এই নিয়ে বারো বার গ্র্যামি স্যালুট, ৮১ বছর বয়সে এসেও কীভাবে জনপ্রিয়তার শিখরে পল সাইমন

Paul Simon : “বার্কলি কলেজ অফ মিউজিক”এর ডক্টরেট অথবা ২০০১ সালের ‘রক এন্ড রোল হল অফ ফেম’ থেকে শুরু করে ২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান, এসবই রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

পল সাইমন। নামটা অবশ্য আজকের সময়ে খুবই জনপ্রিয়। আমেরিকার নামকরা একজন সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক ও গীতিকার এই পল সাইমন। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে একটা ধোঁয়াশা ছড়িয়েছিল। তিনি বেঁচে আছেন কিনা সেই জল্পনাও শুরু হয়েছিল। যদিও গতকাল আমেরিকার সংগীত গোষ্ঠীর তরফে অফিশিয়ালি জানানো হয়েছে যে, বেঁচে আছেন সাইমন। ৮১ বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছেও গান লিখছেন তিনি। ১৯৫০ সালে গানের জগতে যে দুরন্ত সফরটা তিনি শুরু করেছিলেন তা আজও চলছে বহাল তবিয়তে, আজও তিনি সমান জনপ্রিয়। জীবনভর দাপুটে একটা গানের ইনিংস নিয়ে রয়েছে সাইমন।

তবে আজকের এই চূড়ান্ত সাধ্যের শুরুটা এককভাবে হয়নি, হয়েছিল জুটিতে। ১৯৬৪ সালে সাইমন ও গার্ফোনাঙ্কেল জুটির মাধ্যমে খ্যাতি, প্রভাব এবং বাণিজ্যিক সাফল্যের পথচলা শুরু হয়। অবশ্য বিখ্যাত এই জুটির অধিকাংশ গানই লিখেছিলেন সাইমন। শুধু তাই নয়, তাঁর লেখা গানগুলি জনপ্রিয়তার নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বরে ছিল। দ্য সাউন্ড অফ সাইলেন্স, মিসেস রবিনসন এবং ব্রিজ ওভার ট্রাবল্ড ওয়াটার এই তিনটি গানের হাত ধরে তিনি ক্রমের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে শুরু করেন।

এরপর ১৯৭০ সালে যখন এই জুটির জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত ঠিক এরকম সময়েই অভ্যন্তরীণ বিবাদে ভেঙে যায় জুটি। যদিও এই ভাঙা গড়া বহুবারই চলতে থেকেছে দুই শিল্পীর মধ্যে। পরবর্তীতে বারবার তাঁরা ফিরেছেন একসঙ্গে। কিন্তু সাইমনকে এরমধ্যেই চিনতে শুরু করেছে গোটা দেশ। শুধু জুটিতে নয় এককভাবেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন সাইমন। ফলে প্রাথমিকভাবে জুটি ভেঙে যাওয়ায় খানিকটা টালমাটাল পরিস্থিতি হলেও অল্প দিনের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর সাইমন এবং আগামী পাঁচ বছরে তিনটি বহুল প্রশংসিত অ্যালবাম রেকর্ডিং করেন। গিটার বাদক এবং একক গায়ক ও গীতিকার হিসেবে একক ক্যারিয়ারের সেই শুরু। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৬ সালে আবার একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার টাউনশিপ সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত এই অ্যালবামটির নাম ছিল গ্রেসল্যান্ড।

আরও পড়ুন - অস্কারের দৌড়ে বাঙালির নাম, ত্রিশ বছরের পুরনো সত্যজিতের স্মৃতি কি ফিরিয়ে দেবে ২০২৩?

এরপর ক্রমেই যখন একক শিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন তখন ঝুঁকলেন চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখার কাজে। ১৯৮০ সালে প্রথম সংগীত রচনা করলেন ওয়ান-ট্রিক পনি চলচ্চিত্রের জন্য। এরপর কবি ডেরাক ওয়ালকটের সঙ্গে মিলে ১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্য কেপম্যান চলচ্চিত্রের জন্যও গান বাঁধলেন সাইমন।

১৯৪১ সালের ১৩ অক্টোবর নিউ জার্সির নিউকার্কে জন্মগ্রহণ করেন সাইমন। পিতা লুইস ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। পাশাপাশি একজন বেসবল খেলোয়াড়, নৃত্য দলের সদস্য এবং মঞ্চ অভিনেতা। অন্যদিকে মা বেলি ছিলেন এলিমেন্টারি স্কুলের একজন শিক্ষিকা। বাবা মায়ের গুণ সাইমন লালন করেছিলেন নিজের মধ্যে। ছোটবেলায় বাবার মতোই বেসবল খেলতে ভালোবাসতেন তিনি। এমনকী গানের প্রতি ভালোবাসাও পেয়েছিলেন জন্ম সূত্রেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে আর্ট গার্ফোঙ্কেলের সঙ্গে পরিচয় হয়, তারপর থেকে শুরু হয় একসঙ্গে পথ চলা। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু হয় এই জুটি। সাইমন সঙ্গীত কিংবদন্তী উডি গাথরি ও লিড বেলি-র ক্ষেত্র জাজ, ফোক ও ব্লুস এরও উন্নতি সাধন করেন।

এরপর উচ্চশিক্ষার কারণে আবার দুরতে তৈরি হয় দুজনের। যদিও সাইমন একক প্রয়াসে নিজেকে এবং নিজের গানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৫৭ ও ১৯৬৪ এর মধ্যবর্তী সময়ে সাইমন ৩০টিরও বেশি গান লেখেন এবং রেকর্ড করেন। অতঃপর ১৯৬৪ সালে আবার জুটিতে ফিরে আসেন দুজনে। এরপর থেকে শুরু খ্যাতির সিঁড়িতে চড়া। গার্ফোঙ্কেল এর সাথে টম ও জেরি নামে কিছু গান করেন যার মধ্যে “আওয়ার সং” ও “দ্যাট’স মাই স্টরি” খুবই জনপ্রিয়। অন্যদিকে একক শিল্পী হিসেবেও রয়েছে অজস্র নজির। অ্যামি, বিগ, হান্ট, কিং, ট্রাইবুট ও ম্যাডিসন ইত্যাদি রেকর্ড সংস্থা থেকে প্রচুর গান রেকর্ড করেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছদ্মনামেরও আশ্রয় নিয়েছেন বহু সময়। এরকম কিছু ছদ্মনাম হল, জ্যারি ল্যান্ডিস, পল কেইন ও ট্রু টেইলর।

একক সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে সাইমন এরপর ইংল্যান্ড পদার্পণ করেন। সেখানেই আলাপ হয় ক্যাথি চিটির সঙ্গে। সম্পর্কের পরিণতি পায় পরবর্তীতে। অবশ্য এছাড়া আরও দুবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। একের পর এক ফোক ক্লাবে গান গাইতে থাকেন সাইমন। অবশেষে ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডে দ্য পল সাইমন সংবুক নামে তার একটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরই পাশাপাশি চলে জুটি বেঁধে গার্ফোঙ্কেলের সঙ্গে কাজও। আগেই বলা হয়েছে এই জুটির ভাঙা গড়ার কাজ বারবার চলেছে। তার একটা নমুনা অবশ্য কাজের খতিয়ান দেখলেই আঁচ করা যায়। যেমন, ১৯৭৫ সালে টপ টেন সিঙ্গেল মাই লিটল টাউন, এটি সাইমন গার্ফোঙ্কেলের জন্য লেখেন। এই গানটি তাদের দুজনের মৌলিক অ্যালবামেই স্থান পেয়েছিল। সেগুলো হল যথাক্রমে পল সাইমনের “স্টিল ক্রেজি আফটার অল দিস ইয়ারস” ও গার্ফোঙ্কেলের “ব্রেকাওয়ে”। এরপর ১৯৮১ সালে তারা পুনরায় একত্রিত হন সেন্ট্রাল পার্কের কনসার্টের জন্য। আবার খানিকটা বিরতির পর ১৯৯০ সালে তারা দুজন একত্রে “রক এন্ড রোল হল অফ ফেমে” অভিষিক্ত হন।

আরও পড়ুন - বিদেশে জন্মালে অস্কার পেতেন, মানতেন সত্যজিৎ, তুলসী চক্রবর্তী আজ বিস্মৃত অধ্যায়

এরপর অবশ্য পথ খানিকটা আলাদাই হয়ে যায়। কিন্তু আবারও একচাদের তলায় নিয়ে আসে তাঁদের কাজই। ২০০৩ সালে গ্র্যামি পুরস্কার প্রাপক হিসেবে যৌথ ভাবে উঠে আসে সাইমন ও গার্ফোঙ্কেলের নাম। এর রেশ আরও খানিকটা জিইয়ে রাখতে পরের বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালে রোমের কোলোসিয়ামে একটি বিনামূল্যের কনসার্টের আয়োজন করেন। ৬০০,০০০ দর্শক সমাগম সেদিন স্বীকৃতি দিয়েছিল চূড়ান্ত জনপ্রিয়তাকে। এরপর ২০০৫ সালে এই জুটি এবং অ্যারোন নেভিলির যৌথ প্রয়াসে “ব্রিজ ওভার ট্রাবল্ড ওয়াটার”, “মিসেস রবিনসন”, ও “হোমওয়ার্ড বন্ড” নামে তিনটি ডিভিডি বের করেন। এবং এর থেকে প্রাপ্ত অর্থ তুলে দেওয়া হয় হারিকেন ক্যাটরিনায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে।

সারাজীবন অজস্র সম্মান এবং পুরস্কার পেয়েছেন সাইমন। একক শিল্পীর পাশাপাশি জুটিবদ্ধ কাজের জন্য বারো বার গ্র্যামি পুরস্কারও পান তিনি। “বার্কলি কলেজ অফ মিউজিক”এর ডক্টরেট অথবা ২০০১ সালের ‘রক এন্ড রোল হল অফ ফেম’ থেকে শুরু করে ২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান, এসবই রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ২০০৭ সালে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জনপ্রিয় গানের জন্য লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস-এর গার্সউইন পুরস্কারও লাভ করেন সাইমন। আমেরিকা তো বটেই সারা বিশ্বের কাছে একজন আইকনিক শিল্পী হয়েই রয়েছেন সাইমন। থেকে যাবেন আজীবন।

More Articles