প্রতিটা রাত হোক নারী-পুরুষের সমান সমান

Gender Equality and Patriarchal Society: এই যে পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন, পৌরুষের দম্ভ যা আসলে আমাদের শিকড়ে, মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে সমাজ, এ তো একদিনের অর্জন নয় কেবল। ফলে এর থেকে মুক্তিও একদিনে সম্ভব নয়।

সেই কবে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়েছিল মানুষ। তার পর থেকে মুঠোয় বাঁচল শুধুই লিঙ্গপরিচয়। তার পর ক্রমে সভ্য হল সে। পাতার পোশাক ক্রমে কাপড়ের, আগুন জ্বালাতে শেখা, চাকার ব্যবহার। ক্রমে আরও উন্নততর হল অস্ত্র, হাতিয়ার। সভ্যতার মশাল হাতে এর পর অফুরন্ত পথ হাঁটা। একের পর এক মাইলফলক পেরিয়ে সভ্যতর, উন্নততর হল তার যাত্রা। বাকি সমস্ত প্রাণীদের তুলনায় বুদ্ধিমানতর জীব হিসেবে এক অদৃশ্য মুকুট মাথায় চড়িয়ে যাবতীয় কিছু জয় করার এক ভয়ঙ্কর নেশা চেপে বসল মগজে। শুধু হল না তার রিপুজয়ী হওয়া। তাই যৌনতার মতো সাধারণ প্রবৃত্তির শরীরে লেগে রইল রিপুর আঠালো বিষ। ক্ষমতার আস্ফালনকে কীভাবে যৌনতার মোড়কে জড়িয়ে বিপজ্জনক হাতিয়ারে পরিণত করা যায়, তার রেসিপি ক্রোমোজোম, ডিএনএ বয়ে বেড়াল চিরকাল। বাঘ সুযোগ বুঝে টুঁটি চেপে ধরতে চায় হরিণের, হাতিকে সে পারদপক্ষে ঘাঁটায় না। কারণ হাতি যে তার চেয়ে ঢের গুণ শক্তিশালী, তা সে হাড়ে-মজ্জায় জানে। মানুষ নামক উন্নততর প্রাণীটির অন্দরেও কোথাও থেকে গিয়েছে সেই শক্তিশালী-দুর্বলের অকৃত্রিম পাঠ। ফলে নিজের চেয়ে দুর্বলতরকে শাসন ও শোষণের মধ্যে যে ক্ষত্রিয় আহ্লাদ আছে, তা-ও সম্ভবত তার জন্মগত অর্জন।

মানুষ সমাজবদ্ধ হওয়ার তাড়নায় একদিন দল গড়েছে, গোষ্ঠী গড়েছে। কাঁটাতার দিয়ে ভাগ করে নিয়েছে আপন আপন মানচিত্র। দেশ, জাতি নানা নাম দিয়ে সে ক্রমে ঢুকে পড়েছে একের পর এক লেবেলের নীচে। যা তাঁকে নিরাপত্তা দিয়েছে, সহমতের বন্ধু দিয়েছে, ভিন্নমতকে শত্রু বানাতেও শিখিয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত ভাগাভাগির উপরে যে প্রকৃতিগত বিভাজনকে সে ব্রহ্মজ্ঞানে জাগিয়ে রেখেছে, তা সম্ভবত লিঙ্গবৈষম্য। সবার উপরে লিঙ্গ সত্য, এই ধারণাকে অন্তরের অন্তঃস্থলে সযত্নে লালিত করে এসেছে সে আজীবন, যত্ন করে প্রোথিত করেছে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের ডিএনএ-তে। অগত্যা সেই স্ত্রী-পুরুষের ভাগাভাগি থেকে মুক্তি নেই। তবে সভ্যতার হাওয়ায় তার উপর সজ্জিত পর্দা টাঙাতে সে শিখেছে ঠিকই। সাম্যবাদের তত্ত্বে ভর করে সে নারীকে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছে, সমাজবিপ্লবের পথে নারীমুক্তিই যে অন্যতম সোপান- এ সব বীরবাক্য মনে করে গর্বে ছাতি ছত্রিশ ইঞ্চি হয়েছে তার, আর শেষমেশ বাড়ি ফিরে অধিকৃত নারীটির শরীরে-আত্মায় বল,বাক্য দিয়ে কায়েম করেছে সে পুরুষতন্ত্রকে। এ তো গেল আম জিন্দেগি।

এর পরে আসে সেই সব আলফা মেল তথা পুরুষোত্তমদের কথা। যারা শীতের রাতে দিল্লির বাসে, বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় কিংবা আরজি কর কলেজের জরুরি বিভাগে রাত জাগা তরুণী চিকিৎসকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্দ্বিধায়। অসীম বলে শরীর ছিঁড়েখুড়ে দুর্বলকে বুঝিয়ে দেয় ক্ষমতাবানের 'সবক'। না, এর সঙ্গে সাধারণ যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলবেন না দোহাই। এই সব পুরুষোত্তমদের ঘাড়ে আরও বড় গুরুদায়িত্ব। দুর্বল নারীসত্তাকে নিজের বাউন্ডারি বুঝিয়ে দেওয়ার, পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতার পাল্লা অনুভব করানোর যে ভয়ঙ্কর বোঝা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখেছে সমাজ, তার ভার নেহাৎ কম নয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড লিবিডোর কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন মর্ষকাম ও ধর্ষকামের কথা। কেন জানি মনে হয়, একে অপরের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ভাবে জড়িত এই দুই শব্দ। ধর্ষকামের পথে পৌঁছে দেওয়ার কানাগলি যেন এই মর্ষকাম। আসলে সমাজ সেই নির্যাতনের বীজ যুগ যুগ ধরে পুঁতে দিয়েছে আমাদের মর্মে-মজ্জায়।

আরও পড়ুন: দ্রৌপদী থেকে নির্ভয়া, ‘সবক’ শেখাতেই ধর্ষণ আজও

দ্যূতসভায় নির্দ্বিধায় স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি রাখলেন জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠির, এমনকী হারবেন জেনেও। তার আগে তিনি নিজেকে হেরেছেন, ভাইদের হেরেছেন, শেষে কৌরবদের ভরা সভায় হারলেন স্ত্রীকেও। দ্রৌপদী প্রশ্ন করেছিলেন, কোন সত্ত্বে তাঁকে বাজি ধরে বসলেন ধর্মপুত্র? আসলে সেই প্রশ্নের উত্তর প্রোথিত ছিল বোধহয় অতীতে। যেদিন পাঞ্চালকন্যা দ্রৌপদীকে স্বয়ম্বর সভায় জিতে ঘরে ফিরলেন অর্জুন। প্রথম দেখাতেই অর্জুনকে মন দিয়েছিলেন দ্রৌপদী। অথচ কুন্তি অবলীলায় পঞ্চপাণ্ডবকে আদেশ দিলেন, দ্রৌপদীকে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে। এক মুহূর্তে পণ্যে পরিণত হল রাজার কন্যা। দ্রৌপদীর কুরুসভায় অপমানিত হওয়ার ললাটলিখন কি সেদিনই লেখা হয়ে যায়নি! পুরুষতন্ত্রের সেই ভয়াল ধ্বজাখানাকে নির্লজ্জ ভাবে তুলে ধরলেন যিনি, তিনি কিন্তু কোনও পুরুষ নন। তিনি কুন্তী, মহাভারতের এক মহিয়সী নারী, রত্নগর্ভা সর্বোপরী স্বাধীনতম এক মহিলা।

গল্পে, উপন্যাসে, সংসারে বারবার পুরুষতন্ত্রের বাহক এবং নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে দেখেছি এমনই অজস্র নারীকে। যাঁরা বারবার বেঁধে দিতে চেয়েছেন সংসারে মেয়েদের গণ্ডি। করণীয়-অলঙ্ঘনীয়ের পাঠ দিয়েছেন বড় কঠিন উপায়ে। আসলে এ শিক্ষা যে তিনি বা তাঁরা শুধুই বাড়ির মেয়েদের দিয়েছেন, তা নয়। দিয়েছেন সংসারের সেই সব ছেলেদেরও, হাতে তুলে দিয়েছেন সেই অদৃশ্য চাবুক, যা বেড়া ডিঙোলেই 'সবক'শেখাতে শিখেছে ঘর থেকে, পরিবার থেকেই। যে পাঠ তাদের শিখিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের আগে খেতে নেই, মেয়েদের রাতে বেরোতে নেই, জোরে কথা বলতে নেই, প্রশ্ন করতে নেই, বোরখা কিংবা ঘোমটার আড়ালই যে মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত এবং নিরাপদতম স্থান, তা ঢুকিয়ে দিয়েছে মগজে-মাথায়। কিন্তু কে বেঁধে দিল এই নিরাপত্তার মাপকাঠি? পোশাকে ঢাকা শরীর মানেই যে নিরাপদ নয়, তা কি আমরা এখনও জেনে যাইনি!

Only equal representation of Men and women can bring equilibrium in Todays Society By Sohini Das Robibarer Royak

আসলে গলদ আমাদের শিকড়েই। গলদ নারীকে মহীয়সী করে তোলার ক্লান্তিকর চেষ্টায়- যা আসলে পুরুষের বানানো এক ছদ্মজগৎ, যা দেখে-শুনে-বুঝে যুগ যুগ ধরে আহ্লাদিত হতে শিখেছে নারীরা। ব্রহ্মার বরে অজেয় মহিষাসুর। তাঁর বিনাশ নেই কোনও পশু বা পুরুষের হাতে। ব্রহ্মা কি সেই বর দেওয়ার সময় বেমালুম ভুলেই গেলেন নারী নামক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক এনটিটি-র কথা! নাকি ছেড়ে রাখলেন সূক্ষ্ম লুপ হোল! মহিষাসুরও জানল, রণে নারীর তেমন কোনও ভূমিকা নেই। অগত্যা সে একরকমের অমরই। সে যাই হোক, সেই মহিষাসুরের বিনাশযজ্ঞে একজোট হলেন সমস্ত দেবতা (যারা কিনা পুরুষ)। তাঁদের তেজরশ্মি থেকে জন্ম নিলেন এক রণরঙ্গিনী দেবীমূর্তি। তাঁকে সাজানো হল দেবতাদেরই দান করা অস্ত্রে। এর মধ্যে আদ্যাশক্তি, মহাদেবীর নানাবিধ সাবটেক্সট থাকলেও মোটা চোখে যেটা দেখা গেল, পুরুষদের তেজ দিয়েই মনের মতো, প্রয়োজন মতো তৈরি করে দেওয়া হল এক নারীর ধারণা। যে নারীর পোশাক-আশাক, ধরণ-ধারণ, চলনবলন থেকে পেশা বা স্বাধীনতার অধিকারটুকুর নেপথ্যে অক্লেশে তৈরি করে দেওয়া গেল পুরুষতান্ত্রিক ভিত্তি।

সম্প্রতি বৈজ্ঞানিকদের একটি গবেষণায় ধরা পড়েছে, পুরুষের লিঙ্গনির্ধারক যে ক্রোমোজোম, সেই ওয়াই ক্রোমোজোম নাকি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে পুরুষের শরীরে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই নাকি পুরুষশূন্য হয়ে পড়বে দুনিয়া। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে গুজব ভেবে হাওয়ায় উড়িয়েছিলেন, তেমন ভাবেই এমন একটি গবেষণাকে হাওয়ায় ওড়াবে পুরুষ সমাজও। সস্তা রসিকতার জোয়ার উঠবে! কারণ বন্দে পুরুষোত্তমকে বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে, প্রবল শক্তিশালী পুরুষ এবং তাঁর পুরুষত্বের ভান্ডার এ ব্রহ্মাণ্ডে অফুরন্ত। সে যেন সাক্ষাৎ জাদুকরের ওয়াটার অব ইন্ডিয়া! কলসি থেকে জল পড়তেই থাকে। সেখানে বিজ্ঞান-গবেষণার ঠাঁই নেহাতই অশরীরি।

এই যে পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন, পৌরুষের দম্ভ যা আসলে আমাদের শিকড়ে, মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে সমাজ, এ তো একদিনের অর্জন নয় কেবল। ফলে এর থেকে মুক্তিও একদিনে আসা সম্ভব নয়। আসলে ধর্ষণ মানে যে কেবল যৌননির্যাতন বা লালসার চরিতার্থকরণ, তা নয়। এর প্রতিটা ধাপে ধাপে জড়িয়ে থাকে দুর্বলের প্রতি ক্ষমতাবানের এক প্রবল প্রতাপ প্রদর্শন। যে প্রতাপের শিক্ষা দিয়েছে আসলে তাঁর পরিবার, পরিবেশ। 'Why Men Rape: An Indian Undercover Investigation' নামক এই বইটি লিখতে গিয়ে তারা কৌশল ধর্ষকদের উপরে গবেষণা শুরু করেন। কার্যত নিজের পরিচয় গোপন করে তিনি ধর্ষকদের কাছে গিয়েছেন, মনস্তত্ত্বের কোন জায়গা থেকে এই ভয়ঙ্কর অপরাধ তারা করেছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন, ধর্ষকের আসলে কোনও বিশেষ চেহারা হয় না, ধরণ হয় না। আমাদের আশেপাশে থাকা আর পাঁচ জন মানুষের মতোই সেই সব অপরাধীরা। তারা জানাচ্ছেন, "ধর্ষণ বলতে আসলে কী বোঝায় তা নিয়ে এই লোকগুলোর কোনও আলাদা ধারণাই নেই। যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতি বলতে যে কী বোঝায়, সেটা তারা মোটেই জানে না।"

Only equal representation of Men and women can bring equilibrium in Todays Society By Sohini Das Robibarer Royak

আমেরিকার শেফিল্ড হ্যালাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজির সিনিয়র লেকচারার ডক্টর মধুমিতা পান্ডে। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর ধর্ষকদের উপর গবেষণা শুরু করেন মধুমিতা। এই গবেষণা করতে গিয়ে মধুমিতা জানিয়েছেন, " প্রত্যেকটি ঘটনার ধরণ হয়তো আলাদা। কিন্তু একটা অভিন্ন বিষয় প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আছে, সেটা হচ্ছে এরা সবাই মনে করে এটা যেন তাদের একটা অধিকার। এ থেকে যেটা বোঝা যায়, সেটা হলো, আমাদের সমাজে পুরুষেরা আসলে কতটা সুবিধাভোগী।" মধুমিতা এ-ও জানান, এই সব ধর্ষকদের ভিতরে তাঁদের এই ভয়ানক কাজের জন্য কোনও অপরাধবোধ নেই। বরং ধর্ষণের জন্য নারীকেই দোষারোপ করেছে তারা বারংবার।

তারা এবং মধুমিতা, দু'জনেই যে জায়গায় সহমত হয়েছেন, তা হল- বেশিরভাগ ধর্ষকই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে আগে থেকেই চিনত। কাজেই এটা পরিষ্কার,ধর্ষক আসলে যে কেউ হতে পারে। আমাদের আশপাশের যে কেউ। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সেই ধর্ষক বা যৌনহেনস্থাকারী আসলে নির্যাতিতার পরিবারের কিংবা ঘনিষ্ঠ কেউ। ফলে পরিবারের লোকজনও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের পুলিশি অভিযোগ জানাতে আগ্রহী হন না বহু ক্ষেত্রেই। আসলে এ দেশে বহু কাল ধরেই ক্ষমতা প্রদর্শন ও দুর্বলকে শোষণ ও সীমানা চিনিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে এসেছে ধর্ষণ। যে অস্ত্র বাল্যেই তাদের হাতে তুলে দিয়েছে পরিজন, পরিবার, সমাজ। অগত্যা এ চক্রব্যুহ থেকে অভিমন্যুর মুক্তি নেই।

সত্যিই কি নেই? সম্প্রতি 'সরকাটা' জ্বরে মজেছে সিনেমাপ্রেমীমহল। আরজি কর কাণ্ডের আবহে সেই ছবি চলেছে দ্বিগুণ রমরমিয়ে। 'স্ত্রী'-র প্রথম সিকুয়েলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীশক্তির যে জয়গানকে পরিস্ফুট করে তুলতে চেয়েছিলেন পরিচালক, তা 'স্ত্রী টু'- ছবিতে আরও প্রকট। এই ছবির ভিলেন সরকাটা, যে কিনা স্বাধীনচেতা নারী দেখলেই তুলে নিয়ে যায় নিজের ডেরায়। তা সেই সরকাটার ডেরায় এমন কেউ ঢুকতে পারবে, যে পুরুষও নয়, নারীও নয়। এখানে সহজেই তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে দেখানোর পথ খোলা ছিল পরিচালকের সামনে। কিন্তু সেই পথে হাঁটালেন না পরিচালক। বরং সামনে আনলেন এক অর্ধনারীশ্বরের ধারণা। দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে, তবে পুরুষতন্ত্রের বিলোপ তখনই সম্ভব, যখন নারী-পুরুষের সমপরিমাণ প্রতিনিধিত্ব মিলবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। সাম্যের ধারণাকে কোথাও ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন পরিচালক। যে সাম্যের কথা আগেই বলেছিলেন নজরুল—

"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। "

এই সাম্যের ধারণা যে সারসত্য, তা কি সমাজ জানে না! আলবাত জানে। 'মাত্রুভূমি'র মতো ছবি আমাদের দেখিয়েছে, সমাজে নারীর সংখ্যা কমলে কী ভয়ানক বিপদ ঘনিয়ে উঠতে পারে। একই ভাবে পুরুষের সংখ্যার ভারসাম্য কমাটাও আকাঙ্ক্ষিত নয় কোনওমতেও। তার পরেও আজও কন্যাভ্রুণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে লাগাতার। গ্রামে-গঞ্জে, এমনকী শহরাঞ্চলেও মেয়েদের অবাঞ্ছিত, অতিরিক্ত অনুভব করানোর মধ্যে যে এক চিরকালীন পুরুষত্বের প্রতাপ রয়েছে, তা আসলে ওই পিতৃতন্ত্রের দান। অথচ মানুষ কি সচেতন হয়নি? ঋতুস্রাবে ব্যবহৃত পণ্য়ের বিজ্ঞাপনে নীল-সবুজ রঙের বদলে লাল রং দেখার মতো সাবালক হয়েছে দর্শক। যৌনদৃশ্যে আর ক্ষেত থেকে উঠে আসতে হয় না সূর্যমুখী ফুলেদের। মানুষের শিরদাড়ায় প্রতিবাদ করার মতো জোর আজও আছে, তা প্রমাণ করে দিয়েছে আরজি কর কাণ্ড। কিন্তু সুবিচার বা শাস্তির দাবি, মোমবাতি মিছিল কিংবা কঠোর আইন আনার দাবি কি আদৌ কি বদলাতে পারবে ধর্ষকের মন?

আরও পড়ুন: আরজি কর: ধর্ষকের বিকৃতি যেন মনরোগের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি

সম্ভবত না। তার জন্য প্রয়োজন সমস্যার শিকড়ে আলো ফেলা। শিশু জন্মাতে না জন্মাতেই গোলাপি-নীলের তালেগোলে, খেলনা কিংবা পেনসিল বক্সের বাছাইয়ে যে লিঙ্গবৈষম্যের কৃত্রিম ধারণাকে আমরা পুঁতে চলি অহরহ, তা ডাল-পালা মেলে বড় হতে সময় নেয় না। শারীরিক ভাবে যে লিঙ্গের ধারণা সে মাতৃগর্ভ থেকেই শিখে আসে, তাতে বৈষম্য নেই কোথাও। ভেবে দেখুন তো, সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন রয়েছে, কন্যাসন্তানটির হাতে বার্বি-ছাপ পেনসিল বক্স আর পুত্রটির হাতে অ্যাভেঞ্জার্স-ছাপ খেলনা তুলে দেওয়ার? সেটুকু বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা বরং তোলা থাকুকই না ব্যক্তিমানুষটির জন্য। কো-এডুকেশন স্কুলে যে ছেলে ও মেয়েটি নার্সারি থেকে হলায়-গলায় বন্ধু, পিউবার্টি আসতে না আসতেই সেই সম্পর্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে বাধার প্রাচীর! কারণ শারীরিক পরিবর্তন তাঁদের আলাদা লেবেলের তলায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। যে বিভেদ ছোট থেকে তাঁর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে গোলাপি পেনসিল বক্স আর নীল খেলনা। তাছাড়া শাহরুখ খান ছবিতে কলার তুলে সদর্পে বলে গিয়েছেন, ছেলে-মেয়ে কখনও বন্ধু হতে পারে না। অথচ সেই বন্ধুত্বেরই নিদারুণ প্রয়োজন আজ। জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি পর্যায়ে সমবন্ধুতা, সম-প্রতিনিধিত্ব ছাড়া এই সমাজ সুস্থ হতে পারে না কোনও ভাবেই।

পরিবার-পরিজন শেখাবে প্রতিটি সন্তানকে সমান হওয়ার পাঠ, স্কুল কী শেখাবে? না, শুধু ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, ইংরেজি শেখানো যথেষ্ট নয় আর। মেয়েদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ক্যারাটেও নয়। বরং ভীষণ ভাবে প্রয়োজন যৌনশিক্ষার, সাম্যবাদের শিক্ষার। নারী বা পুরুষ শরীরের খুঁটিনাটি যে কোনও অষ্টম আশ্চর্য নয়, কোনও রকেট সায়েন্স নয়, তা 'নীল ছবি' দেখে শেখার আগে যদি সহজ-স্বাভাবিক ভাষায় শিখিয়ে দিতে পারে পাঠ্যবই, তার চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে। আর এই শেখাটা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন গ্রাম-গঞ্জ-মফসসল সর্বত্র। বয়সের ধর্মের ছাপ বয়সে পড়বেই। কিন্তু তা নিয়ে যতটা খোলামেলা ভাবে কথা বলার, আলোচনা করার জায়গা থাকবে, ততই অবাঞ্ছিত কৌতূহল, বয়সের ভুলগুলো এড়ানো সহজ হবে। তার পরেও একদিনে এ সমাজ পুরুষতন্ত্রের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসবে বা রাতারাতি ধর্ষকমুক্ত হবে, তা ভাবলে বোধহয় ভুল হবে। বিন্দু বিন্দু করে একদিন আমরা এমন এক সিন্ধুতে গিয়ে পৌঁছবো, যেখানে আর ক্ষতবিক্ষত নারী শরীর দেখে শিউরে উঠতে হবে না। বলতে হবে না, নাইট ডিউটিতে রেখো না মেয়েদের। রাতদখলের লড়াই নয়, যে বিশ্বে প্রতিটা রাতই হবে নারী-পুরুষের সমান সমান, সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নরাজ্যের জন্য লড়াই জারি রাখা প্রয়োজন ভীষণ রকম। কিন্তু সেই লড়াই যত না বাইরে, তার চেয়েও ভীষণ রকম ভিতরে, চেতনায়। তবেই হয়তো মিলে যেতে পারে বাকি দু'আনা।

More Articles