২৪ জন কর্মী নিয়ে নিট-নেটের মতো পরীক্ষা পরিচালনা! NTA-এর ভয়াবহ গাফিলতি ফাঁস
National Testing Agency: ২০১৮ সালে মোদি সরকার এই স্বশাসিত সংস্থাটি তৈরি করে তাদের হাতেই দেশের সব কটি বড় পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। দেশের প্রায় ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে।
ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় একাধিক অনিয়মের অভিযোগ। এমনকী স্থগিত হয়ে গিয়েছে NEET-র নতুন পরীক্ষাও। পরীক্ষার ঠিক এক দিনের মাথায় অস্বচ্ছতার অভিযোগে খারিজ নেট পরীক্ষাও। যার মাধ্যমে কলেজের সহকারী অধ্যাপক, জুনিয়ার রিসার্চ ফেলো ও পিএইচডি করার যোগ্যতা পাওয়া যায়। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিয়ে এভাবে প্রশ্ন উঠে যাওয়ায় কথা উঠেছে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি তথা NTA-র ভূমিকা নিয়েও। NEET-অনিয়ম নিয়ে ইতিমধ্যেই জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সেখানেও একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে NTA-র ভূমিকা নিয়ে।
২০১৮ সালে মোদি সরকার এই স্বশাসিত সংস্থাটি তৈরি করে তাদের হাতেই দেশের সব কটি বড় পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। দেশের প্রায় ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে। ক্ষমতাসীন মোদি সরকার যেভাবে এক দেশ এক ভোটের কথা বলেন বারবার, সেভাবেই একই সংস্থার হাতে সমস্ত জরুরি পরীক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গোটা বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্যাধীন রাখাই ছিল এই স্বশাসিত সংস্থাটি তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার, দেশের পঁচিশটিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পরিচালনার গুরুদায়িত্ব যাদের কাঁধে, সেই NTA-তে ২৫ জনও স্থায়ী কর্মী নেই। শিক্ষাজগতের বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, পরীক্ষা নিয়ে আসলে একধরনের জুয়ো খেলেছে কেন্দ্রে। তাঁদের মতে, NTA-র ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি গুরুদায়িত্ব তাঁদের কাঁধে ফেলে দিয়েছে কেন্দ্র।
আরও পড়ুন: সিসিটিভি-তে ফাঁক থেকে অরক্ষিত স্ট্রং রুম! NEET-এর নামে সামনে আসছে ছেলেমানুষী
এমনকী শিক্ষাবিষয়ক কোনও বিশেষজ্ঞ সদস্য নেই NTA-তে। প্রশ্নপত্র সাজানো থেকে শুরু করে সেসব বিতরণ, সব কিছুই তারা করে বাইরের কর্মীদের দিয়ে। এমনকী ডেটা সিকিওরিটি প্রোটোকলের জন্যও তারা বাইরের বিশেষজ্ঞদের উপরেই নির্ভরশীল। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক জোড়া পরীক্ষা বিপর্যয়কে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যে দুটি পরীক্ষা পরিচালনার ভারই ছিল NTA-র উপরে।
স্নাতক স্তরে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা তথা NEET-এ প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে ভুল প্রশ্নপত্র বিলি, এমনকী যান্ত্রিক বিপর্যয়ে পরীক্ষার্থীরা বহু ক্ষেত্রেই পূর্ণ সময় পরীক্ষা দিতে পারেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যেই বিহারে গ্রেফতার হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র। পুলিশি জেরায় তারা স্বীকার করেছে, কীভাবে ৩০-৩২ লক্ষ টাকায় একেকজন পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নপত্র বিক্রি করত তাঁরা। মধ্যিখানে ফঁড়েরা এসে লুটে নিত আর দশ-বিশ লাখ টাকা। একই ভাবে নেট পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। যে কারণে পরীক্ষার ঠিক এক দিনের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায় ২০২৪ সালের নেট পরীক্ষা। NEET পরীক্ষার দুর্নীতি কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গত মে মাসে হওয়া ওই পরীক্ষায় ফলাফল বেরোয় গত ৪ জুন। সেই পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পরীক্ষা পুরো সময় দিতে পারেননি প্রায় ১৫৬৩ জন পরীক্ষার্থী। তাঁদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল NTA। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দায়ের হয় সুপ্রিম কোর্টে মামলাও। এর পরে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে NTA। তার পরিবর্তে ওই ১৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীর নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই পরীক্ষা ছিল গত ২৩ জুন, রবিবার। কিন্তু শেষমুহূর্তে স্থগিত হয়ে যায় সেই পরীক্ষাও। ফের কবে সেই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
এই NTA-র হাতেই রয়েছে JEE-মেইন, ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য কমন ম্য়ানেজমেন্ট অ্যাডমিশন টেস্ট, এমনকী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যায়গুলির সাধারণ কোর্সে ভর্তির জন্য কমন ইউনিভার্সিটি এনট্র্যান্স পরীক্ষা পরিচালনার ভারও। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রাক্তন সচিব আর সুব্রহ্মণ্যর মতে, সংস্থাটিকে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে পেশাদার এবং যথেষ্ট দক্ষ হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আদতে কি তেমনটা হয়েছে?
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে NTA সংস্থাটিকে তৈরি করা হয়েছিল মার্কিন সংস্থা এডুকেশন টেস্টিং সার্ভিস (ETS)-এর অনুকরণে। যারা স্কলাস্টিক অ্যাপটিটিউড টেস্ট এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাডুয়েট রেকর্ড পরীক্ষাগুলি পরিচালনা করবে। কিন্তু মার্কিন সংস্থা ETS-এর কর্মী সংখ্যা দুশোরও বেশি। আর সেখানে NTA-তে কাজ করেন হাতে গোনা জনা পঁচিশেক কর্মী। যাদের আবার তুলে আনা হয়েছে অন্যান্য সরকারি দফতর থেকে ডেপুটেশনে। আর রয়েছে চুক্তিভিত্তিক কিছু অস্থায়ী কর্মী। তাদের দিয়েই চলছে এই বিশাল কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে প্রশ্নপত্র এনক্রিপশন ও ডিক্রিপশনের কাজ করানো হয়। শুরুর দিকে, NTA-র অংশীদার সংস্থা ছিল টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস। প্রাথমিক ভাবে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সংস্থাটি শুরু হলেও পরবর্তীকালে শুধু অনলাইন পরীক্ষা নয়, অফলাইন লিখিত পরীক্ষাগুলির ক্ষেত্রে বেসরকারি কয়েকটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজটি করিয়ে থাকে NTA। যেখান থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
আরও পড়ুন: ৩০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে NEET প্রশ্ন! গ্রেফতারের পর কবুল মূল চক্রীর
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্র সরকার NTA সংস্থার মাধ্যমে গোটা দেশের পরীক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে জুয়ো খেলছে। অবিলম্বে সংস্থাটিকে ভেঙে দেওয়ারও দাবি করেছেন অনেকে। একই সঙ্গে এই গাফিলতির দায় সরকার এড়াতে পারে না বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। যতই শিক্ষামন্ত্রক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা বলে সংস্থা বা সংস্থার ব্যক্তিবিশেষের দায় চাপাতে চাক, এ ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। শনিবার NTA-র ডিরেক্টর-জেনারেলকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। গোটা গাফিলতি খতিয়ে দেখার কাজও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই।