বাঁচতে হলে দালালই ভরসা! নেতাজি হীন বিশ্বে যা পেল ভারতীয়রা...

Middlemen of India: একটা সময় কলকাতার বন্দরে যখন ব্রিটিশ জাহাজ আসতো, তখন থেকেই মধ্যসত্ত্বভোগী মানুষদের উদয়।

"দালাল দালালি করে, নেতা নেতাগিরি, ট্রেনে ট্রেনে গান গায় বাউল ভিখিরি, মানুষ ভরসা খোঁজে দিনে আর রাতে, ছেলেমেয়েগুলো যেন থাকে দুধে ভাতে"

এই গান তো কবেই গেয়েছিলেন কবীর সুমন। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেও যা ছিল, আজও তাই। ছেলেমেয়েদের দুধে-ভাতে রাখতে গিয়ে, কোনটা ভেজাল দুধ আর কোনটা আসল, তা চিনতে গেলেই আমরা দালালদের খুঁজে পাব। দুধে জল না জলে দুধ সেই খোঁজ করতে গেলে আরও সমস্যায় পড়ব। বিষয়টা হয়তো মজার মনে হতেও পারে কারও কারও কাছে, কিন্তু সমস্যার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। একজন উৎপাদক এবং একজন উপভোক্তার মাঝখানের অংশটিকেই চালু ভাষায় দালাল বলে। এই দালালচক্রের মাধ্যমে দুটো ঘটনা ঘটে। এক, উৎপাদক তাঁর উৎপাদনের দাম বাড়াতে বাধ্য হন আর দুই, উপভোক্তা বেশি দাম দিয়ে সেই উৎপাদন কিনতে বাধ্য হন।

এই দালালচক্রের একটা রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। শিকড় খুঁজতে খুঁজতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে পৌঁছলে আজকের কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজনৈতিক গুরু সাভারকারের নাম সবার আগে আসবে। যে সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী তুমুল আন্দোলন হচ্ছে সেই সময়ে ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন সাভারকার। সেই মুচলেকার ফলে আজও সাভারকারকে ব্রিটিশদের দালাল বলেই ডাকেন বিরোধীরা। সেই বদনাম ঘোচাতে এখন কীভাবে ইতিহাস বদল করা যায় সেই চিন্তাভাবনাও করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসকদলকে। কীভাবে সাভারকারের নামের আগে ‘বীর’ বসিয়ে পরের প্রজন্মের কাছে
তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে দেখানো যায়, সেই চিন্তাও করছে কেন্দ্রীয় শাসকদল।

আরও পড়ুন- জোশীমঠ নিয়ে মিডিয়াকে কোনও তথ্য না! কোন রহস্য ধামাচাপা দিতে চাইছে সরকার?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অনেকে বলতেন 'দালাল'। তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, আগামী দিনেও হবে। কিন্তু নেতাজি যে আদ্যন্ত একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মুসোলিনির সাহায্য নিতেও দ্বিধা করেননি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র বসুকে এক চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন,

"যদি আমার বলশেভিক এজেন্ট হইবার ইচ্ছা থাকিত, তবে আমি ... প্রথম জাহাজেই ইউরোপ যাত্রা করিতাম। তথায় স্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্তির পর বলশেভিক দলে মিশিয়া সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার উদ্দেশ্যে প্যারিস হইতে লেনিনগ্রাড পর্যন্ত ছুটাছুটি করিতাম; কিন্তু আমার সেরূপ কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নাই।"

তবে নেতাজিকে কীসের দালাল বলা যায় ঠিক? এ তো গেল দালালির রাজনৈতিক খণ্ড ইতিহাস কিন্তু দালালির এক বিপুল সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসও আছে। যে সমস্ত মানুষ কোনওদিনই উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেননি, তাঁরাই যখন দীর্ঘদিন ধরে সমস্ত ধরনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন, তাঁদেরকেই হয়তো দালাল বলে চিহ্নিত করা যায়। একটা সময় কলকাতার বন্দরে যখন ব্রিটিশ জাহাজ আসতো, তখন থেকেই মধ্যসত্ত্বভোগী মানুষদের উদয়। তাঁরা একদিকে ব্রিটিশদের থেকে পুরো জাহাজ সমেত মালপত্র কিনে দেশের বাজারে, বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে বেচতেন কাট মানি বা কমিশন নিয়ে, আবার অন্যদিকে দেশের বাজার থেকে কাঁচামাল কম দামে নিয়ে ব্রিটিশদের বেচতেন। ফলে দুই তরফ থেকেই লাভ হতো। কাটমানি বা কমিশন নেওয়ার ইতিহাস ঘাঁটলে, দেখা যাবে এই শ্রেণির মানুষরাই ধীরে ধীরে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। এঁরাই কিন্তু কলকাতা শহরের বুকে ফিটন গাড়ি চড়ে ঘুরতেন, এঁরাই কলকাতার বাবু। এই মানুষরা বুঝতে পেরেছিলেন, সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে কিছু অর্থনৈতিক লগ্নিও করতে হয়। তাই তাঁরা এই আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন।

ইতিহাস ছেড়ে যদি আজকের সময়ে আমাদের রাজ্যের দিকেও তাকানো যায়, তাহলে বলা যায় প্রতিদিনকার জীবনে রোজ আমরা দালালদের সঙ্গেই ঘর করি। সাধারণ মানুদের অভিজ্ঞতা কী বলে? জন্মের শংসাপত্র পাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর শংসাপত্র- সামান্য ন্যায্য পেতে আমাদের যে রোজদিন হয়রান হতে হয়, তাও তো এই ছোটখাট দালালদের কারণেই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা বা আবাস সবেতেই দালালদের দেখা পাওয়া যায়। অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, দালালরাজ যে কোনও সরকারের আমলেই ছিল, থাকেও। সরকারি হাসপাতালে শয্যা পেতে গেলে বেশ কিছু মানুষের শরণাপন্ন হতে হতো। কোনওদিনই কোনও কাজ সরাসরি হতো না। যাঁর প্রয়োজন তিনি হকের জিনিস পেতেন না, আজও ঘটনা হয়তো সেই একই। কিন্তু ইদানীং দালালচক্র রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আছে, তাই এখন শয্যা পেতে গেলে সরকারের নেতা মন্ত্রীদের ধরতে হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। চাকরি দেওয়ার নাম করে যেভাবে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রেও বারংবার এই দালালচক্র এবং তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে ক্রমশ আরও সম্পদের অধিকারী হয়েছেন, তার সঙ্গে ইতিহাসের দালালদের উত্থানের খুব কি পার্থক্য আছে? সবই আজ মান্যতা পেয়ে গেছে। বাড়ি তৈরি করতে গেলে অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীর তৈরি করা সিন্ডিকেটই ভরসা! সেই সিন্ডিকেটের লভ্যাংশ কোথায় যায়, উত্তর খুব অজানা নয়। আর এর ফলে বাড়ি তৈরির খরচও বেড়েছে স্বাভাবিকভাবেই, তাও অস্বীকার করা যায় না।

যাতে সকলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সেই দালালচক্র থেকে তাহলে কি আর কোনওদিনই মুক্তি মিলবে? অনেকেই বলতে পারেন, একমাত্র একজন কঠোর শাসক এলেই হয়তো এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। এই মুহূর্তে একমাত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীই সবটা সামলাতে পারবেন কিন্তু তিনিও কি চান আদৌ দালালদের থেকে মুক্তি পেতে? নাকি তার বদলে দালালদের সামাজিক মর্যাদা দিয়ে উপরে তুলে নিয়ে আসতে চান যাতে ধীরে ধীরে মানুষ দালালদেরই পুঁজিপতি বলে ভাবতে শুরু করেন। আজকের কেন্দ্রীয় শাসকদলের প্রধানের যে দু’জন অন্তরঙ্গ বন্ধু আছেন, তাঁদের মধ্যেও কি এই প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায় না? তাঁদের একজন সরাসরি সমস্ত বন্দর এবং বিমানবন্দরের দখল নিতে চাইছেন যাতে তাঁর এই ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হয়। তিনি এবং তাঁর মতো কিছু মানুষ যাতে অর্থনৈতিকভাবে আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে পারেন সেই জন্যে অনেক সময়ই নানান রঙের সরকার তাঁদের সহায়তাও করেন। ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বেশিরভাগটাই এই মধ্যসত্ত্বভোগী মানুষদের দখলে চলে যাচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছেন সেই সব জায়গার মানুষরা, ধ্বংস হচ্ছে সমস্ত পরিবেশ, দেশ ভরে যাচ্ছে দালালরাজে যাঁদের গালভরা নাম- পুঁজিপতি। কালে কালে দেখা যেতেও পারে পুঁজিপতিরাই বকলমে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের নিয়মই নিয়ম, তাঁদের আইনই আইন। তাঁরাই সংবাদ মাধ্যম কিনছেন, তাঁরাই সংবাদ পরিবেশন করছেন, তাঁদের মতামতটাই প্রধান। দালালদের উলম্ফন ঘটবে, দালালরাই হয়ে উঠবেন আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা।

আরও পড়ুন-২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা

যে সংবাদমাধ্যম একসময় ছিল গণতন্ত্রের অন্যতম এক স্তম্ভ, সেই সংবাদমাধ্যম আজ এতটাই নুয়ে পড়েছে শাসক এবং কর্পোরেটের কাছে যে ভুল চিকিৎসা বা ভুল অস্ত্রোপচার হয়ে মানুষ পঙ্গু হয়ে গেলেও সেটাকে নিয়ে খবর হয় না। সম্প্রতিই বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখিকাকে যখন জোর করে কিছু চিকিৎসক সাধারণ চিকিৎসার বদলে জটিল অস্ত্রোপচারে বাধ্য করেন তখন সেই খবর আমাদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে না। আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। প্রতিদিন চিকিৎসকদের এই ধরনের আচরণ আমরা দেখি, প্রয়োজন না থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে আমরা বাধ্য হই এবং শিকার হই এই ধরনের চিকিৎসকদের। মুখে সেবার বাণী ফুটলেও আদপে চিকিৎসকদের বড় একটা অংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলিরই দালালি করে চলেন।

তবে এই দালালচক্রের বিরুদ্ধেই নানা সময়ে দেশে নানা আন্দোলনও হয়েছে, যার কথা না লিখলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর অন্যতম হলো সাম্প্রতিক সময়ের কৃষক আন্দোলন। কৃষকরা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, যে নতুন তিনটি কৃষি আইন আনা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে, সেই কৃষি আইন দেখে হয়তো মনে হতেও পারে আঞ্চলিক স্তরের দালালদের থেকে মুক্তি মিলবে কিন্তু আসলে এই আইন লাগু হলে আরও বড় দালালদের হাতে নিষ্পেষিত হবেন কৃষকরা। ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স বা আদানিরা হয়ে উঠবেন তাঁদের মালিক। ছোট ছোট দালালদের সঙ্গে তাও কথাবার্তা চালানো সম্ভব কিন্তু সরকার যদি এই বড় দালালদের বলেন, সরাসরি কৃষকের থেকে তাঁদের উৎপাদন কিনতে তাহলে ভরাডুবি অচিরেই হবে খেটে খাওয়াদের। তাই রাস্তায় বসে পড়েছিলেন কৃষকরা। সরকার বাধ্য হয়েছিল কৃষি বিল ফেরত নিতে।

অনেক সময়ে, পুরো জাহাজে আগুন লাগতে হয় না, কোনও এক জায়গায় আগুন লাগলেই তা থেকে যে ধোঁয়া বেরোয় তাই যথেষ্ট যে কোনও বিদ্রোহের জন্য। সেই ধোঁয়া মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে ইদানীং। তাহলে এখনও কেন দেশে বা রাজ্যে দালালরাজ বন্ধ করার আওয়াজ উঠছে না? এখনও আসলে কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন, সবাই অসৎ নয় এবং সৎ মানুষের সংখ্যা কম হলেও তাঁরাই প্রশাসনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। কিন্তু, কতদিন?

More Articles