।

More Articles