মোদি-পুতিন মুখোমুখি: ইউক্রেন থেকে ভারত, যে দিকে জল গড়াল

Modi-Putin Meet: নৈশাহারের টেবিলেই দু'দেশের প্রধানের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। উঠে আসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথাও। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কূটনৈতির সমস্যা মিটবে না, তা পুতিনকে বোঝান মোদি।

তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এ নিয়ে দ্বিতীয় বিদেশ সফরে মোদি। এর আগে জি-৭ বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ইটালিতে, তার পরেই মোদি পৌঁছলেন রাশিয়াতে। বার্ষিক ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সোমবারই মস্কো পৌঁছন তিনি। দু-দিনের সেই রাশিয়া সফর শেষ করে ইতিমধ্যেই তিনি চলে গিয়েছেন অস্ট্রিয়ায়। কিন্তু কেমন হল তাঁর রাশিয়া সফর? রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কোন কোন বিষয়ে কথা হল মোদির? দু'দেশের দ্বিপাক্ষির সম্পর্কের ভিত্তিতেই কতটাই বা ইতিবাচক হল এই বৈঠক?

ক্রেমলিনের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের অসাধারণ এক নেতার অসাধরণ সফর দেখেছে মস্কো। মোদির খাতিরদারিতেও কোনও ত্রুটি রাখেনি রাশিয়া। সেখানকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিতও করা হয়েছে তাঁকে। অবশ্য় এই পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন ২০১৯ সালে। এই বছর মোদিকে নিজের দেশে পেয়ে তাঁর হাতে অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান্ড্রু দ্য অ্যাপোস্টল সম্মান তুলে দেন খোদ রুশ প্রেসিডেন্ট। মঙ্গলবার গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্যালেসে আয়োজিত হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। দু-দিনের সফরে রাশিয়া গিয়ে মঙ্গলবার সেখানকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পাওয়ার পর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। জানান, "অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান্ড্রু দ্য অ্যাপোস্টল পেয়ে সম্মানিত। এই সম্মান আমি ভারতের মানুষকে উৎসর্গ করছি।" রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন,"রাশিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে সম্মানিত করার জন্য আমি আপনাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এই সম্মান শুধু আমার নয়, এটা ১৪০ কোটি ভারতীয়র। এই সম্মান ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে থাকা শতাব্দী প্রাচীন গভীর বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক বিশ্বাসের। এটি আড়াই দশক ধরে থাকা আমাদের বিশেষ কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্মান। আপনার নেতৃত্ব ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক সব ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়েছে এবং প্রতিবারই নতুন উচ্চতা স্পর্শ করেছে।"

আরও পড়ুন: মস্কোয় মোদি! হিংসাদীর্ণ মণিপুরে বিধ্বস্তদের পাশে সেই রাহুলই

গত এক দশকে এটি ছিল মোদী এবং পুতিনের ১৭তম বৈঠক। যদিও ২০১৫ সালের পর এই প্রথম আবার মস্কোয় গেলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদি রাশিয়ায় পা দিয়ে থেকে তাঁকে স্বাগত জানানোয় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়তে দেয়নি রাশিয়া। ২০২৩ সালে যখন রাশিয়া সফরে যান চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং, তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে মস্কো বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন পুতিন সরকারের দ্বিতীয় উপপ্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি চেরনিশেঙ্কো। কিন্তু মোদির জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। তাঁকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হন রাশিয়ার প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ডেনিস মান্তুরভ। পদমর্যাদায় যিনি নাকি পুতিনের পরেই। কার্যত চিনের থেকেও যে কোনও অংশেই ভারতকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে না রাশিয়া, তা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় খামতি রাখেনি মস্কো।

বিমানবন্দর থেকে মান্তুরভের সঙ্গে গা কার্লটন হোটেলে পৌঁছয় মোদির কনভয়। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন প্রবাসী ভারতীয়েরা। ছিল রুশ নৃত্যশিল্পীদের হিন্দি গানের তালে নাচের আসর। প্রবাসী ভারতীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করার পরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রাসাদে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান প্রধানমন্ত্রী। দু’জনের মধ্যে একান্তে কিছু ক্ষণ আলোচনাও হয়। সেখান থেকে মোদী ভিডিএনকেএইচ কমপ্লেক্স এবং রোসাটম প্যাভিলিয়নের একটি প্রদর্শনকেন্দ্রও পরিদর্শন করেন।

এখানেই শেষ নয়, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খোদ নিজের বাসভবনে ব্যবস্থা করেছিলেন নৈশভোজের। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন মোদি। জানা গিয়েছে, নৈশাহারের টেবিলেই দু'দেশের প্রধানের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। উঠে আসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথাও। পুতিনকে মোদি বোঝান যে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনওমতেই মিটবে না কূটনৈতির সমস্যা। প্রায় দু'বছর হয়ে গেলেও ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ইতি টানেনি রাশিয়া। বরং সাম্প্রতিক কালে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে তারা। আমেরিকা-সহ বহু দেশই ইউক্রেনের পাশে। সেই যুদ্ধে ইতি টানার জন্য পুতিনকে একান্তে অনুরোধ করেছেন মোদি। আলোচনা এবং কূটনীতির মাধ্যমেই যে সমাধান সূত্র বেরোনো সম্ভব, যুদ্ধ কোনও পথই নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। সূত্রের খবর, সেখানেই পুতিনকে মোদি জানান, রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিকে ভারত সম্মান করে। প্রাদেশিক ঐক্য এবং সার্বভৌমত্বেও বিশ্বাস করে ভারত। সেই ভাবনা থেকেই তিনি মনে করেন, যুদ্ধ কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতেই মোদি-পুতিন আলোচনায় উঠে এসেছে রুশ সেনায় মোতায়েন হওয়া ভারতীয়দের প্রসঙ্গ। মোদি জানান, গত কয়েক মাসে ভারতীয়দের ভুল বুঝিয়ে রাশিয়ায় যুদ্ধে পাঠানোর অনেকগুলি ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। রাশিয়ায় গিয়ে মৃত্যুও হয়েছে জনা ২৫ ভারতীয়ের। ভারতীয়দের এ ভাবে ভুল বুঝিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা পুতিনকে জানিয়েছেন মোদি। জানা গিয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদিকে। পাশাপাশি আরও নানা কিছু নিয়েই কথা হয়েছে দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে। উঠে এসেছে দু'দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথাও।

গত বছর ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য লেনদেন ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে তা আরও ২০ শতাংশ বেড়েছে। তবে অর্থপ্রদানে ভারসাম্য না থাকায় উদ্বিগ্ন রাশিয়া। রাশিয়ার রফতানি প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ৪ বিলিয়ন ডলার। সূত্রের খবর, এই নিয়েও প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আলোচনা করেছেন রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। ৬৫ বিলিয়ন ডলার থেকে দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছনোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দুই দেশ। পারমাণবিক প্রকল্প এবং নিরাপত্তা চুক্তি নিয়েও দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে সুত্র মারফত জানা গিয়েছে। জ্বালানির চাহিদা পূরণে সাহায্য করার জন্য পুতিনের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, “গোটা বিশ্ব যখন খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের ঘাটতিতে ভুগছিল তখন ভারতে আমরা কৃষকদের কোনও সমস্যায় পড়তে দিইনি। এতে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে”। ক্রেমলিনের সূত্র জানিয়েছে, যে যে বিষয়গুলি নিয়ে দুই দেশের রাষ্টপ্রধানের আলোচনা হয়েছে, তার সবগুলিই চুক্তিতে রূপান্তর হয়েছে, এটা বড় সাফল্য। সেই সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে পারমাণবিক স্টেশন-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে ভারত-রাশিয়ার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। একই সঙ্গে রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র দিতে দেরি করছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন মোদি। দ্রুত সে সমস্যার নিষ্পত্তি হবে বলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পুতিন।

আরও পড়ুন: বিশ্বগুরু হওয়ার পথে মোদি! সরকার পতনের দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুক বিরোধীরা

এদিকে মোদি রাশিয়া পৌঁছতে পৌঁছতেই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইউক্রেন। মঙ্গলবার মোদি-পুতিন আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ঘণ্টা কয়েক আগে এক বিবৃতিতে জেলেনস্কি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠক শান্তি প্রচেষ্টার ওপর বিধ্বংসী আঘাত ও বিরাট হতাশার।’ শুধু ইউক্রেনই নয়, বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকাও। মার্কিন বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, ‘রাশিয়ায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি কী বলেন আমরা সেদিকে নজর রাখছি। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা ইতিমধ্যে দিল্লিকে জানানো হয়েছে।’ আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন রাশিয়া থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের আমদানি বন্ধ করে পুতিন সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে, সেইসময় ভারতের সেখান থেকে তেল আমদানি রুশ অর্থনীতিকে অক্সিজেন জোগাতে পারে বলেই মত পশ্চিমী কূটনীতিকদের। জেলেনস্কির বিবৃতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক। তবে সাউথ ব্লকের একটি সূত্রের বক্তব্য, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রাধিকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। তাই ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর পক্ষে সওয়াল করলেও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরানোর পক্ষপাতী নয় ভারত সরকার।

More Articles