ইলেক্টোরাল বন্ড মারফৎ জোড়া ফুলেরও বিপুল লক্ষ্মীলাভ! তৃণমূলকে টাকা দিল কারা?

Electoral Bond: কিন্তু মুখে যা-ই বলুন না কেন, বিজেপির তৈরি প্রকল্প ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে ভালোই লাভবান হয়েছে তৃণমূল। শুধু কলকাতারই নয়, দেশের বহু সংস্থার থেকেই মোটা অঙ্কের অনুদান ঢুকেছে তৃণমূলের কোষাগারে।

ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত ভাবেই সব থেকে বেশি মুনাফা করেছে বিজেপি। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য-নথি অনুযায়ী, বিজেপির পরেই তালিকায় যে নামটি রয়েছে, সেটি তৃণমূলের। ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পের থেকে আসা মোট অনুদানের অন্তত ১২ শতাংশ পেয়েছে তৃণমূল। তার পরে তালিকায় রয়েছে কংগ্রেস এবং অন্যান্য ছোটবড় দলগুলি।

খাতায় কলমে বিজেপির থেকে তৃণমূল বা কংগ্রেসের কোষাগারে ঢোকা অর্থের পরিমাণে পার্থক্য আকাশ-পাতালের। বিজেপি পেয়েছে ৪৮ শতাংশ অর্থ, তৃণমূল ১২ শতাংশ ও কংগ্রেস ১১ শতাংশ। তবে শুনতে ১২ শতাংশ হলেও সে টাকাটা নেহাৎ কম নয়। বৃহস্পতিবার এসবিআই ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে তাদের হাতে থাকা সমস্ত তথ্য-নথি হলফনামা-সহ প্রকাশ করে দিয়েছে। তা ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে।

প্রথম দফায় এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্যনথিতে জানা গিয়েছিল কোন কোন সংস্থা বা ব্যক্তি কত টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছেন রাজনৈতিক দলগুলিকে অর্থসাহায্যের জন্য। কোন দল কত টাকা পেয়েছে, তা-ও সামনে এসেছিল ওই নথি থেকে। সেখান থেকেই জানা যায় যে এসবিআই প্রদত্ত ইলেক্টোরাল নথি সংক্রান্ত নথিতে সবচেয়ে বেশি অর্থপ্রাপ্তদের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দল তৃণমূল। নামে সর্বভারতীয় থাকলেও বছর কয়েক আগেই নির্বাচন বিধির কড়া নিয়মের ফাঁড়ায় জাতীয় দলের মর্যাদা হারিয়েছে তৃণমূল। গোয়া এবং ত্রিপুরায় প্রাণপন নিজেদের ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করেও অসফল হয় তারা। ফলে খাতায় কলমে পশ্চিমবঙ্গের দল হয়েই থেকে যেতে হয়েছে তৃণমূলকে।

আরও পড়ুন: সবার টাকা বিজেপির ঘরে! ইলেক্টোরাল বন্ডের যে তথ্যে তোলপাড়

রাজনৈতিক মঞ্চে একে অপরের সঙ্গে শত্রুর মতোই ব্যবহার করে তৃণমূল ও বিজেপি। সময়-সুযোগ পেলেই মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীকে এক হাত নিয়ে থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে যে বিজেপি-বিরোধী জোট তৈরি হয়েছে, তাতে উল্লেখযোগ্য জায়গাতেও রয়েছে তৃণমূল। তবে সেই জন্মলগ্ন থেকেই সেই 'ইন্ডিয়া' জোটে তেমন ঐক্যমত্য নেই। ফলে জোট বাধা হলেও জোট জমেনি তেমন। কিন্তু রাজ্যে বা কেন্দ্রে বারবারই সরব হতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমোকে বিজেপি বিরোধিতায়।

কিন্তু মুখে যা-ই বলুন না কেন, বিজেপির তৈরি প্রকল্প ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে ভালোই লাভবান হয়েছে তৃণমূল। শুধু কলকাতারই নয়, দেশের বহু সংস্থার থেকেই মোটা অঙ্কের অনুদান ঢুকেছে তৃণমূলের কোষাগারে। দীর্ঘদিন ধরে মুখ্যমন্ত্রী ডিএ বাড়াতে পারছেন না তেমন। কেন্দ্রের সঙ্গে সেই ডিএ বৈষম্য বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। তবে রাজনৈতিক অনুদানের দৌড়ে যে একেবারেই পিছিয়ে নেই তৃণমূল, তা বোঝা গিয়েছে ভালোই।

এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্য খুঁটিয়ে দেখে জানা গিয়েছে, স্যান্টিয়েগো মার্টিনের গেমিং ও হোটেস সার্ভিস সংস্থা থেকে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে মোট ৫৪২ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে তৃণমূল। এরা দেশের অন্যতম বড় লটারি সংস্থাগুলির একটি। গত কয়েক বছরে, অন্তত তিনজন তৃণমূল নেতা এই লটারিতে ১ কোটি টাকা জিতেছেন। মার্টিস অবশ্য বিজেপিকেও খালি হাতে যেতে দেননি। ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন কেন্দ্রের শাসকের জন্যও।

পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে লটারির ব্যবসায় যুক্ত ফিউচার গেমিংই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়েছিল। খাতায় কলমে প্রায় ১,৩৬৮ কোটি টাকা। এখন হিসাব বেরোনোর পরে দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে সব চেয়ে বেশি টাকা চাঁদা মারফত পেয়েছে তৃণমূলই। এম কে স্ট্যালিনের দল ডিএমকে-ও ওই লটারি সংস্থার কাছ থেকে ৫০৩ কোটি টাকা পেয়েছে।

নথি থেকে জানা গিয়েছে, এভি ট্রেডিং এন্ড ফাইন্যান্স প্রাইভেট লিমিটেড নামে কলকাতার একটি সংস্থা ১১২.৫ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছিল। যার মধ্যে কংগ্রেস পায় ৫৩ কোটি টাকা। তৃণমূল পায় ৪৫.৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিজেপি পেয়েছে ১ কোটি টাকা। আপ পেয়েছ ১০ কোটি টাকা এবং বিজেডি পেয়েছে ৩ কোটি টাকা। এর পরে রয়েছে হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড। যারা দিয়েছে ৩৬২ কোটি টাকা, ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঢেলেছে ৯০ কোটি টাকা, এমকেজে এন্টারপ্রাইজ এবং এভারেজ ট্রেডিং ৪৬ কোটি টাকা করে দিয়েছে তৃণমূলকে।

আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা অনুদান! কে এই লক্ষ্মী মিত্তল?

গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপির ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই ওই সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র প্রকাশ্যে আনার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। প্রথম রফার নথিতে বন্ড ক্রয়কারীর নাম, অনুদানের পরিমাণ ও অনুদানের তারিখ প্রকাশ করেছিল। পাশাপাশি কোন দল কত টাকা পেয়েছে, তা-ও জানানো হয়েছিল ওই তালিকায়। তবে সেই তথ্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ইলেক্টোরাল বন্ডে থাকা আলফা নিউম্যারিক নম্বটি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয় এসবিআইকে। যার থেকে জানা সম্ভব, কোন দলকে কোন কোন শিল্পপতি বা ব্যক্তি বা সংস্থা ওই অর্থ দিয়ে সাহায্য় করেছেন। ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে সেই নথিও।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলায় একসময় বলেছিলেন, রাজ্যে দিদি থাক আর কেন্দ্রে মোদি। নিন্দুকদের কেউ কেউ বলেন, আসলে মুখে যতই বিরোধিতার কথা বলুন না কেন মমতা, আদতে মোদি সরকারের সঙ্গে দিব্যি তাল মিলিয়েই রাজত্ব শাসন করছে তৃণমূল। ইলেক্টোরাল বন্ড সামনে আসার পরেই আবগারি মামলায় গ্রেফতার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিবাল। সেই গ্রেফতারির দীর্ঘ সময় পরে এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তৃণমূল। প্রশ্ন উঠেছে, আদতে কি সরাসরি মোদি বিরোধিতার পথ এড়িয়েই চলছে এখন তৃণমূল। তা কি ভোট কাছে বলেই, নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ওই বিপুল পরিমাণ লক্ষ্মীলাভ কি ক্রমশ বাধা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে তৃণমূলের বিজেপি-বিরোধিতার পথে? উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও।

More Articles