দেদার জঙ্গল সাফাই! দুশ্চিন্তা কানহা, বান্ধবগড়ের মতো জঙ্গলের অস্তিত্ব নিয়েও
Forest Land Diversion: গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০০৯-১০ সালে জঙ্গলসাফাইয়ের হার সবচেয়ে বেশি। মোট অঙ্কের প্রায় ৭৬,৭৪৩ হেক্টর জমিই সাফ করে দেওয়া হয়েছে এই এক বছরেই।
প্রায় প্রতিদিন একটু একটু করে জঙ্গল কমছে। সাফ হচ্ছে গাছপালা। কমছে বন্যপ্রাণীদের বসবাসের জায়গা, বাড়ছে মানুষের আগ্রাসন। গত পনেরো বছরে ঝড়ের গতিতে জঙ্গল সাফাই হয়েছে ভারতে। জঙ্গল কেটে তৈরি হয়েছে রাস্তা, খনি। যে পরিসংখ্যান রীতিমতো ভয় দেখাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।
আসলে পৃথিবীর সবটুকু স্থানে জাঁকিয়ে বসতে চায় মানুষ। কোথাও কারওর জন্য একটুকু অবশিষ্ট রাখতে রাজি নয় সে। যা কিছু সেরা, যা কিছু উৎকৃষ্টতম সব চাই। যা কিছু নয়, তাকেও গড়েপিটে নিজেদের সুবিধামাফিক তাকে বানিয়ে নিতে চায় সে। আর সেই সুবিধার জন্য বাকি সমস্ত জীবজগৎকে তুচ্ছ করে দিতে দু'বার ভাবে না মানুষ। আর এ কোনও নতুন কথা নয়।
আরও পড়ুন: হাতে দু’দিনের ছুটি? জল-জঙ্গল-পাহাড় একসঙ্গে পেতে আসতেই হবে যে ঠিকানায়
কিন্তু আদৌ কি সুস্থ ভবিষ্য়তের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এই আগ্রাসন! প্রায় প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে উষ্ণায়ন। গলে যাচ্ছে হিমবাহ, তড়তড়িয়ে বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। অথচ জঙ্গল কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। গত পনেরো বছরে অন্তত ৫৮,২৮২ হেক্টর বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে খনির কাজে। অন্তত ৪৫,৩২৬ হেক্টর জঙ্গল সাফ করে তৈরি হয়েছে রাস্তা। শুধু কি রাস্তা তৈরি বা খনির কাজ। আরও নানা ছোটখাটো কাজে জঙ্গল সাফাই হয়েছে নির্বিচারে। হিসেব বলছে, সেচের কাজে হাত পড়েছে ৩৬,৬২০ হেক্টর বনভূমিতে, ট্রান্সমিশন লাইনের জন্য গিয়েছে ২৬,১২৪ হেক্টর জনি, প্রতিরক্ষার কাজের জন্যেও গিয়েছে ২৪,৩৩৭ হেক্টর বনভূমি। এখানেই শেষ নয়, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১৩,১৩৬ হেক্টর, রেললাইনের জন্য ৯,৩০৭ হেক্টর, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৪,১০১ হেক্টর এবং বায়ুকল তৈরির খাতে সাফ করে দেওয়া হয়েছে ২,১৮১ হেক্টর বনভূমি।
বিন্দু বিন্দু করেই সিন্ধু হয়। এখানেও তাই হয়েছে। অল্প অল্প করে বনভূমি সাফ করতে করতেই তৈরি হয়েছে বিরাট 'পোড়োজমি'। সভ্যতা এগিয়েছে বটে। তবে সর্বনাশ হয়েছে পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্রের। সম্প্রতি লোকসভায় কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভুপেন্দ্র যাদব দাবি করেছেন, এ সমস্ত জঙ্গলসাফাই-ই হয়েছে ১৯৮০ সালের ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী। সরকারি তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি জঙ্গলভরাট হয়েছে খনির কাজে। গত পনেরো বছরের মধ্যে ২০০৯-১০ সালে জঙ্গলসাফাইয়ের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। মোট অঙ্কের প্রায় ৭৬,৭৪৩ হেক্টর জমিই সাফ করে দেওয়া হয়েছে এই এক বছরে। আর এই জঙ্গল সাফাইয়ের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে পঞ্জাব। তার পরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, তেলঙ্গানা ও গুজরাটের নাম।
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, ভারতের সবকটি উল্লেখযোগ্য জঙ্গলই রয়েছে এই রাজ্যগুলিতেই। কানহা, বান্ধবগড় থেকে শুরু করে পেঞ্চ-সবকটি বড় ব্যাঘ্রপ্রকল্পই রয়েছে মধ্যপ্রদেশে। বিশ্বের একমাত্র জঙ্গল গির, যেখানে এশিয়াটিক সিংহের দেখা মেলে। সেই গির কিন্তু গুজরাটেই অবস্থিত। ফলে বুঝতেই পারছেন, এই যে বিশাল সংখ্যক জঙ্গল সাফ হয়ে চলেছে এতগুলো বছর ধরে, সেগুলো আসলে যাচ্ছে কোথা থেকে। যদিও সরকারের দাবি, জঙ্গল সাফাইয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সরকারের তরফে, যাতে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট না হয়। তবে তাতে আদৌ পরিবেশের উপকার হয়েছে কিনা বলা কঠিন!
কিছুদিন আগেই 'শেরনি' নামে একটি ছবি নিয়ে বেশ চর্চা চলেছিল। সেখানে ফরেস্ট রেঞ্জারের ভূমিকায় প্রায় চমকে দিয়েছিলেন বিদ্যা বালান। ছবিতে দেখানো হয়েছিল, কীভাবে খনির কাজের জন্য কাটা পড়ে জঙ্গল। যার খাদ্যাভাবে পড়ে নরখাদক হয়ে ওঠে একটি গর্ভবতী বাঘিনী। হুকুম হয় শিকারি লাগিয়ে বাঘিনীটিকে হত্যার। অবশেষে সেইখানে গিয়েই শেষ হয়েছিল গল্পটা। এ আসলে কোনও বুনে তোলা গল্প নয়, এই ঘটনা তৈরি হয়েছিল মহারাষ্ট্রের একটি জঙ্গলের এক্কেবারে সত্যিকারের এক ঘটনার উপরেই। যেখানে বাঘের হামলায় মৃত্যু হয়েছিল আশপাশের গ্রামের অন্তত ১৩ জন বাসিন্দার। অবশেষে শিকারির গুলিতে প্রাণ যায় বাঘটির। অনাথ হয় দুটি সদ্যজাত ব্যাঘ্রশাবক। আসলে জঙ্গলসাফাইয়ের পরিণাম বাস্তুতন্ত্রের উপরে ঠিক কতখানি, তা বুঝিয়ে দিয়েছিল এই ঘটনা। আসলে তো চেনের মতোই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জঙ্গলের সমস্ত প্রাণী। জঙ্গলে হাত পড়লে নড়ে যায় বাস্তুতন্ত্রের গোটা কাঠামোটাই। আর যেখানে যেখানে জঙ্গল সাফাই করে নগর তৈরি হয়েছে, সেখানেই একই পরিণতি হয়েছে। আর সম্প্রতি এ ব্যপারটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদেরা।
তবে তাতে হুঁশ ফেরেনি সরকারের। তারা বনভূমি সাফাইয়ের প্রক্রিয়া আরও সহজতর করে তুলতে নিয়ে এসেছে নয়া সংশোধনী আইন। নয়া আইন বলে বনভূমির জন্য সংরক্ষিত জমি দখল করা হয়ে উঠতে চলেছে জলভাত। আর তাতেই মাথাব্যথা বেড়েছে পরিবেশবিদদের। যেভাবে গত কয়েক বছরে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, হেক্টরের পর হেক্টর জমি নগর গড়ার কাজে ব্যবহার হয়েছে, সাফ হয়ে গিয়েছে বন্যপ্রাণীদের থাকার জায়গা, তাকে মোটেই ভালো ভাবে দেখছেন না অভিজ্ঞরা।
১৯৯৬ সালের একটি মামলায় যুগান্তকারী এক রায় দিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। তারা জানিয়ে দিয়েছিল, যে কোনও বনভূমি যা সরকারি খাতায় জঙ্গল হিসেবে নথিভুক্ত রয়েছে, তাতে হাত দেওয়ার জন্য চাই ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স। সেই মামলায় ১৯৮০ সালের ফরেস্ট কনজারভেশন আইনটি খারিজ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই আইনে এত বছর পরে সংশোধনী আনছে কেন্দ্রীয় সরকার। যেখানে জানানো হয়েছে, যে ক'টি বনভূমি ১৯৮০ সালের ২৫ অক্টোবরের পরে সরকারি হিসেবে জঙ্গল হিসেবে নথিভুক্ত আছে, সেগুলোই ওই প্রধান আইনের আওতায় হবে।
আরও পড়ুন:বিপদের চরম সীমায় পৃথিবী! নির্বিচারে জঙ্গল কাটার যে মাশুল দিতে হবে আপনার সন্তানকেও…
রাতে চোরাচালানকারীদের ভয়, দিনের আলোয় সভ্যতার ভয়। কখন এসে পড়বে সরকারি নির্দেশের খাঁড়া। আর তারই পাল্লায় পড়ে ক্রমশ কমছে জঙ্গলের দাপট। কমছে পশুপাখি কীটপতঙ্গের ভারসাম্য। যেভাবে মানুষের আগ্রাসন বাড়ছে, তাতে ভয় হয় যে কোনওদিন না পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষ এবং মানুষই থেকে যায়। ডায়নোসরের মতোই বিলুপ্তির পথে চলে যায় এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু, যা মানুষের সরাসরি উপকারে লাগে না! এমনই এক ভয়ঙ্কর দিনের পথে এগোচ্ছি বোধহয় আমরা।