বিজেপি জমানার 'ইলেক্টোরাল বন্ড' দুর্নীতিকে ভোটের 'হাতিয়ার' করতে পারবে বিরোধীরা?
Electoral Bond: ইলেক্টোরাল বন্ড এমনই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, যেখানে সাধারণ মানুষ জানতেই পারতেন না, যে রাজনৈতিক দলগুলোকে কে বা কারা আর্থিক মদত দিচ্ছে?
গণতন্ত্রে একজন নির্বাচক যখন তাঁর অধিকার প্রয়োগ করেন তখন তাঁর জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, কে বা কারা এই নির্বাচনী দল কিংবা প্রার্থীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছেন। তবেই গণতন্ত্র সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়। অথচ ইলেক্টোরাল বন্ড এমনই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, যেখানে সাধারণ মানুষ জানতেই পারতেন না, যে রাজনৈতিক দলগুলোকে কে বা কারা আর্থিক মদত দিচ্ছে? তাঁরা এ-ও জানতে পারতেন না, তিনি যাকে বা যে দলকে ভোট দিচ্ছেন, তাদের সমস্ত নীতিগুলোকে কোন কোন শিল্পপতি বা ব্যক্তি সমর্থন করছেন এবং তার পিছনে উদ্দেশ্যই বা কী? এবার হয়তো তা জানা যাবে। আমরা একদিকে যখন অঞ্চল স্তরের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবো, তখন কি এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো আইনসম্মত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও কথা বলবো না? আমরা যখন দেখেছি ‘এবার আসল পরিবর্তন’ আর নরেন্দ্র মোদীর জোড়হাত করা ছবি সারা বাংলায় টাঙানো তখন এই ইলেক্টোরাল বন্ডের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চুপ করে থেকেছি। যখন বলেছি ‘আর নয় কাটমানি’ তখন এই আইনানুগ তোলাবাজি চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নটা করা হয়নি, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের পরে, অনেক কিছুই সামনে আসতে পারে। শুধু বিজেপি নয়, আরও যারা এই বন্ডের মাধ্যমে টাকা পেয়েছেন, তাঁদেরও হিসেব দিতে হবে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রায় দিয়েছেন, ইলেক্টোরাল বন্ড বাতিল করতে হবে। শুধু তাই নয়, রায়ে এ-ও বলা হয়েছে, যে ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল তারিখ আদালতের অন্তর্বতী নির্দেশ থেকে শুরু করে আজ অবধি, ঐ বন্ডে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল টাকা পেয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে জানাতে হবে। এখনো পর্যন্ত যে বন্ড ভাঙানো হয়নি, সেই টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এই বিষয়টি শুনানির ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানানো হয়েছিল, নাগরিকদের এই বিষয়ে জানার কোনও মৌলিক অধিকার নেই। সর্বোচ্চ আদালতে এই রায়ের প্রথম অংশে কিন্তু পরিষ্কার বলা হয়েছে, এই ইলেক্টোরাল বন্ডে কারা কারা কোন রাজনৈতিক দলকে টাকা দিয়েছে, তা নাগরিকদের জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এর মধ্যে দিয়েই জানা যাবে, কোন কোন বিশেষ শিল্পগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে এই সরকারের দ্বারা। অথচ বেশীর ভাগ গণমাধ্যমই কিন্তু এর আগে এই বিষয় নিয়ে কোনও কথা বলেনি, সচেতন করার চেষ্টা করেনি নাগরিকদের, যা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের কাজ। উল্টে তাঁরা তাঁদের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করে গিয়েছেন যে সমস্ত আঞ্চলিক দল এবং তাঁদের নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০১৪ সালের আগে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হাওয়া তৈরি করা গিয়েছিল যে একমাত্র সৎ দল বিজেপি এবং একমাত্র সৎ নেতা নরেন্দ্র মোদী। অথচ নাগরিকেরা যদি আজকে প্রশ্ন করেন, মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরের সরকার ফেলার জন্য একনাথ শিন্ডে এবং অন্যান্য বিধায়কদের কেনার জন্য কত টাকা দিতে হয়েছিল, তার উত্তর কি বিজেপির কাছে আছে? এখন বাংলায় অঞ্চল স্তরের নেতাদের ছোট ছোট দুর্নীতিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। যাতে নরেন্দ্র মোদীর দুর্নীতিগুলো থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরানো যায়। আর সেটা কি আমরা আজ বুঝতে পারছি, বা বলা ভালো বুঝতে চাইছি?
আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ড অসাংবিধানিক! মোদি সরকারের প্রকল্প খারিজ সুপ্রিম কোর্টে
সরকার চাইছে, প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত আর্থিক লেনদেন সরকার জানুক, অথচ কোন শিল্পপতির সুবিধার্থে কার থেকে সরকার টাকা নিচ্ছে ওই অস্বচ্ছ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’-এর মাধ্যমে, তা একজন নাগরিক জানবেন না কেন? বিজেপি যেহেতু অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে নিজেদের 'ভিন্ন' করে তুলে ধরতে চায়, সুতরাং তাঁদের তো উচিত আরো বেশী করে এই ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বলা, কারা তাঁদের এই ‘ভিন্নতর’ রাজনৈতিক ভাবনাকে মেনে নিয়ে অনুদান দিচ্ছেন। কিন্তু তা কেন হচ্ছে না? আসলে বেশীরভাগ মানুষ জানেনই না এই ইলেক্টোরাল বন্ড কী?
আসুন দেখে নেওয়া যাক, এই ইলেক্টোরাল বন্ড কী? কেনই বা এ নিয়ে এতো বিতর্ক? আদালতে কেন বাতিল হয়ে গেল মোদির এই প্রকল্প? ২০১৭ সালে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, এরপর থেকে তাঁরা এই ইলেক্টোরাল বন্ড আনতে চলেছেন এবং তার মাধ্যমে যে কোনও ব্যক্তি তাঁর পছন্দের রাজনৈতিক দলের জন্য যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারবেন। তাঁকে শুধু স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে বন্ড কিনতে হবে। আগে কী হতো? যদি কোনও ব্যক্তি কোনও দলকে আগে টাকা দিতে চাইতেন, তখন হয় চেক অথবা ক্যাশে দিতেন। তখন কোন ব্যক্তি কাকে কত টাকা দিচ্ছেন সেটা দু'পক্ষের ব্যাঙ্কের বই দেখলেই বোঝা যেত।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহলে নতুন এমন কী প্রস্তাব দিলেন, যা নিয়ে এত এত প্রশ্ন উঠল? তিনি বললেন,অনেকেই তাঁদের কালো টাকা এই নির্বাচন প্রক্রিয়াতে অনুদান দিয়ে সেগুলোকে সাদা করিয়ে নেন। এবার থেকে স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সেই ব্যক্তিদের ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে হবে। ওই ইলেক্টোরাল বন্ডগুলোর আয়ু মাত্র ১৫ দিনের। ধরা যাক, কোনও ব্যক্তি স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে ১ লক্ষ টাকার বন্ড কিনবেন। তিনি ব্যাঙ্ককে ওই ১ লক্ষ টাকা দেবেন আর বলে দেবেন উনি কোন দলকে টাকাটা দিতে চাইছেন। ব্যস, সেই ব্যক্তির দ্বায়িত্ব শেষ। এবার স্টেট ব্যাঙ্কের দায়িত্ব ওই দলকে সেই বন্ডটি দেওয়ার। বন্ডে যেহেতু কারুর নাম লেখা নেই, সুতরাং যুক্তি অনুযায়ী কারওর পক্ষে জানা সম্ভব নয় কে ওই টাকাটা দিলেন?
দেখা গিয়েছে, ৬ হাজার কোটি টাকা উঠেছে ইলেক্টোরাল বন্ডে তার ৯৫ শতাংশ অর্থ পেয়েছে বিজেপি ও অন্যান্যরা। একমাত্র বামপন্থী দলগুলো এই ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে কোনও অনুদান নেয়নি এবং সর্বোচ্চ আদালতে এর বিরুদ্ধে অন্যতম আবেদনকারীও ছিল তারাই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচন কমিশন, অর্থ মন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও খোদ প্রধানমন্ত্রী নিয়ম ভেঙে এর মাধ্যমে দলের টাকা পাওয়ার পথ করে দিয়েছেন। অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন তা নিয়ে উত্তর দেওয়ার দায়িত্বও তো সরকারেরই বর্তায়। কিন্তু সরকারের তরফে মন্ত্রীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন, গত ৭০বছর ধরে কংগ্রেস এবং গান্ধি পরিবার এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আগে ২০,০০০ টাকা ক্যাশে দেওয়া যেত চাঁদা, এই ইলেক্টোরাল বন্ড আসার পরে সেটা তাঁরা ২,০০০ টাকায় নামিয়ে এনেছেন। আগে দেখা যেত, যে কোনও রাজনৈতিক দলকে কোনও ব্যক্তি, চেক,নগদ অথবা ব্যাঙ্ক ড্রাফটের মাধ্যমে টাকা দিচ্ছেন। এই ইলেক্টোরাল বন্ড চালু হওয়ার পরে দেখা গেল যে চেক, নগদ ছাড়াও বেশিরভাগ অনুদান এসেছে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে।
স্টেট ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করে কারা? যারা সরকারে ক্ষমতাসীন থাকেন। যেহেতু স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে “কেওয়াইসি” দেওয়া আছে প্রতিটি গ্রাহকের, সুতরাং তাঁরাই একমাত্র জানতে পারবেন কে বা কারা ১০ লক্ষ টাকার (ন্যূনতম) নির্বাচনী বন্ড কিনেছেন আর কারা তার বেশি ( টাকা কোটির অঙ্কে) কিনেছেন? অন্য কোনও বিরোধী দল যদি টাকা পেয়েও থাকে, স্টেট ব্যাঙ্ক কি কাউকে জানাবে তাঁর পরিচয়? সরকারকে যদি স্টেট ব্যাঙ্ক জানায় যে কে বা কারা তাঁদের দলকে বন্ড কিনে অর্থ সাহায্য করেছেন, দল ক্ষমতায় আসার পর এটা কি নিশ্চিত করে বলা যায় তাঁরা সরকারের থেকে বাড়তি সুবিধা নেবেন না? জনগণ যেহেতু ভোট দিয়ে সাংসদ বা বিধায়ক নির্বাচন করেন, তাঁদের পূর্ণ অধিকার আছে এটা জানার, যে কে বা কারা এই সাংসদ বিধায়কদের জন্য কত টাকা করে দান করেছেন। তাঁরা কেন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন না? তাহলে কি এই দুর্নীতিমুক্ত সরকারের যা যা প্রতিশ্রুতি ছিল, সেগুলো সম্পূর্ণই ভাঁওতা?
আরও পড়ুন:রাজনৈতিক দলগুলোর অনুদান আসে কোত্থেকে? সত্যিই জানার অধিকার নেই নাগরিকদের?
২০১৮ সালে বিজেপি এই নির্বাচনী বন্ডে পেয়েছিল ২১০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ঐ বন্ডে বিজেপি পায় ১৪৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ২,৫৫৫ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ২,২৩৮ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ১,০৩৩ কোটি এবং গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ১,২৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে ৬,৫৬৪ কোটি টাকা। এখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে সামনে আসবে, কে বা কারা এই টাকা দিয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ হলে, বিজেপির দুর্নীতি নিয়ে বুক বাজানো বন্ধ হবে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের মত। ফলে এই রায় কিন্তু নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর হাতে বড়সড় অস্ত্র তুলে দিল, তা বলাই যায়। যদি বিরোধী দলগুলি এই নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে এবং নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করাতে পারে, ঐ নাম প্রকাশ্যে আনতে, তাহলে আগামী নির্বাচনে অন্তত একটা সমানে সমানে লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে যদি বিরোধী দলগুলো এই নিয়ে রাস্তায় নামতে পারে বা ওই টাকা দিয়ে যে যে সম্পত্তি কেনা হয়েছে, তার হিসেব চাইতে পারে, তাহলে অন্য রকম খেলা হলেও হতে পারে জাতীয় রাজনীতির ময়দানে।